উপকূলে রিমালের আঘাত

জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে গেছে উপকূলীয় নিম্নাঞ্চল

বঙ্গবন্ধু টানেল, বিমান ও নৌযান বন্ধ

প্রকাশ : ২৭ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

গতকাল রাত ৮টার দিকে প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমাল বঙ্গোপসাগরের উপকূলে আঘাত করেছে। ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্র মোংলার দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ উপকূল ও বাংলাদেশের খেপুপাড়া উপকূল অতিক্রম করে। ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সুন্দরবন ও মোংলা বন্দরসহ উপকূলীয় অঞ্চলের নদ-নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় আট ফুট বেড়েছে। এতে সাতক্ষীরাসহ দেশের উপকূলীয় নিম্নাঞ্চল জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে গেছে। এছাড়া রিমালের কারণে কক্সবাজার, যশোর ও বরিশালে বিমান ওঠাণ্ডনামা বন্ধ রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’ উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে।

পায়রা ও মংলা সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়টির সামনের অংশ ও বায়ুচাপের পার্থক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ফেনী, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং এসব জেলার কাছের দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮ থেকে ১২ ফুট অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। উপকূলের দিকে এগিয়ে আসছে প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমাল। এটি উপকূলের দিকে যত এগোবে গতিবেগ একটু একটু করে বাড়তে থাকবে। ফলে প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমাল ‘অতি প্রবল’ ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি গতিবেগ ঘণ্টায় ১১০ থেকে ১২০ কিলোমিটার উঠতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া অফিস। বাংলাদেশের সাতক্ষীরা উপকূলীয় এলাকায় আছড়ে পড়েছে ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রভাগ।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আজিজুর রহমান বলেন, মধ্যরাত নাগাদ স্থলভাগ অতিক্রম করবে ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র। রিমাল সিভিয়ার সাইক্লোন স্ট্রোমে পরিণত হওয়ার সময় ১১০ থেকে ১২০ কিমি. পর্যন্ত গতিবেগে ঝড়ো বাতাস বয়ে যাবে। সব মিলিয়ে ভয়াবহতার সব লক্ষণই রয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় টানা বর্ষণ ও জোয়ারের পানিতে নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। গতকাল জোয়ারে নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। হাতিয়ার চারপাশে নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮-১০ ফুট পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ৫০ হাজার মানুষ। অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে পুরো নিঝুমদ্বীপ প্লাবিত হয়েছে। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। পানি ঢুকে পড়েছে বাড়িগুলোতে। স্থানীয় বাসিন্দা মো. ইউনুস আলী বলেন, বন্দর কিল্লা, নামার বাজার, ইসলামপুর ও মোল্লা গ্রামসহ পুরো নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়ন পানিতে প্লাবিত হয়েছে। পানিতে ভেসে গেছে গবাদিপশুর খাদ্য ও মাছের ঘের। তলিয়ে গেছে ফসলি জমি। উপকূলীয় পটুয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ রাঙ্গাবালী উপজেলায় প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে বাঁধ ভেঙে প্রায় ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। চরমোন্তাজ নয়ারচর এলাকায় গ্রামরক্ষা বাঁধ ভেঙে বউবাজার, নয়ারচর, দক্ষিণ চরমোন্তাজ, উত্তর চরমোন্তাজ, মোল্লাগ্রাম ও চর আণ্ডাসহ প্রায় ১০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া চালিতাবুনিয়া ইউনিয়নের গ্রামরক্ষা বাঁধের একাধিক জায়গা থেকে পানি প্রবেশ করায় গরুভাঙ্গা, চরলতা ও চিনাবুনিয়াসহ আরও কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ বিষয়ে রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিজানুর রহমান বলেন, চালিতাবুনিয়ায় আগেই বেড়িবাঁধ ভাঙা ছিল। গতকাল জোয়ারের পানিতে চরমন্তাজের অনেক জায়গায় বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত। এ কারণে ইউনিয়নের ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বেশিরভাগ জায়গা প্লাবিত হয়েছে। আমরা পানিবন্দিদের দ্রুত আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার ব্যবস্থা করছি।

ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সাতক্ষীরা জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দিন। ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সাতক্ষীরা উপকূলের নদ-নদী উত্তাল রয়েছে। মেঘলা আকাশের সঙ্গে দমকা হাওয়া বইছে। হচ্ছে বৃষ্টিও। এমন পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে উপকূলের মানুষ। প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেওয়া রিমালের প্রভাবে দেশের ১৬ জেলায় ৮ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

পটুয়াখালীর স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে গরু, ছাগল ও হাঁস-মুরগি নিয়ে বেশি বিপদে পড়েছি। জলোচ্ছ্বাসে ঘরের মধ্যে পানি ঢুকেছে, রাতে ঘুমানো সম্ভব নয়। উপকূলের বহু এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মানুষের জীবন রক্ষায় উপকূলের বেশিরভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের পিবিএসগুলোর (সমিতি) জেনারেল ম্যানেজাররা বলছেন, প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমাল মোকাবিলায় উপকূলীয় এলাকায় প্রস্তুতি নিচ্ছে সমিতিগুলো। এরইমধ্যে সাতক্ষীরা উপকূলে ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে ঝড়ো বাতাসে গাছ পড়ে দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে, সেজন্য এরইমধ্যে অনেক এলাকায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ। অনেক এলাকায় লাইন চালু করার পর তা বার বার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। জানা যায়, সম্ভাব্য ঝড়ে আক্রান্ত জেলাগুলোর বিদ্যুৎকর্মীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। ঝড় চলে যাওয়ার পর দ্রুত যাতে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা যায়, সে লক্ষ্যে সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বাগেরহাটের পিবিএসের জেনারেল ম্যানেজার সুশান্ত রায় বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমাল মোকাবিলায় সবার ছুটি বাতিল করা হয়েছে। সবাইকে স্ট্যানডবাই থাকতে বলা হয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে যাতে তা ঠিক করা যায়, এজন্য প্রয়োজনীয় মালামাল বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়েছে। তিনি সুশান্ত রায়, তাদের লাইনম্যান আছে প্রায় ২৩২ জন, ঠিকাদারসহ সংশ্লিষ্ট আরও ১৫০ জন জনবল প্রস্তুত রয়েছে। তিনি আরও বলেন, তাদের অধীন এলাকায় মোট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয় ১০৯ মেগাওয়াট। গ্রাহক আছে প্রায় ৪ লাখ ৮৫ হাজার। কিন্তু এখন মাত্র ২০ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎ পাচ্ছে। ঝড়ো বাতাসের কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা যাচ্ছে না বলে তিনি জানান। পটুয়াখালী সমিতির জেনারেল ম্যানেজার তুষারকান্তি মণ্ডল বলেন, ঝড়ের জন্য যা যা প্রয়োজন, সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। জনবল ও মালামাল সব ঠিক করা হয়েছে। ঠিকাদারদেরও স্ট্যান্ডবাই থাকতে বলা হয়েছে। সাতক্ষীরা পিবিএস-এর জেনারেল ম্যানেজার জিয়াউর রহমান বলেন, আমরা জুম মিটিং করে প্রতিটি অফিসে প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়েছি। আমরা সাধারণত তিন ধরনের প্রস্তুতি নেই- ঝড় আসার আগে, ঝড়ের সময় এবং ঝড়-পরবর্তী সময়ে করণীয়। ঝড় আসার আগে আমরা মোবাইলে চার্জ দিয়ে রাখতে বলি সবাইকে, মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় মালামাল সংগ্রহ করে রাখা হয়, যারা স্ট্যান্ডবাই থাকবেন, তাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। এদিকে ঝড়ের সময় যাতে কেউ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট না হয়, সেজন্য মাইকিং করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি আমরা চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে রাখছি। যাতে করে তাদের এলাকায় বিদ্যুতের তারের ওপরে গাছ পড়লে, তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা যায়। আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, রিমালের বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটার যা দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার আকাশে ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ হিসেবে এটিকে এখনও তীব্র ঘূর্ণিঝড় বলা যায়। অনেক সময় বৃষ্টি ঝরে গতি কমে যায়। আবার অনেক সময় স্থলভাগের ধাক্কা লেগে গতি বেড়েও যায়। এদিকে গতকাল সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান বলেন, প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমাল বাংলাদেশের স্থলভাগের দিকে ধেয়ে আসার প্রেক্ষাপটে উপকূলীয় ১৬ জেলার অধিবাসীদের দেরি না করে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হবে। এরই মধ্যে আট লাখেরও বেশি মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, রিমাল মোকাবিলায় সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িতদের বলা হয়েছে তারা যাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি থেকে মানুষকে আশ্রয়ের ব্যাপারে সহযোগিতা করতে পারে। তিনি বলেন, ‘শহর-গ্রাম, সিটি করপোরেশন, পৌরসভায় জলাবদ্ধতা হওয়ার সম্ভাবনা আছে। যানজট হতে পারে, স্বাভাবিক যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে। ঝড় শেষ না হওয়া পর্যন্ত সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। লঞ্চণ্ডস্টিমার যেগুলো চলাচল করছে সেগুলো বন্ধ থাকবে।