রিমালের প্রভাবে ভারি বর্ষণ

উপকূলের সর্বত্র রিমালের ক্ষত

প্রকাশ : ২৮ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির মুখে পড়েছে সারা দেশের মানুষ। বিশেষ করে উপকূল অঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন। তবে রিমালের প্রভাবে রাজধানীর বাসিন্দাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতির পাশাপাশি সড়কে চলাচলের চরম দুর্ভোগে পড়ে। ঘূর্ণিঝড়ের টানা বৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সেখানকার মানুষের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। জোয়ারে ও বাতাসে অধিকাংশ কাঁচাঘর বিধ্বস্ত হওয়ায় লাখো মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। উপকূলীয় বেশিরভাগ এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। তবে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ভারি বর্ষণ হয়েছে দেশজুড়ে।

বাগেরহাটে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে প্রায় ১০ হাজার বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। চট্টগ্রামে টানা বৃষ্টির ফলে হাঁটু থেকে বুক পরিমাণ পানিতে তলিয়ে যায় বেশিরভাগ এলাকা। পানিতে সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় গণপরিবহনের সংখ্যা একেবারেই কম। ফলে রিকশা ও সিএনজিতে অতিরিক্ত ভাড়া গুণতে হয়েছে যাত্রীদের। মূল সড়কগুলো হাঁটু থেকে কোমর কিংবা অনেক স্থানে বুক সমান পানিতে ডুবে যায়। সড়কের পাশের অধিকাংশ দোকান বন্ধ হয়ে যায়। অনেকের দোকান পানিতে তলিয়ে গেছে। নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শুভাশীষ চাকমা বলেন, নিঝুমদ্বীপসহ অন্যান্য এলাকার পানি কমতে শুরু করলেও তীব্র বাতাস ও ভারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। বেশ কিছু জায়গায় ঘরবাড়ি, গাছপালা, ফসলাদি, পুকুর, রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির সঠিক তথ্যাদি সংগ্রহ করা যায়নি। নোয়াখালী জেলা আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রবল ঘূর্ণিঝড় দুর্বল হয়ে পড়েছে। এটি বৃষ্টিপাতের পর স্থল নিম্নচাপে পরিণত হয়। কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানায়, ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে দেশের বিভিন্ন জেলায় ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন খুলনার লালচাঁদ মোড়ল, বরিশালের জালাল সিকদার, মো. মোকলেছ ও লোকমান হোসেন, সাতক্ষীরার শওকত মোড়ল, পটুয়াখালীর মো. শরীফ, ভোলার জাহাঙ্গীর, মাইশা ও মনেজা খাতুন এবং চট্টগ্রামের সাইফুল ইসলাম হৃদয়। খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলায় বসতঘরের ওপরে গাছ পড়ে মৃত গহর আলী মোড়লের ছেলে লাল চাঁদ মোড়ল (৩৬) মারা গেছেন। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মৃত নরিম মোড়লের ছেলে শওকত মোড়ল (৬৫) সাইক্লোন সেন্টারে যাওয়ার পথে অসুস্থ হয়ে মারা যান।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমালে ৩৭ লাখ ৫৮ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্যোগকবলিত মানুষের সাহায্যে কার্যক্রম শুরু করেছি। ক্ষতিগ্রস্তদের অনুকূলে ছয় কোটি ৮৫ লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে। যার মধ্যে ১৫টি জেলায় জিআর (ক্যাশ) তিন কোটি ৮৫ লাখ নগদ টাকা, পাঁচ হাজার ৫০০ টন চাল, পাঁচ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, শিশুখাদ্য কেনার জন্য এক কোটি ৫০ লাখ ও গোখাদ্য কেনার জন্য এক কোটি ৫০ লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় এ কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন, বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, সিপিপিসহ অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন এবং ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতায় আমরা এ দুর্যোগ মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছি বলে মনে করেন মহিববুর রহমান।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণের তথ্যানুযায়ী খুলনা, সাতক্ষীরা, বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা ও চট্টগ্রামে মোট ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া, মোট ১৯টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলাগুলো হলো, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা, ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর ও যশোর। ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলার সংখ্যা ১০৭ এবং ইউনিয়ন ও পৌরসভার সংখ্যা ৯১৪। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৩৭ লাখ ৫৮ হাজার ৯৬ জন। সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে ৩৫ হাজার ৪৮৩টি ঘরবাড়ি। আংশিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে এক লাখ ১৪ হাজার ৯৯২টি ঘরবাড়ি। ঘূর্ণিঝড় সতর্কবার্তার পরিপ্রেক্ষিতে উপকূলীয় এলাকাসমূহে ৯ হাজার ৪২৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্র ও স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আট লাখেরও বেশি লোক আশ্রয় নিয়েছে। গরু-মহিষ, ছাগল-ভেড়াসহ আশ্রিত পশুর সংখ্যা ৫২ হাজার ১৪৬টি।

উপকূলীয় অঞ্চলে রিমালের প্রভাবের পাশাপাশি রাজধানীজুড়েও সারা দিন বৃষ্টি হয়েছে। টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। ডুবে গেছে বহু সড়ক ও অলি-গলি। সেইসঙ্গে তৈরি হয় গণপরিবহন সংকট। রাজধানীর বাড্ডা, গ্রিনরোড, নিউমার্কেট, ধানমন্ডি ২৭, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, মিরপুর ১০, ১৩ ও ১৪ নম্বর, মালিবাগ, শান্তিনগর, সায়েদাবাদ, শনির আখড়া, পুরান ঢাকা, বংশাল, নাজিমুদ্দিন রোড, হাতিরঝিলের কিছু অংশ, আগারগাঁও থেকে জাহাঙ্গীর গেট যেতে নতুন রাস্তা, খামারবাড়ি থেকে ফার্মগেট, ফার্মগেট-তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকা, মোহাম্মদপুরের কিছু অংশ, মেরুল বাড্ডা, ডিআইটি প্রজেক্ট এলাকা, মোহাম্মদপুর, ইসিবি, গুলশান লেকপাড় এলাকার সংযোগ সড়ক এবং এসব সড়কের আশপাশের অলি-গলিতে পানি জমে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। সড়কে পানি জমায় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নানা বিড়ম্বনায় পড়েন কাজে বের হওয়া সাধারণ মানুষ। অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতার কারণে ভ্যান দিয়ে সড়ক পারাপার হতে দেখা গেছে নগরবাসীকে। একদিকে টানা বৃষ্টি, অন্যদিকে জলাবদ্ধতাণ্ড দুইয়ের যোগফল হিসেবে রাজধানীর সব সড়কেই কমে গেছে গণপরিবহন। এই সুযোগে বাড়তি ভাড়া আদায় করছেন ঢাকার রিকশা ও সিএনজিচালকরা।

গুলশানের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে একইসঙ্গে বাস সংকট। সেজন্য চরম দুর্ভোগে পড়েছিলাম। অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে রিকশাচালকরা। প্রথমে বাসা থেকে বের হয়ে ডাবল ভাড়ায় রিকশায় চড়ে শ্যামলীর মোড়ে এসেছি। পরে বাস না পেয়ে সিএনজিতে চড়ে কয়েকটি ডুবো রাস্তা পেরিয়ে গুলশানের অফিসে পৌঁছেছি। সিএনজি ভাড়া হওয়ার কথা সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা। সেই ভাড়া ৬০০ টাকা নিয়েছে। বৃষ্টিতে ভোগান্তিতে পড়েন প্রয়োজনে কাজে বের হওয়া এমন বহু মানুষ। মূল সড়ক ছাড়া অলিগলিতেও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় চলাফেরা করা কষ্টকর হয়ে পড়ে।

রাজধানীর ধানমন্ডি ২৭ থেকে কারওয়ান বাজার, এরপর হাতিরঝিল হয়ে বাড্ডা এলাকায় আসা সুজন আহমেদ নামে একজন বলেন, যে রাস্তা দিয়ে সিএনজিতে চড়ে এসেছি তার বেশিরভাগ সড়কেই জলাবদ্ধতা দেখেছি। পথে পথে মানুষের ভোগান্তি। পানির কারণে যানবাহন যাওয়ার পর ঢেউ আছড়ে পড়ছে ফুটপাতে। বাস না পেয়ে সিএনজিতে দ্বিগুণ ভাড়া দিতে হয়েছে। পল্টন, শান্তিনগর ও মালিবাগ মোড়ে রাস্তায় হাঁটু সমান পানির নিচে তালিয়ে যায়।