ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রিমালে তছনছ নাগরিকসেবা

বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ খাতে ব্যাপক ক্ষতি
রিমালে তছনছ নাগরিকসেবা

ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে নাগরিকসেবা তছনছ হয়ে পড়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলে বিদ্যুতের খুঁটি, তাঁর ও সড়ক ভেঙে পড়ায় নাগরিকদের চলার গতি থমকে দাঁড়িয়েছে। মানুষের একমাত্র থাকার সম্বল ঘরটিও ভেঙে গেছে। সুপেয় পানিরও চরম সংকট দেখা দিয়েছে। উপড়ে পড়েছে অসংখ্য গাছ। তবে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য দুর্যোগব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় যে সহযোগিতা করেছে, সেটিও চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। সবমিলে মানবেতর জীবনযাপন করছেন লাখো মানুষ।

ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় অঞ্চলের ছয় জেলায় অন্তত ১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তাদের বেশির ভাগই মারা গেছেন গাছচাপায় ও দেওয়াল ভেঙে পড়ে। ঘূর্ণিঝড়ে দেড় লাখ ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। পানি প্রবেশের বাঁধ ও সড়ক ভেঙে তলিয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম। ভেসে যায় মাছের ঘের। জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙে সাগরের লোনাপানি ঢুকে পড়েছে। সুপেয় পানির উৎসগুলো তলিয়ে যায়। গাছ উপড়ে পড়ায় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের খুঁটি ভেঙে বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন? হয়ে পড়েছে উপকূলীয় অঞ্চলে। বিদ্যুৎ না থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছেন, এসব এলাকার বাসিন্দারা। কয়েক কোটি মানুষ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন? হয়ে পড়েছেন। তবে ধীরে ধীরে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক সমস্যা দেখা দিয়েছে। মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটব জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ১৫ হাজার বেজ ট্র্যান্সিভার স্টেশন (বিটিএস, যা মোবাইল টাওয়ার নামে পরিচিত) গত সোমবার পর্যন্ত বন্ধ ছিল। মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক চালু করতে তারা কাজ করছেন। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় রিমালে ৬৪টি জেলায় ২২ হাজার ২১৮টি ওয়েবসাইট অসচল রয়েছে। অর্থাৎ দেশের মোট সাইটের প্রায় ৪৯ শতাংশই অসচল রয়েছে।

দুর্যোগব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য ৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা দিয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি জেলায় নগদ সহায়তার ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, ৫ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন চাল, ৫ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার, শিশুখাদ্য কেনার জন্য ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, গোখাদ্য কেনার জন্য ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।

দুর্যোগব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে ১৯ জেলার ১০৭টি উপজেলার বাসিন্দারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এসব এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৩৭ লাখ ৫৮ হাজারের বেশি। সম্পূর্ণভাবে বিধ?স্ত হয়েছে ৩৫ হাজার ৪৮৩টি ঘরবাড়ি। এছাড়া আংশিকভাবে বিধ?স্ত হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৯৯২টি ঘরবাড়ি। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতির মুখে পড়া ১৯ জেলা হলো সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা, ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর ও যশোর।

সড়ক ও বাঁধ ভাঙা : খুলনার পাইকগাছায় ছয়টি ইউনিয়নে প্রায় ২০টি স্থানে নদীর বাঁধ ভেঙেছে। এতে সাগরের লোনাপানিতে প্লাবিত হয় অর্ধশতাধিক গ্রাম। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন উপজেলার প্রায় ১ লাখ মানুষ। সুপেয় পানির উৎস তলিয়ে গেছে। কয়রা উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের কপোতাক্ষ নদের বাঁধ ও মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নে কয়রা নদীর বাঁধ জোয়ারের চাপে ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়ে। বাগেরহাটে অন্তত ১০ হাজার ঘরবাড়ি বিধ?স্ত হয়েছে। এ ছাড়া আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ৩৫ হাজার ঘরবাড়ি। মাছের কয়েক হাজার ঘের ভেসে গেছে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এএসএম রাসেল বলেন, প্রাথমিকভাবে জেলায় মাছের প্রায় ২২ হাজার ঘের তলিয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মোংলা, মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা ও রামপাল উপজেলায়।

পটুয়াখালীতে বেড়িবাঁধ ও আমখোলা ইউনিয়নের সুহরি এলাকার জলকপাটের সংযোগ সড়ক জলোচ্ছ্বাসের কারণে ভেঙে গেছে। ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ আছে। কক্সবাজারের মহেশখালী পৌর এলাকা, কুতুবজোম ও মাতারবাড়ী ইউনিয়নে কয়েকটি স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে নিমাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এ সময় জোয়ারের কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কয়েকশ’ কাঁচা ঘরবাড়ি। বন্ধ রয়েছে মাতারবাড়ী সড়ক যোগাযোগ।

ঘরবাড়ি ও ফসলের ক্ষতি : ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ঘরবাড়ি ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নোয়াখালীর হাতিয়ায় প্রায় ৫২ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাতিয়ার ইউএনও শুভাশিষ চাকমা বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে হাতিয়ায় ৫২ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হলো নিঝুম দ্বীপ। সেখানকার বেশির ভাগ কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জোয়ারের পানিতে পুরো নিঝুম দ্বীপ চার-পাঁচ ফুট পানিতে তলিয়ে যায়। ঝালকাঠিতে দুই শতাধিক গাছপালা ভেঙে পড়েছে। জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন শতাধিক গ্রামের মানুষ। ঘূর্ণিঝড় রিমাল মানুষের পাশাপাশি বন্যপ্রাণির ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। জলোচ্ছ্বাসে টানা প্রায় ৩০ ঘণ্টা পানিতে নিমজ্জিত ছিল সুন্দরবন। গতকাল সুন্দরবনের বিভিন? এলাকা থেকে ২৬টি হরিণের মরদেহ উদ্ধার করেছে বন বিভাগ। এ ছাড়া বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার বলেশ্বর নদে ভেসে আসা তিনটি হরিণের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কয়েক কোটি মানুষ বিদ্যুৎবিচ্ছিন? হয়ে পড়েছেন। তবে ধীরে ধীরে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করতে কাজ করছে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা। গত সোমবার সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) প্রায় ২ কোটি ৭০ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়েন। এর মধ্যে ৩ লাখ ২১ হাজার সংযোগ আবার দেওয়া হয়েছে। ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) ৪ লাখ ৫৩ হাজার ৮১টি সংযোগ বিদ্যুৎ সুবিধার বাইরে ছিল, ধীরে ধীরে বিদ্যুৎ স্বাভাবিক হচ্ছে।

বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, আরইবির ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মধ্যে ৬৫টি সমিতির আওতায় আংশিক বা পুরোপুরি বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ যায়। এর মধ্যে ৩০টি সমিতির আওতায় বিদ্যুতের ২ হাজার ৭১৮টি খুঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২ হাজার ৩৬৩টি ট্রান্সফরমার বিনষ্ট হয়েছে, ইনসুলেটর ভেঙে ২২ হাজার ৮৮৬টি, মিটার বিনষ্ট হয়েছে ৫৩ হাজার ৪৬৫টি। এ ছাড়া স্প্যান (তার ছেঁড়া) হয়েছে ৭১ হাজার ৮৬২টি পয়েন্টে। সার্বিকভাবে প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতি ৯১ কোটি ২০ লাখ টাকা। ওজোপাডিকোর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকার। বিদ্যুতের খুঁটি নষ্ট হয়েছে ২০টি, হেলে পড়েছে ১৩৫টি, তার ছিঁড়ে গেছে প্রায় ২৪ কিলোমিটার। এ ছাড়া ট্রান্সফরমার বিনষ্টসহ অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রসঙ্গত, ঘূর্ণিঝড় রিমাল গত রোববার রাত আটটার দিকে মোংলার দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ উপকূল ও বাংলাদেশের খেপুপাড়া উপকূল অতিক্রম শুরু করে। সবচেয়ে বেশি ১১১ কিলোমিটার গতিবেগে বাতাস বয়ে যায় পটুয়াখালীর খেপুপাড়ায়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত