উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

রোহিঙ্গাদের নিয়ে আশঙ্কার কিছু আলামত দেখা যাচ্ছে

প্রকাশ : ০১ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার, উখিয়া প্রতিনিধি

মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের নিয়ে আগে থেকে করা আশঙ্কার কিছু কিছু আলামত দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেছেন, মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত এসব রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। আমরা আগে থেকে বলে আসছিলাম এদের দ্রুত সময়ের মধ্যে স্বদেশ মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো না গেলে এখানে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। এখানে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের হাব তৈরি হতে পারে। অস্ত্রের ঝনঝনানি হতে পারে। অনেক কিছুই হতে পারে। এই হতে পারার মধ্যে কিছু কিছু আলামত আমরা দেখতে পাচ্ছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে যারা যুদ্ধ করছে তাদের কয়েকজনের আনাগোনা এখানে (রোহিঙ্গা ক্যাম্পে) দেখা যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় ভয়ের বিষয় হচ্ছে আমাদের দেশ কোনো মাদক উৎপাদন করে না। কিন্তু মিয়ানমার থেকে মাদক আসছে অনেক আগে থেকে। এখন ক্যাম্পের কিছু সংখ্যক লোক মাদকের সাথে জড়িয়ে গেছে। আমরা তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি। একই সঙ্গে অস্ত্র ও খুনে জড়িতদেরও চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। এদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নেয়ায় আমাদের মূল কাজ।

গতকাল শুক্রবার কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এসব কথা বলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সকাল ১১টায় উখিয়ার ১৯ নম্বর ঘোনার পাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এপিবিএন কার্যালয়ে যান। ওখানে সোয়া ১২টা পর্যন্ত সভা করেন এপিবিএন কর্মকর্তারদের সাথে। এরপর পরই কথা বলেন সাংবাদিকদের সাথে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ সময় সাংবাদিকদের বলেন, আজ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এসে নিরাপত্তা নিয়োজিত এপিবিএনের সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে তাদের চ্যালেঞ্জসমুহ জেনেছি। জেনেছি তাদের সুবিধা-অসুবিধাসমুহ। তাদের বলেছি বাংলাদেশ একটি ইতিহাস সৃষ্টি করেছে জঙ্গি-সন্ত্রাস দমনের মধ্য দিয়ে। এপিবিএন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা দিয়ে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার সহযোগিতা করছেন। এপিবিএন তাদের দায়িত্ব পালন করছেন বলেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ এবং নিয়ন্ত্রিত।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমারের কথা ও কাজে মিল নেই বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ফেরত পাঠানো নিয়ে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। মিয়ানমার একটি অস্থিরশীল দেশ। ওখানে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা। বিভিন্ন সময় মিয়ানমারের সাথে রোহিঙ্গা ফেরত নিয়ে নানা চুক্তি বা সমঝোতায় স্বাক্ষর হলেও তা মিয়ানমারের কারণে অগ্রগতি হয়নি। আশা করি মিয়ানমার দ্রুত সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবেন।

এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গা ক্যাম্পটির এ-৭ ব্লকের পাহাড়ি এলাকা পরিদর্শন করেছেন। ওখান থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যান টেকনাফে। ওখানে বিজিবি সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করেন তিনি।

পরিদর্শনকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান, এপিবিএন প্রধান সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক আনোয়ার হোসেন, পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি নুরেআলম মিনা, ৮ এপিবিএনের অধিনায়ক মো. আমির জাফর, ১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক মো. ইকবাল, ১৬ এপিবিএনের অধিনায়ক হাসান বারীসহ সংশ্লিষ্ট আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊধ্বর্তন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল কক্সবাজার হিলটপ সার্কিট হাউসে ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন। সভায় তিনি বলেন, শুধু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ নয়; সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে কঠোর হচ্ছে সরকার। ক্যাম্পের নিরাপত্তা বেষ্টনী কাঁটাতারের বেড়া কেটে ফেলা দুইশ’র বেশি অংশ দ্রুত মেরামতের নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

তিনি বলেন মিয়ানমারের রাখাইনে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকার আর্মির তুমুল লড়াই হচ্ছে। যার কারণে অস্থিরতা বিরাজ করছে সীমান্তে। অনেক রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের গ্রামগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারের এই সংঘাতের আঁচ এসে পড়ছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে। এদিকে ক্যাম্পের পাশে পাহাড়গুলোতে মিয়ানমারের সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো মজুত করছে ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ আর অন্যদিকে অস্থিরতা তৈরিতে বাড়ছে খুনকারাবি।

বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি এবং কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাদের এই সংঘাতে অস্থিরতার আঁচ এসে পড়ছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে। সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, মিয়ানমার থেকে আর কাউকে ঢুকতে দেয়া হবে না। আর এদিক থেকেও কাউকে যেতে দেয়া হবে না। এটা নিয়ে কঠোর অবস্থানে থাকবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩২টি ক্যাম্পে বসবাস করছে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। যাদের নিরাপত্তার জন্য দেয়া হয়েছিল কাঁটাতারের বেড়া। কিন্তু সেই কাঁটাতারের দু’শোর বেশি অংশ কেটে ফেলে অবাধে ক্যাম্প ছাড়ছে রোহিঙ্গারা। তাই কাঁটাতারের বেড়া কেটে ফেলা দুইশ’র বেশি অংশ দ্রুত মেরামতের নির্দেশও দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রয়েছে অস্ত্রের ঝনঝনানি। বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়েছে। যারা ক্যাম্পে নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত করছে। কিন্তু ক্যাম্পে এসব আর চলবে না। নিয়মিত ক্যাম্পে টহল চলবে। যেখানে এপিবিএন, পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাব একসঙ্গে যৌথ টহল দিবে। আর সবসময় প্রস্তুত সেনাবাহিনী। যখন জরুরি প্রয়োজন পড়ে তখন সেনাবাহিনীও কাজ করে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আরও বলেন, মূল উদ্দেশ্য হলো ক্যাম্পকে নিরাপদ করা। এখানে খুন-কারাবি, রক্তপাত এসব চলবে না। সেজন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বলা হয়েছে যৌথভাবে কাজ করবে। আর ক্যাম্পে থেকে রোহিঙ্গা যাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে না পারে তার জন্য কেটে ফেলা কাঁটাতারের বেড়াগুলো সংস্কার ও দ্রুত মেরামতের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদের হুইপ সাইমুম সরওয়ার কমল, সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক, পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান, এপিবিএন প্রধান সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক আনোয়ার হোসেন, ৮ এপিবিএনের অধিনায়ক মো. আমির জাফর, ১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক মো. ইকবাল, ১৬ এপিবিএনের অধিনায়ক হাসান বারী, জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান, পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলামসহ সংশ্লিষ্ট আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।