রাজপথ থেকে খেলার মাঠে বিএনপি!

প্রকাশ : ০২ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আমিরুল ইসলাম অমর

সরকার পতন আন্দোলনে বারবার ব্যর্থ হওয়া বিএনপি এবার রাজপথের আন্দোলন থেকে খেলার মাঠে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। দলের ১০টি সাংগঠনিক বিভাগে ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে যাচ্ছে দলটি, যা শিগগিরই শুরু হতে যাচ্ছে। বারবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসা বিএনপি দুর্দিন অতিক্রম করতে পারছে না। ২০০৬ সালের ২৮ আগস্ট রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের হাতে ক্ষমতা দেয়ার পর বিএনপির দুর্দিন শুরু হয় মূলত ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারি হলে। ওই বছরের ২২ জানুয়ারি দেশ যখন একতরফা ভোটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন ১১ দিন আগে ইয়াজউদ্দিন আহমেদ জরুরি অবস্থা জারি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব তুলে দেন ফখরুদ্দীন আহমেদের হাতে। এর দুই বছর পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে যে নির্বাচন হয় তাতে ভরাডুবি হয় বিএনপির। এরপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে নামে বিএনপি ও তার জোট। সেই আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ার এক বছর পর ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে ফের সরকার পতনের আন্দোলনে নামে তারা। তখন দলটি টানা তিন মাস আন্দোলন করে। যদিও আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় সেই আন্দোলন প্রত্যাহার না হলেও তা একপর্যায়ে অকার্যকর হয়ে যায়।

এরপর ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি তার আগের জোটের সঙ্গে নতুন শক্তি বৃদ্ধি করে অংশ নেয়। কিন্তু ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে খারাপ ফলাফল করে। সেই নির্বাচনে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া নিয়ে অভিযোগ এনে বিএনপি আবার নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে ফিরে যায়। দলীয় সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে আন্দোলনে নামে বিএনপি। সেই আন্দোলনেও ব্যর্থ হয় দলটি। এবারের নির্বাচন ছিল দলটির ঘুরে দাঁড়ানোর চ্যালেঞ্জ। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, এই নির্বাচন বিএনপিকে আরো বেশি অস্তিত্বের সংকটে ফেলেছে। বিএনপির নেতাকর্মীরা আশা করেছিল, এবার হয়তো পটপরিবর্তন হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। আবারও আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় এসেছে। দ্বাদশ নির্বাচনের পর দলটি এখনো বড় কোনো আন্দোলনে নামতে পারেনি। সম্প্রতি দলটির সিনিয়র নেতাদের বক্তব্য বা কথায় সরকার পতন আন্দোলনের ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকটা রাজপথের আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে এখন রুটিন ওয়ার্ক কর্মসূচি পালন করছে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি। এরই মধ্যে দলটি রাজপথের আন্দোলন থেকে খেলার মাঠে সম্পৃক্ত হচ্ছে।

সূত্র মতে, দেশের ১০টি সাংগঠনিক বিভাগে ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে যাচ্ছে বিএনপি। আগামী ৭ জুন (সম্ভাব্য) বগুড়ায় রাজশাহী বিভাগের খেলা উদ্বোধনের মাধ্যমে টুর্নামেন্ট শুরু হবে। আগামী ১২ আগস্ট ঢাকায় হবে ফাইনাল পর্বের খেলা। এই টুর্নামেন্টের নাম দেওয়া হয়েছে ‘আরাফাত রহমান কোকো স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট-২০২৪’। মূলত বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর স্মৃতির প্রতি সম্মানার্থে ব্যতিক্রমী এবং অরাজনৈতিক এই উদ্যোগ নিয়েছে দলটি। প্রসঙ্গত, ১২ আগস্ট কোকোর ৫৫তম জন্মবার্ষিকী। জানা গেছে, ‘ক্রীড়াই শক্তি, ক্রীড়াই বল মাদককে না বলুন’- এই স্লোগানে সারা দেশে বিভাগীয় পর্যায়ে আরাফাত রহমান কোকো স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট-২০২৪ অনুষ্ঠিত হবে। টুর্নামেন্ট সফলের লক্ষ্যে প্রস্তুতি সভা করছেন পরিচালনা কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। টুর্নামেন্ট সফল করার লক্ষ্যে সম্প্রতি ২৩ সদস্যের একটি পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ (বীরবিক্রম)। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে আছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। এছাড়া বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল কমিটির আহ্বায়ক এবং ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক আমিনুল হক কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে আছেন। টুর্নামেন্ট সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রত্যেক বিভাগে দুটি করে দল প্রীতি ফুটবল খেলায় অংশগ্রহণ করবে। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণে পৃথক দুটি টিম গঠন করা হবে। প্রতি বিভাগের সংশ্লিষ্ট জেলা থেকে খেলোয়াড় বাছাই করে লাল দল এবং সবুজ দল নামে দুটি করে টিম গঠন করা হবে। এরপর বিভাগ পর্যায়ে খেলা শুরু হবে। বিভাগ পর্যায়ে বিজয়ী দল আগামী ১২ আগস্ট ঢাকায় ফাইনাল রাউন্ডে অংশ নেবে। খুব দ্রুত খেলার সময়সূচিসহ বিভিন্ন বিষয় চূড়ান্ত করা হবে।

রংপুর, রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, বরিশাল, খুলনা ও ফরিদপুর- এই আট সাংগঠনিক বিভাগে খেলা অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণে পৃথক দুটি টিম গঠন করা হবে।

ফুটবল টুর্নামেন্ট পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক হাবিব উন নবী খান সোহেল বলেন, আজকে বাংলাদেশে ক্রিকেটের যে উন্নয়ন তার ভিত্তি রচনা করেছিলেন কোকো। টুর্নামেন্টের সদস্য সচিব আমিনুল হক বলেন, কোকোর স্মৃতি অম্লান রাখা এবং তার সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে জানাতে সারা দেশে বিভাগ পর্যায়ে ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হচ্ছে।

এদিকে, নির্বাচন-পরবর্তী বড় কোনো আন্দোলন কর্মসূচী পালন না করে বিএনপি ১০টি সাংগঠনিক বিভাগে ফুটবল টুর্নামেন্ট ঘোষণা করায় দলের ভিতরে-বাহিরে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। কেউ কেউ বলছেন, সরকার পতনের আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি এখন সাংগঠনিক তৎপরতা ও জনসংযোগ বাড়াচ্ছে। আবার কেউ কেউ এও বলেছে, আন্দোলনের ব্যর্থতা ঢাকতেই দলটি ফুটবল টুর্নামেন্টের ঘোষণা দিয়ে রাজপথ থেকে খেলার মাঠের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।

মধ্যম সারির কয়েকজন নেতার সাথে কথা হলে তারা এ বিষয়ে বলেন, আমরা বারবার সরকার পতন আন্দোলনে ব্যর্থ হচ্ছি। এখনো দলের অনেক নেতাকর্মী কারাগারে আছেন। অধিকাংশ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। অনেকে মামলা চালাতে চালাতে নিঃস্ব হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে রাজপথে জোরদার আন্দোলন না করে ফুটবল টুর্নামেন্টে মনোযোগ দেয়া কতটা যুক্তিযুক্ত হবে আমরা বুঝতে পারছি না। তবে, এতটুকু বলতে পারি, এখন আমাদের সাংগঠনিক শক্তি বাড়িয়ে কঠোর আন্দোলনের দিকে যাওয়া উচিত।

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক বিএনপির এক নেতা বলেন, ফুটবল টুর্ণামেন্টের কথা শুনেছি। তবে, এই মুহূর্তে এমন খেলার আয়োজন কতটা ফলপ্রসূ হবে আমি বুঝতে পারছি না। হয়তো এটি দলের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করার লক্ষেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুুদু আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, এটিও আমাদের আন্দোলন কর্মসূচির একটি অংশ। এর মাধ্যমে সাংগঠনিকভাবে দলকে চাঙা করে ও জনসম্পৃক্ত বাড়িয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন আরো বেগবান করতে হবে।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, আমাদের আন্দোলন কর্মসূচি অব্যাহত আছে। প্রতিনিয়ত আমরা কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছি। মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর জন্মদিন উপলক্ষ্যে এই ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হচ্ছে। সামাজিক প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে এই চলছে। আমরা ঈদ, পূজাসহ নানা উৎসব পালন করে থাকি। আন্দোলনের জন্য তো আর সেগুলো থেমে থাকে না।

তিনি বলেন, এখানো আমাদের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। আবার অনেকে জামিনে বেড়িয়েও আসছে। এরই মধ্যে আমরা আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছি। যতদিন এই সরকারের পতন না হবে ততদিন আমাদের আন্দোলন কর্মসূচি চলবে।