বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

প্রকাশ : ০৩ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

বাংলাদেশে গতকালও মাঝারি মাত্রার একটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। বাংলাদেশ ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র জানায়, মিয়ানমারে মাঝারি মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছে, যা অনুভূত হয়েছে বাংলাদেশের রাঙামাটি জেলায়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ৫। গতকাল দুপুর ২টা ৪৪ মিনিট ৫৯ সেকেন্ডে এ ভূমিকম্প অনুভূত হয় বলে জানিয়েছেন ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের সহকারী আবহাওয়াবিদ ফারজানা সুলতানা। তিনি জানান, মিয়ানমারে ৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্প আঘাত করেছে, যা অনুভূত হয়েছে বাংলাদেশের রাঙামাটি জেলাতেও। ঢাকা থেকে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ৪৪২ কিলোমিটার দূরে। এর আগে গত ২৯ মে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫.৪। তার আগে গত ২৮ এপ্রিল বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চল এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। রাত ৮টা ৫ মিনিটে এ ভূমিকম্প হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তমপুরে ভূমিকম্পটির উৎপত্তি হয়। এর মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৪। হালকা ভূমিকম্প হওয়ায় ওই সময় কোনো ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া যায়নি। এর আগে ২০ এপ্রিল চট্টগ্রামে মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ৩.৭ মাত্রার একটি মাঝারি ভূমিকম্প বন্দরনগরী থেকে ৪৩ কিলোমিটার দূরে আঘাত হানে। মৃদু ভূমিকম্পটির অবস্থান ছিল ভারত সীমান্ত থেকে ৩৪ কিলোমিটার ও মিয়ানমার থেকে ৬৬ কিলোমিটার দূরে। ভূমিকম্পের কেন্দ্রে এর গভীরতা ছিল ১০ কিলোমিটার। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টা ৭ মিনিটে মৃদু ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে চুয়াডাঙ্গা। চুয়াডাঙ্গার প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক রাকিবুল হাসান ওই সময় জানান, রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৩.৬। এর উৎপত্তিস্থল পাবনা জেলার আটঘরিয়া। ওই ভূমিকম্পে কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ পাওয়া যায়নি। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ১১টি হালকা ও মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে। এতে জানমালের তেমন ক্ষতি না হলেও বড় ধরনের ভূমিকম্পের আভাস পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। সেই বছর প্রথম ভূকম্পন অনুভূত হয় ১৬ ফেব্রুয়ারি। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মেঘালয়ের পাশাপাশি কেঁপে ওঠে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট জেলাও। ৩ দশমিক ৯ মাত্রার এ ভূমিকম্পে জানমালের তেমন ক্ষতি হয়নি।

২৫ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে মাঝারি মাত্রার জোড়া ভূমিকম্প আঘাত হানে। দেশটির আয়াবতি ও রাখাইন রাজ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের কক্সবাজারেও ভূকম্পন অনুভূত হয়। ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার আগারগাঁও থেকে ৩৭৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ১। চট্টগ্রামে ৩০ এপ্রিল ৪ দশমিক ৬ মাত্রার কম্পন অনুভূত হয়। এর উৎপত্তিস্থল অক্ষাংশ ২২ দশমিক ৯৩ ডিগ্রি উত্তর, দ্রাঘিমা ৯৪ দশমিক ১৯ ডিগ্রি পূর্ব মিয়ানমারের মাউলাইকে। রাজধানীর ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এর দূরত্ব ছিল ৪০০ কিলোমিটার। ৫ মে রাজধানীতে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৩। উৎপত্তিস্থল ঢাকার সিটি সেন্টার থেকে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে দোহারে। ৫ জুন ৩ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে বঙ্গোপসাগরে। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল মিয়ানমারের কাছে বঙ্গোপসাগরের তলদেশে। ১৬ জুন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভূকম্পন অনুভূত হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেটের গোলাপগঞ্জ, মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৫। এরপর ১৪ আগস্ট সিলেটে ফের ৫.৫ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। একই সঙ্গে ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায়ও এটি অনুভূত হয়। উৎপত্তিস্থল ছিল আসামের মেঘালয়, গভীরতা ছিল ৩৫ কিলোমিটার। ঢাকা থেকে উৎপত্তিস্থলের দূরত্ব ২২৮ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে। ঠিক ১৬ দিনের মাথায় অর্থাৎ ২৯ আগস্ট সিলেট মহানগরীর আশপাশে ফের মৃদু কম্পন অনুভূত হয়। এর মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৫। উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের মেঘালয় রাজ্যের জৈন্তাপুরে। ৯ সেপ্টেম্বর ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আসাম রাজ্যে ৪ দশমিক ৪ মাত্রার মৃদু ভূমিকম্প আঘাত হানে। আসামে আঘাত হানা ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে বাংলাদেশের সিলেট জেলাও। ঢাকা থেকে উৎপত্তিস্থলের দূরত্ব ২৬৩ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে ভারতের আসামের কাছাকাছি। ১৭ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলে ৪.২ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৫৯ কিলোমিটার দূরে টাঙ্গাইল সদরে। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৫ কিলোমিটার গভীরে ছিল এর অবস্থান। ২০২৩ সালে সর্বশেষ ২ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকাসহ দেশে বিভিন্ন জেলায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫.৫। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল কুমিল্লা ও লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ। ঢাকার আগারগাঁও ভূমিকম্প গবেষণা কেন্দ্র থেকে উৎপত্তিস্থলের দূরত্ব ৮৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫.৬। গত বছর ১১ বার ভূমিকম্প হয়েছিল, যেখানে সর্বোচ্চ মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৬। ভূমিকম্পের ঘটনাগুলো মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। তবে এসব ভূমিকম্পে তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হলেও বড় মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। গত বুধবার বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের সহকারী আবহাওয়াবিদ ফারজানা সুলতানার দেওয়া তথ্যে বলা হয়, ওই দিন ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৫ রিখটার স্কেল। আর ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল মিয়ানমারের মাওলাইক। ঢাকার আগারগাঁও ভূমিকম্প গবেষণা কেন্দ্র থেকে উৎপত্তিস্থলের দূরত্ব ৪৩৯ কিলোমিটার ছিল। ২০২১-২৫ সালের বাংলাদেশ জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় বলা হয়- বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে সারা দেশে ৬ কোটি ১২ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর ফলে ১১ রাখ ৯ হাজার পাকা ভবন, ২১ লাখ ১৪ হাজার সেমিপাকা ভবন ৪০২টি খাদ্য গুদাম, ১৪টি গ্যাসফিল্ড, ১৯৫টি হাসপাতাল, ১ হাজার আটটি কল্যাণ কেন্দ্র, ২ হাজার ৮০০ উচ্চবিদ্যালয়, ১ হাজার ৯০০ মাদ্রাসা, ১৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৬ হাজার ৮০০ পুলিশ স্টেশন, ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক, ৭ হাজার ৪০০ কিলোমিচার স্থানীয় সড়ক, ২০ হাজার সেতু এবং ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ভৌগোলিক অবস্থার দিক থেকে ভূ-কম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। কয়েক বছর ধরে দেশে মৃদু এবং মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানছে। এসবের উৎপত্তিস্থলও খুব দূরে নয়, দেশের অভ্যন্তরে অথবা খুব কাছাকাছি কোথাও। বাংলাদেশের মাটির নিচে ভূমিকম্পের দুটি বড় উৎস আছে। তার মধ্যে ডাউকি চ্যুতি একটি। আর এখানে একের পর এক ভূমিকম্প হচ্ছে কয়েক বছর ধরেই। কিন্তু ভূমিকম্পের তেমন কোনো পূর্বাভাসের ব্যবস্থা নেই। ডাউকি চ্যুতি মেঘালয়ের মালভূমির নিচ দিয়ে গিয়ে হিমালয়ান থ্রাস্ট ফল্টের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এই ফাটলতলের ওপর মেঘালয়ের দুই কিলোমিটার উঁচু মালভূমি অবস্থিত। বর্তমানে ডাউকি ফল্টের পূর্ব প্রান্ত বাংলাদেশের ভূমিকম্পের প্রধান উৎসের একটি। আরেকটি উৎস সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সাবডাকশন জোন। এটি ভূমিকম্পের সবচেয়ে বড় উৎস। এখানে প্রচুর পরিমাণ শক্তি জমা হয়ে আছে। সেই শক্তির পরিমাণ ৮ দশকি ২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের শক্তির সমান। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) এক সমীক্ষায় বলা হয়, ঢাকা ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে। টাঙ্গাইলের মধুপুরে মাটির নিচে যে চ্যুতিরেখা বা ফল্টলাইন রয়েছে, সেখানে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় ৮ লাখ ৬৫ হাজার ভবন ধসে পড়বে। দিনের বেলায় এ ভূমিকম্প হলে মারা যাবেন ২ লাখ ১০ হাজার মানুষ, আহত হবেন ২ লাখ ২৯ হাজার। বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে এক গবেষণায় দেখা গেছে, সিলেটের ফল্ট লাইনে দিনের বেলা ৭ দশমিক ১ মাত্রার একটি ভূমিকম্প সংঘটিত হলে কমপক্ষে ৪০ হাজার ৯৩৫ ভবন ধসে পড়তে পারে। ১৬ হাজার মানুষের প্রাণহানি হতে পারে। আর্থিক ক্ষতি হবে প্রায় ৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা সমমূল্যের। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী মনে করেন, ছোট ও মাঝারি ভূকম্পনে বড় শক্তি বের হওয়ার একটা প্রবণতার লক্ষণ দেখা গেছে। তার মানে, যে কোনো সময় একটি বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে। তবে এই বড় ভূমিকম্প কবে হবে, সেটা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক তত্ত্বাবধায়ক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার জানান, ভূমিকম্পে ঢাকা, পার্বত্য চট্টগ্রাম, রংপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা ও দিনাজপুর অঞ্চলই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের মেঘালয়, আসাম, মনিপুর, মিজোরাম এবং মিয়ানমার সীমান্তের কাছে রিখটার স্কেলে ৭ এর বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা হবে ভয়াবহ। উল্লেখ্য, গত ২০০ বছরে বাংলাদেশে আটটি বড় ধরনের ভূমিকম্পের মধ্যে ১৮৮৫ সালের বেঙ্গল ভূমিকম্প উল্লেখযোগ্য। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন রিখটার স্কেলের ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ১, যা সর্বোচ্চ ১০ মাত্রায় পৌঁছে। এ ভূমিকম্পে ব্যাপক সম্পদহানি ছাড়াও মৃত্যুবরণ করে ১ হাজার ৫৪২ জন মানুষ। ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই। বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটির পর্যবেক্ষণ অনুসারে, ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৪ মাত্রার ১১৫টি এবং ৫ মাত্রার ১০টি ভূমিকম্প অনুভূত হয়।