টিআইবির সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের বৈঠক

* ৭ জানুয়ারি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হয়েছে নিজেদের মধ্যে : টিআইবি * প্রকট বৈরিতা রাখলে দলগুলোর সামনে এগিয়ে যাওয়া কঠিন : সিইসি

প্রকাশ : ০৩ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বৈরিতা অত্যন্ত প্রকট। এটি ধরে রাখলে সামনে এগিয়ে যাওয়া কঠির হবে বলে মনে করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, সবার সহযোগিতা ছাড়া নির্বাচন কমিশন একা কখনোই ভোট সুষ্ঠু করতে পারবে না।

গতকাল নির্বাচন ভবনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ও তার কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সিইসি এসব কথা বলেন।

নির্বাচনের পর টিআইবির সঙ্গে বড় পরিসরে আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল ইসি। যে কারণে সংস্থাটিতে তারা আমন্ত্রণ জানায়। এর আগে দুই পক্ষে স্বল্প বার্তালাপ হচ্ছিল। ইসি ভবনে গতকাল পুরো কমিশন টিআইবির সঙ্গে বৈঠক করে বলে জানান ইসি প্রধান।

কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, তাদের মূল দাবিটা ছিল আমরা যেন দ্রুত তথ্যটা দিই। তারা তথ্যের অবাধ প্রবাহ চাচ্ছেন। যে কোনো তথ্য যেন আমরা ওয়েবসাইটে তুলে দিই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওনারা বলেছেন, আমাদের দায়িত্ব হয়তো কিছুটা পালন করছি না। আমরা বলেছি সেটা, আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে। যেমন হলফনামায় কে কী সম্পত্তির বিবরণ দিল, সেটা আমাদের কাছে থাকবে, বা আপলোড করে দিচ্ছি। যে কেউ তথ্য নিতে পারেন, দুদক নিতে পারে। আমরা সহযোগিতা করব। আমাদের বলা হয়নি তাদের স্টেটমেন্ট বিশ্লেষণ করে পদক্ষেপ নিতে। কোনো কর্তৃত্ব বা দায়িত্ব আমাদের দেওয়া হয়নি।

নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ করা নিয়ে তিনি বলেন, টোটাল নির্বাচনি ব্যবস্থা নিয়ে কথা হয়েছে। নির্বাচনটা অংশগ্রহণমূলক হয়নি। তবে ফেয়ার হয়েছে। একটা দক্ষতার অভাব রয়েছে। সেটা ওনারা জোর দিয়ে বলেছেন। আমরা বলেছি, আমাদের কাজ হচ্ছে নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ করা। আমরা বলেছি, সমস্যা অনেকটাই রাজনৈতিক। রাজনৈতিক সমস্যা নিরসন না হলে, নির্বাচন ব্যবস্থাটা আরও স্টেবল হবে না। পলিটিক্যাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেলে নির্বাচনটা আরও সুন্দর হতে পারে।

সাবেক এই আইন সচিব বলেন, পদ্ধতিগতভাবে যদি উন্নয়ন করা যায় ব্যক্তির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে; যেমন- একটা হচ্ছে ডিজিটাল ডিভাইস, আরেকটা হলো সিস্টেম অব ইলেকশন। আমরা বলেছি, ওনারাও বলেছেন প্রপোরশনাল বলে একটা সিস্টেম আছে। আনুপাতিক হারে সংসদে প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা, যেটা আমাদের সংসদে নারী আসনের ক্ষেত্রে আছে। সেই সিস্টেমের কথা আমরাও বলেছি, ওনারাও বলেছেন। আমরা বলেছি এগুলো নিয়ে আপনারা গবেষণা করতে পারেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসে যদি আপনারা বলতে পারেন ক্ষমতা থেকেও নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ করা যায়, যায় কি না সেটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যদি কোনো গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব পাস করতে পারেন, সংসদ থেকে, তাহলেও যে আপনারা বলছেন জনগণ অংশ নিচ্ছেন না, এগুলোও কমে আসবে। আর আমরা মনে করি, জাতীয় নির্বাচনটা যদি একাধিক দিনে করা যায়, তাহলে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা অনেক সহজ হয়ে যাবে। ভোটকেন্দ্রে অধিক সংখ্যক ফোর্স মোতায়েন সহজ হবে। মনিটরিংটা সহজ হবে।

ইভিএম নিয়ে সিইসি বলেন, বৈঠকে আরেকটা জিনিস বলেছি, আমাদের প্রযুক্তি ইভিএম নিয়ে অনাস্থা ছিল, এখনো আছে। আমারা এখনো বলছি, ইভিএমে যে নির্বাচনগুলো হয়েছে, আজ পর্যন্ত কেউ বলেনি যে, এখানের ভোট ওখানে চলে গেছে। আমরা এখন অনেক স্পষ্ট, এই মেশিনে সেটা একেবারেই অসম্ভব। তবে ইভিএমটাকে আরও সহজ করা যেতে পারে।

আস্থা ফেরা নিয়ে তিনি বলেন, মানুষের যদি আস্থা ফেরে তবে ভিভি প্যাডটা লাগিয়ে দেওয়া যায়। তবে এটা আমরা বলতে পারি না, যদি দলগুলো একমত হয়। তাহলে আমরাও এগ্রি করব। নির্বাচনটাও অধিক সুষ্ঠু হবে। এই প্রযুক্তিকে উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। আজকে না হলেও দশ বছর পরে, দশ হাজার বছর পরে হলেও এই সমস্ত প্রযুক্তি লাগবে। এটা আমরা বলেছি।

কাজী হাবিবুল আউয়াল আরও বলেন, আমরা সব অ্যাকশন নিই না। কিছু অ্যাকশন রিটার্নিং কর্মকর্তা নেন। হলফনামা বাছাই করবেন রিটার্নিং কর্মকর্তা, সে-ই নির্বাচন কমিশন। শত শত আপিল হয়, এখানে বাতিল হলে কোর্টে যায়, সেখানে ফিরে পায়। আবার আপিলে যায়। সেখানকার সিদ্ধান্তগুলো চ্যালেঞ্জ করি। আমাদের সীমিত সামর্থ্যে আমরা চেষ্টা করি। আমাদের যে অনন্ত সক্ষমতা আছে, সেটা মোটেই না। নির্বাচন কমিশন কখনো একা অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে না, যদি না রাষ্ট্র এবং সরকারের পলিটিক্যাল উইল সপক্ষে থাকে। রাষ্ট্রের যদি পলিটিক্যাল উইল সপক্ষে থাকে তাহলে প্রশাসন, পুলিশ, আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে বাধ্য।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা নিয়ে সিইসি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো কোনো আলাপ আলোচনা দেখছি না। তাদের মধ্যে বৈরিতা অত্যন্ত প্রকট। এতো প্রকট বৈরিতা নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি সিইসি নয়, এই প্রকট বৈরিতাটা রাখলে সামনে এগিয়ে যাওয়া খুব কঠিন হবে। এই বৈরিতা পরিহার করে আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। টিআইবিকে বলেছি, আপনাদের মতো আরও সিভিল সোসাইটি আছে, তারাও ভূমিকা পালন করতে পারেন।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, আমরা হয়তো আমাদের রিপোর্টে পরামর্শ রেখে যাব। আমরা তো চলেই যাব, পরবর্তী কমিশন যেন করতে পারে। সব দল বসেই তো ভারত ভাগ হলো। সেটা তো একদিনে হয়নি। এর আগে সিইসির সঙ্গে বৈঠক শেষে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হয়েছে, তবে সেটা নিজেদের মধ্যে।

তিনি বলেন, আমরা নির্বাচন কমিশনকে প্রস্তাব করেছি নির্বাচন ব্যবস্থা পরিবর্তন করা যায় কি না, সেক্ষেত্রে আমরা আনুপাতিক ভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব করার প্রস্তাব দিয়েছি। ইসিও আমাদের সাথে একমত হয়েছে।

এছাড়াও জাতীয় নির্বাচন কয়েক দফা করা যায় কি না সে বিষয়ে আমাদের আলোচনা হয়েছে। সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন আমাদের বলেছে যদি পাঁচ দফায় নির্বাচন করা যায় এবং ইভিএম ব্যবহার করা যায় তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব বলে তাদের ধারণা।

নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, নির্বাচন কমিশনের সাথে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়েও আমাদের আলোচনা হয়েছে। ২০০৮ সালে যেভাবে নির্বাচন হয়েছিল সেভাবে তো নির্বাচনের সম্ভাবনা আমরা আর দেখছি না। কারণ আমাদের সংবিধানও সাপোর্ট করে না। কিন্তু যেটা সম্ভব পৃথিবীর অনেক দেশেই আছে নির্বাচনকালীন সরকার, যার সমস্ত স্বার্থের দ্বন্দ্ব মুক্ত করে সবার অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করা। তবে এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে।

তিনি আরও বলেন, গণতন্ত্র, সুশাসন, জবাবদিহিতামূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমরা নির্বাচন কমিশনকে কয়েকটি প্রতিবেদন দিয়েছি। এর মধ্যে একটি হলো সম্প্রতি শেষ হওয়া দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে আমরা যে পর্যবেক্ষণ করেছি সেই প্রতিবেদন। আরেকটি হলো নির্বাচনি হলফনামা, যেখানে প্রার্থীরা তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব দেয়।

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচন কমিশন আমাদের বলেছে, তারা একটি অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচন চায়, বলেছি আমরাও সেটি চাই। আমাদের মূল লক্ষ্য যেহেতু এক তাই আমাদের এই আলোচনা অব্যাহত রাখব।