ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সর্বত্র হিজড়া আতঙ্ক

সর্বত্র হিজড়া আতঙ্ক

হিজড়ার অপর নাম যেন আতঙ্ক। এরা রাস্তাঘাট, বাস-ট্রেন ও বাসাবাড়িতে যেখানে সেখানে মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা। বিশেষ করে ঢাকার রাস্তায় দিন দিন বাড়ছে হিজড়াদের উৎপাত। প্রায় প্রতিটি ট্রাফিক সিগন্যালে দলবেঁধে অবস্থান করে তৃতীয় লিঙ্গের এই মানুষরা। সিগন্যাল পড়লেই একদল রাস্তায় নেমে রিকশা, সিএনজি ও অটোরিকশা থেকে চাঁদা তুলে। অন্যদল উঠে পড়ে বাসসহ গণপরিবহনে। কেউ টাকা দিতে না চাইলে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল শুনতে হয়। অনেক সময় শারীরিকভাবেও লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। এদের সাথে ঝামেলায় যেতে চান না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। ফলে সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত হেনস্তার শিকার হচ্ছেন।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানীর গুলিস্থান, কাকরাইল, মৌচাক, শাহবাগ, কাওরান বাজার, বিজয় সরণি, ধানমন্ডি, বনানী, মিরপুর, উত্তরা, হাতিরঝিল এলাকায় ট্রাফিক সিগন্যালে হিজড়া সদস্যদের দৌরাত্ম্য বেশি। এমন চিত্র আগে থেকেই দেখা গেলেও সম্প্রতি এদের চাঁদাবাজির ধরনে পরিবর্তন এসেছে। টার্গেট করে সিএনজি, রিকশা, এমনকি প্রাইভেট কার আটকে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করছে। কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ চাঁদা না পেলে হয়রানি করা হচ্ছে। এতে আতঙ্কিত সাধারণ মানুষ।

সূত্রমতে, ইদানীং রাস্তায় হিড়াদের উপস্থিতি বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে শুধু রাস্তায় নয়, বাসাবাড়িতেও হানা দিচ্ছে হিজড়া সদস্যরা। কারও বিয়ে বা সন্তান হওয়ার খবর শুনলে তারা দলবেঁধে হানা দিচ্ছে বাসাবাড়িতে। খেয়ালখুশিমতো নিচ্ছে চাঁদা। চাহিদামতো টাকা দিতে না চাইলে জিম্মি করছে পরিবারের সদস্যদের।

ভুক্তভোগী একজন বলেন, ‘হঠাৎ একদল হিজড়া আমার বাসায় এসে বলে, আপনাদের বাসায় বাচ্চা (নবজাতক) আছে। আমাদের কোনো ছোট বাচ্চা নেই শুনে ছয়-সাতজন হিজড়া বাসায় ঢুকে প্রতিটি রুম তছনছ করে। তারা অকথ্য ভাষায় গালাগালসহ এমন উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে, যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। পরে তারা পাশের ফ্ল্যাটগুলোয় ঢোকার চেষ্টা করে। তাদের ব্যবহার ও কর্মকাণ্ড অস্ত্রধারী ডাকাতদের থেকেও ভয়ংকর ছিল।’ কোনো বাসায় শিশুর জন্মের খবর পেলেই হিজড়ারা চাঁদা দাবি করছে বলে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা অভিযোগ করছেন। সরেজমিন ঘুরে মোহাম্মদপুর এলাকায় এরকম বেশ কয়েকটি ঘটনা জানা গেছে। চাঁদা না পেয়ে হিজড়ারা পরিবারের সদস্যদের লাঞ্ছিত করেছে বলেও ভুক্তভোগীরা জানান। পুরান ঢাকার আলমগীর হোসেন বলেন, মাস খানেক আগে আমার একটা ছেলে সন্তান জন্ম নেয়। আমি অফিসে থাকা অবস্থায় ফোন আসে বাসায় হিজড়া এসেছে। অফিস থেকে দ্রুত বাসায় ফিরে যাই। অনেক বাড়াবাড়ির পর পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বিদায় করতে হয়েছে তাদের।

ইদানীং দেখা যাচ্ছে, কিছু ‘নকল’ হিজড়া যারা মূলত পুরুষ; অথচ হিজড়া সেজে বাড়ি বাড়ি চাল ও টাকা আদায় করছে। তাদের কাজে কেউ বাধা দিলে তারা অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করে প্রকাশ্যেই কাপড়-চোপড় খুলে ফেলার ভঙ্গি করে। এমনকি তাদের হাতে খুনের ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া নবজাতক ও শিশুদের জিম্মি করে অভিভাবকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। পুরুষ থেকে যারা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে হিজড়া হয়েছে; তারাই বেশি অত্যাচার করে থাকে। তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না? দেশে কি কোনো আইন নেই? এমন প্রশ্ন এখন অনেকের কাছেই।

গত বৃহস্পতিবার (৩০ মে) রমনা থানার এসআই মোজাহিদসহ পুলিশের একটি দল পরীবাগ এলাকায় রাত্রিকালীন টহল ডিউটি করছিল। রাত আনুমানিক ৩টার দিকে হিজড়াদের একটি দল ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে। এ সময় সেখানে পুলিশ উপস্থিত হলে হিজড়ারা পুলিশের ওপর হামলা করে। একপর্যায়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে একটি ইট এসআই মোজাহিদের চোখে পড়ে। এতে মুজাহিদের চোখের চশমার কাচ ভেদ করে চোখ মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এতে তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়াও তিনি মুখের বিভিন্ন অংশে আঘাতপ্রাপ্ত হন। এসআই মোজাহিদকে শেরেবাংলা নগর চক্ষু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার চোখের অপারেশন হয়েছে। এ ঘটনায় রমনা মডেল থানায় একটি পুলিশবাদী মামলা হয়েছে। হামলায় জড়িত তিন হিজড়াকে গত শুক্রবার আদালতে সোপর্দ করা হয়। গত রোববার আরও একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রমনা থানা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এদিকে পাল্লা দিয়ে হিজড়ার সংখ্যা বাড়লেও তাদের কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। সমাজসেবা অধিদপ্তর বলছে, এদের সবাই প্রকৃত তৃতীয় লিঙ্গের মানুুষ নয়, অনেকেই হিজড়া সেজে চাঁদাবাজির সুযোগ নিচ্ছে।

রাজধানীতে সিগন্যাল পড়লে হিজড়ারা যানবাহন ঘিরে ধরে যাত্রীদের কাছে চাঁদা দাবি করে। ভুক্তভোগীরা জানান, সবাই একসাথে ঘিরে ধরে এমনভাবে গালাগাল করে যাতে যাত্রীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তাদের চাহিদামতো চাঁদা না দিলে তারা বাজে ব্যবহার করে। অনেক ক্ষেত্রে আশপাশের কেউ সাহায্য করতেও আসে না। দিনের পর দিন রাজধানীতে হিজড়াদের উৎপাত বাড়লেও সমাজসেবা অধিদপ্তরের কাছে নেই সঠিক পরিসংখ্যান। সর্বশেষ ২০২০ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার ৯৩ জন। বাস্তবে এ সংখ্যা চারগুণেরও বেশি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। যাদের বেশিরভাগ অবস্থান করে ঢাকায়। অন্যদিকে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে ৫০ হাজার হিজড়া রয়েছে। এ বিষয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের কাছে ঢাকায় কত হিজড়া আছে এর পরিসংখ্যান সেভাবে নেই। এখন দেখা যায়, অনেক পুরুষ নানাভাবে হিজড়া সেজে তারাও নিজেদের হিজড়া দাবি করে আসছে। এক্ষেত্রে সংখ্যা আরও বাড়বে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে এদের মধ্যে একটি কালচার তৈরি হয়েছে। হিজড়ারা ১০-১৫ জন মিলে একজনকে গুরু মেনে তার অধীনে একসাথে কোনো বস্তিতে বা কোনো বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে। সদস্যরা বাইরে গিয়ে চাঁদা এনে গুরুকে দেয়। সেই অর্থ দিয়ে গুরু সবার খাওয়া এবং বাড়ি ভাড়া দেয়। এটা হিজড়া কালচার হিসেবে পরিচিত। সম্পত্তি এবং পরিবারের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে তাদের এই পথে নামা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। তবে এখন সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে তাদের কিছু কাজের সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। সরকারিভাবেও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে হিজড়াদের হয়রানিমূলক আচরণের জন্য তারা নিজেরা দায়ী, এর পেছনে কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরিবার ও সমাজের বড় দায় আছে বলে মন্তব্য করেন অনেকে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত