চট্টগ্রাম বে টার্মিনাল

চতুর্থ টার্মিনাল ব্যবহার হবে জ্বালানি নিরাপত্তায়

প্রকাশ : ০৫ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  তামীম রহমান, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামে নির্মানাধীন বে টার্মিনালটি নির্মাণকাজ চলমান আছে। বে টার্মিনালের কাজ সম্পন্ন হলে এর বহুমুখী উপকার ভোগ করবে নগরবাসীসহ পুরো দেশবাসী। এর মধ্যেই দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় বে টার্মিনাল ব্যবহার করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বঙ্গোপসাগরে জাহাজ থেকে পাইপ লাইনে জ্বালানি তেল খালাস, কুতুবদিয়া থেকে পাইপ লাইনে চট্টগ্রামে জ্বালানি তেল সরবরাহ কিংবা মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করার পর এবার বে টার্মিনালের চতুর্থ টার্মিনালটিও জ্বালানি তেল, এলপিজি এবং এলএনজি খালাসের জন্য ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। দেশীয় বিনিয়োগে এই টার্মিনালটি নির্মিত হবে। আ জ ম জে চৌধুরীর মালিকানাধীন ইস্ট কোস্ট গ্রুপ এই লিকুইড টার্মিনালটি নির্মাণ করবে। বন্দর সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরের প্রস্তাবিত বে টার্মিনাল প্রকল্পে ৮ বিলিয়ন ডলার (৮৮ হাজার কোটি টাকা) বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। এ প্রকল্পের আওতায় জাহাজ থেকে পণ্য লোড-আনলোড করার জন্য চারটি টার্মিনাল ও নৌপথ তৈরিতে এ বিনিয়োগ করা হবে। এছাড়া এর মধ্যে রয়েছে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য চতুর্থ টার্মিনাল হিসেবে গ্যাস ও অয়েল টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগও। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে নির্মাণাধীন বে টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পে গতি ফিরছে। ভূমি সংকটের বড় অংশ ঘুচে যাওয়ার পর বে টার্মিনালের নির্মাণ পথের বড় অন্তরায় দূর হয়েছে। বে টার্মিনাল প্রকল্পে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে অন্তত পাঁচগুণ বড় বে টার্মিনালে ইতোপূর্বে তিনটি টার্মিনাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছিল, যার দুইটি বিদেশি বিনিয়োগে এবং একটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের। কিন্তু পরবর্তীতে সরকারের নীতিনির্ধারক মহল বে টার্মিনালে চারটি টার্মিনাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। এর মধ্যে চতুর্থ টার্মিনালটি দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গ্যাস ও অয়েল টার্মিনাল হিসেবে নির্মাণ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে সাথে নিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী আজম জে চৌধুরীর মালিকানাধীন ইস্ট কোস্ট গ্রুপ এই টার্মিনালে বিনিয়োগ করবে। চতুর্থ টার্মিনালটিকে লিকুইড টার্মিনাল হিসেবে নির্মাণ করে এখানে জ্বালানি তেল, এলপিজি এবং এলএনজি খালাস করা হবে।

এই টার্মিনালটি দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার সক্ষমতাকে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলেও বন্দরের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা মন্তব্য করেছেন। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরের ১৩৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভার আয়োজনে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল জানান, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিদেশি বিনিয়োগ আসবে বে টার্মিনাল প্রকল্পে। বে টার্মিনালে পৃথক চারটি টার্মিনাল তৈরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ৩৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগ হবে গ্যাস ও তেল খালাসের টার্মিনালে। একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ইস্ট কোস্ট গ্রুপ এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। বাকি তিনটি টার্মিনাল কনটেইনার ও পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজে ব্যবহার হবে। ১৫০ কোটি ডলার করে বিনিয়োগ করে দুটি টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনা করবে সিঙ্গাপুরের পিএসএ ইন্টারন্যাশনাল এবং আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড। এছাড়া আবুধাবি পোর্টস প্রস্তাব করেছে মাল্টিপারপাস নামে আরেকটি টার্মিনাল নির্মাণের, যেখানে ১০০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ হতে পারে। এছাড়া প্রক্রিয়াধীন রয়েছে নৌপথ তৈরিতে আরো ৫৯ কোটি ডলার বিনিয়োগের। এসব প্রকল্পের দৃশ্যমান কাজ এ বছর শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। তিনি আরো জানান, বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর টার্মিনালের নির্মাণকাজ দ্রুত শুরু হবে সরকারি অনুমোদন পাওয়ার পর মাঠপর্যায়ে নির্মাণকাজ শুরু হয়ে যাবে। সেখানে বড় বড় জাহাজ ভেড়ানো যাবে। গত এক বছরে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ৪৩ হাজার বর্গমিটার কনটেইনার ইয়ার্ড নির্মাণ করা হয়েছে। এ কনটেইনার ইয়ার্ড নির্মাণের ফলে অতিরিক্ত সাত হাজার টিইইউএস কনটেইনার ধারন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি আরো তিনটি নতুন কনটেইনার ইয়ার্ড নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়েছে।

সূত্র বলেছে, বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেল একটি বড় ইস্যু। যে কোনো দেশের ৯০ দিনের জ্বালানি তেল মজুত করার সক্ষমতাসহ অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধাকেই জ্বালানি নিরাপত্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের জ্বালানি তেল মজুতের সক্ষমতা মোটামুটি ৩০ থেকে ৩৫ দিনের। এই নিরাপত্তা বাড়াতে এরই মধ্যে সরকার ৫ হাজার কোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে ‘ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপ লাইন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার অদূরে গভীর সমুদ্রে ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং’ নির্মাণ করা হয়। ওখান থেকে ইস্টার্ন রিফাইনারি পর্যন্ত অফ শো’র এবং অনশোর মিলে মোট ২২০ কিলোমিটার ডাবল পাইপলাইন স্থাপন করা হয়। এরই মধ্যে ১৪৬ কিলোমিটার অফশোর পাইপলাইন এবং ৭৪ কিলোমিটার অনশোর পাইপলাইন রয়েছে। প্রকল্পের আওতায় পাইপ লাইন ছাড়াও মহেশখালীতে ১ লাখ ২৫ হাজার টন ক্রুড অয়েল এবং প্রায় ৮০ হাজার টন ডিজেল সংরক্ষণের ট্যাংক নির্মাণ করা হয়। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ক্রুড অয়েল এবং ডিজেল ওই দুইটি ট্যাংকে সংরক্ষণ করে ওখান থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী দুইটি পাইপ লাইনের একটি দিয়ে ক্রুড অয়েল ইস্টার্ণ রিফাইনারিতে এবং অপর পাইপ লাইন দিয়ে ডিজেল পদ্মা অয়েল কোম্পানি, যুমনা অয়েল কোম্পানি এবং মেঘনা পেট্রোলিয়ামের পতেঙ্গার গুপ্তাখালস্থ প্রধান ডিপোতে পাঠানোর ব্যবস্থা রয়েছে।

দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় মাইলফলক বলেও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) সূত্র জানিয়েছে। দেশে বর্তমানে বছরে প্রায় ৭৫ লাখ টন জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে। প্রতি মাসে দেশে গড়ে ৬ লাখ টনেরও বেশি জ্বালানি তেল প্রয়োজন হয়। এতো তেল মজুতের সক্ষমতা বিপিসির নেই। তাই বন্দরের বে টার্মিনালের চতুর্থ টার্মিনালকে ঘিরে জ্বালানি মজুতসহ নানা ধরনের অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে। এতে প্রায় ৩৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগ হবে। বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠানকে ইস্ট কোস্ট গ্রুপ সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সঙ্গে নেবে বলেও সূত্র জানিয়েছে। এই টার্মিনালটি নির্মিত হলে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা সুদৃঢ় হবে মন্তব্য করে সূত্র বলেছে, বে টার্মিনালের প্রথম দুইটি টার্মিনাল নির্মাণে ব্যয় হবে ১৫০ কোটি ডলার করে মোট ৩০০ কোটি ডলার। সিঙ্গাপুরের পিএসএ ইন্টারন্যাশনাল (সিঙ্গাপুর পোর্ট) এবং আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড এই দুইটি টার্মিনাল নির্মাণের সমুদয় অর্থ বিনিয়োগ করবে। এছাড়া আবুধাবি পোর্টস ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগে একটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণ করবে। চতুর্থ টার্মিনালটিতে সবচেয়ে বেশি অর্থ বিনিয়োগ হবে।