ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

চালু হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল

চালু হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল

চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) অবশেষে পুরোদমে চালু হচ্ছে। আজ থেকে এই টার্মিনালে কনটেইনার জাহাজ বার্থিং দিয়ে খালাস কার্যক্রম শুরু হবে। বন্দর সূত্রে জানা গেছে, ডেনমার্কভিত্তিক জাহাজ কোম্পানি মায়ের্সক লাইনের জাহাজ দিয়ে এই টার্মিনালের পথচলা শুরু হবে। কনটেইনার টার্মিনালে রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার জাহাজে বোঝাই করা হয়। আবার আমদানি পণ্যবাহী জাহাজ ভেড়ানোর পর তা থেকে কনটেইনার খালাস করা হয়। সৌদি আরবের রেড সী গেটওয়ে টার্মিনাল (আরএসজিটি) বাংলাদেশ লিমিটেডকে এখানে জাহাজ বার্থিং থেকে শুরু করে আমদানি-রপ্তানি সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনার সাময়িক অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। ৮টি শর্তে দেওয়া এই অনুমোদনপত্র পাওয়ার পর আজ থেকে পিসিটিতে জাহাজ বার্থিং দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। প্রথম দিন এমভি মার্কস ডাবো জাহাজ বার্থিং দেওয়া হবে। শুরুতে শুধুমাত্র ক্রেন আছে এমন গিয়ার ভ্যাসেলই এখানে হ্যান্ডলিং করা হবে। নতুন এই টার্মিনাল চালু হলে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে আরও গতি আসবে। মূলত সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) আওতায় সৌদির প্রতিষ্ঠান রেড সী গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে জিটুজি ভিত্তিতে চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, সরবরাহ, পরিচালনা ও হস্তান্তর ভিত্তিতে ২২ বছর মেয়াদে টার্মিনালটি পরিচালনা করবে সৌদি কোম্পানিটি। চুক্তির পর তারা এককালীন ও বার্ষিক নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করবে বন্দরকে। এ ছাড়া সৌদি কোম্পানি কনটেইনার ওঠানো-নামানোর জন্য শিপিং কোম্পানি ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে যে ফি পাবে, তা থেকে কনটেইনারপ্রতি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বন্দরকে দেওয়ার কথা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস, রপ্তানি ও বন্ড শাখার স্মারক মূলে জানানো হয়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বোর্ড পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের অপারেশনাল কার্যক্রম চালু করার সাময়িক অনুমতি প্রদান করেছে। এতে বলা হয়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নবনির্মিত পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রেড সী গেটওয়ে বাংলাদেশ লিমিটেডের সাথে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের একটি কনসেশন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই চুক্তির আওতায় রেড সী গেটওয়ে বাংলাদেশ লিমিটেড উক্ত টার্মিনালে বার্থিং নেওয়া জাহাজ থেকে লোডিং, আনলোডিং, ট্রান্সপোর্টিং, হ্যান্ডলিং, ইন্টারন্যাশনাল মুভমেন্ট, কনটেইনার খালাস ও ডেলিভারি, শেড ও ওয়্যারহাউজ থেকে পণ্য স্টাফিং এবং আনস্টাফিংসহ সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। বন্দর কর্তৃপক্ষের গতকাল থেকে পিসিটিতে জাহাজের বার্থিং, আমদানি-রপ্তানি ও ডেলিভারি সংক্রান্ত অপারেশনাল কার্যক্রম পরিচালনা করার কথা। এনবিআর ৬ জুন থেকে জাহাজ বার্থিংয়ের অনুমোদন দিলেও বন্দর কর্তৃপক্ষ আজ থেকে জাহাজ বার্থিং দেওয়া শুরু করবে। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক জানান, শনিবার থেকে পিসিটি চালু হবে। রেড সী গেটওয়ে বাংলাদেশ লিমিটেড প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ করে এই টার্মিনাল পরিচালনা করবে। এনবিআরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে সহায়তা, জাহাজ জট কমানো এবং পণ্য পরিবহন সংক্রান্ত খরচ ও সময় কমানোর উদ্দেশ্যে কাস্টমস সংক্রান্ত যাবতীয় আইনী বাধ্যবাধকতা ও আনুষ্ঠানিকতা পালন করে শর্তসাপেক্ষে এই কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। এনবিআর এই টার্মিনালে কার্যক্রম পরিচালনা করার ক্ষেত্রে আটটি শর্ত দিয়েছে। শর্তগুলো হচ্ছে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে রেড সী গেটওয়ে বাংলাদেশ লিমিটেডের অর্থায়নে পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনালে এসাইকোডা কানেক্টিভিটি স্থাপনের জন্য যাবতীয় আইটি ইকুইপমেন্ট, এক্সেসরিজ, কম্পিউটার, রাউটার, প্রিন্টার, স্ক্যানার, ফটোস্ট্যাট মেশিন, ইন্টারনেট কানেকশনসহ কাস্টমস কর্তৃপক্ষের দাপ্তরিক কার্যক্রম, অ্যাডমিনেশন ও আনস্টাফিং কার্যক্রম পরিচালনা এবং কাস্টমস কর্মকর্তাদের অফিস কক্ষ, যানবাহন ও নিরাপত্তা সামগ্রীসহ প্রয়োজনীয় সব লজিস্টিকস অপারেশনাল কার্যক্রম শুরুর আগেই নিশ্চিত করতে হবে। বন্দরে অবতরণীয় পণ্য চালানের বিল অব ল্যাডিংয়ের (বিএল) কনটেইনার সেগমেন্টে পিসিটির জন্য বরাদ্দকৃত কনটেইনার লোকেশন কোড ব্যবহার করতে হবে। অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ওয়ান স্টপ সলিউশন সেন্টারের মাধ্যমে বিদ্যমান ব্যবস্থার ন্যায় বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল হতে পণ্য খালাসকালে একটি নোট ইস্যু করতে হবে। শুল্ক-কর পরিশোধ ও কাস্টমস আনুষ্ঠানিকতা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো পণ্য চালান পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল থেকে সাউথ কনটেইনার ইয়ার্ডে প্রেরণ করা যাবে না। পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে স্ক্যানার স্থাপন না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন অফ ডক ও ইপিজেডে গমনকারী কনটেইনারসমূহ কায়িক পরীক্ষণ সাপেক্ষে নিশ্চিত হয়ে প্রেরণ করতে হবে। উল্লেখ্য, চিটাগাং ড্রাইডক লিমিটেডের পাশ থেকে বোট ক্লাব পর্যন্ত আগেকার বিমানবন্দর সড়কের বাঁকগুলো সোজা করে উদ্ধার করা নদীপাড়ের ৩২ একর জায়গায় পিসিটি নির্মাণ করা হয়। ২০১৭ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পিসিটি নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব তহবিল থেকে প্রায় ১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে পিসিটি নির্মাণ করে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নকশা অনুযায়ী সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের তত্ত্বাবধানে দেশীয় প্রতিষ্ঠান ই-ইঞ্জিনিয়ারিং এটির নির্মাণ কার্যক্রম পরিচালনা করে। ২০২২ সালের মাঝামাঝি নির্মাণকাজ শেষ হলেও নানা কারণে চালু হয়নি। অবশেষে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের আওতায় সৌদি আরবের রেড সী গেটওয়ে লিমিটেডের সাথে গত ডিসেম্বরে চুক্তি সম্পাদনের পর তাদের এই টার্মিনালটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। পিসিটিতে চট্টগ্রাম বন্দরের এযাবতকালের সবচেয়ে ‘বড়’ জাহাজগুলোকে অনায়াসে বার্থিং দেওয়া যাবে বলে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বাড়তি গভীরতার পাশাপাশি চ্যানেলে কোনো বাঁক না থাকায় পিসিটি বড় জাহাজ ভিড়ানোর সুবিধা পাবে। বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে এনসিটি, সিসিটির দূরত্ব ১৪-১৫ কিলোমিটার। আর পিসিটির দূরত্ব মাত্র ৬ কিলোমিটার। এটা বন্দরের বিদ্যমান টার্মিনালগুলোর তুলনায় পিসিটিকে গুরুত্বপূর্ণ করেছে। এই টার্মিনালে বছরে প্রায় ৫ লাখ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা যাবে। টার্মিনালটিতে ১৬ একর ইয়ার্ডসহ বিভিন্ন পশ্চাৎসুবিধা এবং ৫৮৪ মিটার দীর্ঘ জেটি রয়েছে। জেটি এলাকায় পানির গভীরতা সাড়ে ১১ মিটার হলেও ১০ থেকে সাড়ে ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়ানো যাবে। এই টার্মিনালে ১৯০ মিটার লম্বা ও ১০ বা সাড়ে ১০ মিটার ড্রাফটের ৩টি কনটেইনার জাহাজ একসাথে এবং ২২০ মিটার দীর্ঘ ডলফিন জেটিতে একটি ভোজ্যতেলবাহী জাহাজ ভিড়ানো যাবে। তবে ২১০ মিটার বা বেশি ল্যান্থের জাহাজ দুটির বেশি ভিড়ানো যাবে না। টার্মিনালে ১ লাখ ১২ হাজার বর্গমিটারের আরসিসি পেভমেন্ট (অভ্যন্তরীণ ইয়ার্ড ও সড়ক), ২ হাজার ১২৮ বর্গমিটার কনটেইনার ফ্রেইট স্টেশন (সিএফএস) শেড, ৬ মিটার উঁচু ১ হাজার ৭৫০ মিটার কাস্টমস বন্ডেড ওয়াল, ৫ হাজার ৫৮০ বর্গফুটের পোর্ট অফিস ভবন, ১ হাজার ২০০ বর্গমিটারের যান্ত্রিক ও মেরামত কারখানাসহ বিভিন্ন অবকাঠামো গড়ে তোলার মাধ্যমে টার্মিনালকে একটি স্বতন্ত্র বন্দরের আদল দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অর্থায়নে ১ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে পিসিটি নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। নতুন নির্মিত এই টার্মিনালে একসঙ্গে তিনটি কনটেইনার জাহাজ ভিড়তে পারবে। পতেঙ্গা এলাকায় নির্মিত এ টার্মিনালের মাধ্যমে বছরে ৫ লাখ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং সম্ভব হবে। পাশাপাশি এ টার্মিনালটি বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরের বাকি টার্মিনাল থেকে এখানে বেশি ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানো যাবে। যেখানে চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে ৯ মিটার ড্রাফট ও ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যরে কনটেইনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারে। সেখানে পিসিটিতে ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যরে এবং ১০ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানো সম্ভব হবে। টার্মিনালটি পরিচালনায় রেড সী গেটওয়ে বিভিন্ন ধরনের ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ করেছে। তবে কী গ্যান্ট্রি ক্রেনের মতো বড় ইকুইপমেন্ট আনতে আরো সময় লাগবে। কী গ্যান্ট্রি ক্রেন না থাকায় শুরুতে এই টার্মিনালে শুধুমাত্র গিয়ারড ভ্যাসেল (যে জাহাজের নিজস্ব ক্রেন আছে) হ্যান্ডলিং করা হবে। টার্মিনালটি পুরোদমে চালু করতে চারটি কী গ্যান্ট্রি ক্রেন (কিউজিসি), ৮টি রাবার টায়ার্ড গ্যান্ট্রি (আরটিজি), ৪টি স্ট্রাডেল ক্যারিয়ার, ৪টি রিচ স্ট্যাকার, একটি রেল মাউন্টেড গ্যান্ট্রি ক্রেন (আরএমজি), ৪টি লো-মাস্ট ফর্ক লিফট, দুটি ফায়ার ট্রাক, একটি ফায়ার কার, তিনটি নিরাপত্তা পেট্রোল কার, একটি অ্যাম্বুলেন্স, ৫০ টনের দুটি টাগ বোট, দুটি পাইলট বোট, দুটি ফার্স্ট স্পিডবোটসহ অন্তত ৮০০ কোটি টাকার ইকুইপমেন্ট লাগবে। চুক্তি অনুযায়ী পিসিটির প্রয়োজনীয় সব ইকুইপমেন্ট বিদেশি অপারেটর ক্রয় করবে। তারা দুই বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ মোট ২২ বছর এই টার্মিনাল পরিচালনা করবে। এরপর ইকুইপমেন্টসহ বন্দরটি যেভাবে থাকে তা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করা হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত