ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আমদানি-রপ্তানিতে সমুদ্র বন্দরে বাড়ছে সক্ষমতা

আমদানি-রপ্তানিতে সমুদ্র বন্দরে বাড়ছে সক্ষমতা

দেশের অর্থনীতি চাকা চাঙা রাখতে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে সব সমুদ্রবন্দর ঢেলে সাজানো হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ও বন্দরে ব্যবসায়ীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করায় হয়রানি ও অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা কমেছে। এতে বন্দরে জাহাজ বেশি নোঙর করায় কনটেইনার, কার্গো পরিবহণ ও রাজস্ব বেড়েছে।

জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপরেই সমুদ্র বন্দরগুলোয় রাজস্ব আদায়ের ধারাবাহিকতা আরো বাড়াতে নতুন করে নানা চ্যালেঞ্জ ও কর্মপরিকল্পনা নিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও কাস্টমস, যার প্রতিফলন জাতীয় বাজেটেও দেখা গেছে। তবে বর্তমানে ইউরোপে দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য কম সময় ও খরচে সরাসরি যাচ্ছে। বিশ্বের ১০৬টি বন্দরের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজ চলাচল করছে। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ডিজিটালাইজেশন ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে স্মার্টের পথে হাঁটছে। আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজনে গতিশীল পণ্য ব্যবস্থাপনা রয়েছে। চট্টগ্রাম, মোংলার পাশাপাশি জাহাজ বার্থিংয়ের গতি আনতে বঙ্গোপসাগরের কর্ণফুলী মোহনার কাছাকাছি ড্রাই ডক ও চট্টগ্রাম বোট ক্লাবের মাঝামাঝি ৩২ একর জায়গায় কর্ণফুলী নদীর তীরে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়েছে। টার্মিনালে কনটেইনার জাহাজ বার্থিং দিয়ে খালাস শুরু হয়েছে। যার ফলে সমুদ্রবন্দরে কনটেইনারে পণ্য আমদানি-রপ্তানির কার্যক্রম আরো বাড়বে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বাংলাদেশে সামগ্রিক বাণিজ্যের ৯২ শতাংশ সমুদ্রবন্দর ও নদীপথে হয়ে থাকে। আর পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে সমুদ্রবন্দরগুলোর মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে চট্টগ্রাম বন্দর। দেশের শতভাগ গুণগত মান বজায় রেখে দেশীয় পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে জাহাজে করে বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। এ বন্দরের পণ্য শতভাগ শুল্কায়ন করছে চট্টগ্রাম কাস্টমস। দেশটির পণ্য আমদানি-রপ্তানি খাতে গতি আনতে সমুদ্রবন্দরগুলো বড় ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশকে ঘিরে আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য ভারত, চীন, মিয়ানমার, নেপাল, ও ভুটানের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণে এসব বন্দরের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় পণ্য আমদানি-রপ্তানি বেড়েছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে (জুলাই-মে) এ বন্দর দিয়ে কনটেইনার পরিবহণ হয়েছে ২৮ লাখ ৯৩ হাজার ৯১৭টি। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছিল ২৭ লাখ ১৯ হাজার ২৩টি। শুধু কনটেইনারই নয়, বন্দরে বেড়েছে কার্গো পরিবহণও। চলতি অর্থবছরে গত মে মাসেই চট্টগ্রাম বন্দরের অধীনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১ কোটি ১১ লাখ কার্গো পরিবহণ হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এর চেয়ে বেশি কার্গো পরিবহণ হয়েছিল গত মার্চে ১ কোটি ১৩ লাখ ৩৪ হাজার। তবে অর্থবছরের ১১ মাস হিসাব করলে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ কোটি ৩৪ লাখ ৮৭ হাজার। গত অর্থবছরে একই সময়ে (২০২২-২৩) মোট কার্গো (কনটেইনার পণ্য ও কনটেইনারবিহীন পণ্য) পরিবহণ হয়েছিল ১০ কোটি ৮০ লাখ ৩৬ হাজার।

ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ডলারের সংকট ক্রমশ কমে আসছে। এতে গত বছরের তুলনায় পণ্য আমদানি-রপ্তানির হার কিছুটা বেড়েছে। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) পরিচালক মোহাম্মদ শামসুল আজম বলেন, আসন্ন ঈদুল আজহার ছুটির কারণে অনেক পোশাক মালিক মে মাসে তাদের শিপমেন্ট বাড়িয়েছেন। সে কারণেই মে মাসে রপ্তানির পরিমাণ বেশি।

চট্টগ্রাম বন্দরের সাত বছরের কার্গো হ্যান্ডলিং বা আমদানির পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আমদানিতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬ কোটি ৬৩ লাখ ৮৪ হাজার ৮৮৫ মেট্রিক টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭ কোটি ৭৮ লাখ ৭৩ হাজার ৬১৫ মেট্রিক টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ কোটি ২৯ লাখ ৩৯ হাজার ৭৩১ মেট্রিক টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮ কোটি ৭২ লাখ ৭৫ হাজার ২৪৮ মেট্রিক টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯ কোটি ৯২ লাখ ৪০ হাজার ৭৫৯ মেট্রিক টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১০ কোটি ১৮ লাখ ৫৪ হাজার ৪৭৪ টাকা এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০ কোটি ১৮ লাখ ৪৫ হাজার ৯৯৮ মেট্রিক টন আমদানি করা হয়েছে। এখানে প্রত্যেক বছরে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে আমদানির মাত্রা বাড়ছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের সাত বছরের কার্গো হ্যান্ডলিং বা রপ্তানির পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রপ্তানিতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬৭ লাখ ৯ হাজার ৭৫৯ মেট্রিক টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬৯ লাখ ৯৫ হাজার ২৮৫ মেট্রিক টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬৮ লাখ ৪৬ হাজার ৪০৬ মেট্রিক টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬৬ লাখ ৪৫ হাজার ১৪৫ মেট্রিক টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭৩ লাখ ৬৮ হাজার ৬৪ মেট্রিক টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭৯ লাখ ৬৯ হাজার ৩৬৬ মেট্রিক টন এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭৩ লাখ ৫১ হাজার ২৫৮ মেট্রিক টন পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের পাশাপাশি মোংলা বন্দরে বেড়েছে কনটেইনার হ্যান্ডলিং ও রাজস্ব আদায়। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-মার্চে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং বেড়েছে ৩০ দশমিক ৫৯ শতাংশ, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় নিট মুনাফা বেড়েছে ২১ দশমিক ২৮ শতাংশ। কনটেইনার জাহাজ আগমনের নতুন রেকর্ড করেছে মোংলা বন্দর। গত এপ্রিলে বন্দরে আটটি কনটেইনারবাহী জাহাজ এসেছে, যা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।

মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ পরিচালক (বোর্ড) কালাচাঁদ সিংহ (উপসচিব) আলোকিত বাংলাদেশকে বলেছেন, মোংলা বন্দরে রাজস্ব আদায় বেড়েছে। আগের চেয়ে বন্দরে জাহাজ বেশি ভিড়েছে। বন্দরে আরো বেশি জাহাজ ভিড়াতে ড্রেজিংয়ের কাজ কাজ চলমান রয়েছে। তবে ড্রেজিংয়ের বালু ফেলানো নিয়ে কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়েছে। সেই জটিলতা নিরসন হলে মোংলা বন্দরের সক্ষমতা আরো বাড়বে।

মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের উপপরিচালক মো. মাকরুজ্জামান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেছেন ‘প্রত্যেক মাসে আটটি কনটেইনারবাহী জাহাজ বন্দরে ভিড়ছে। এতে গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সংখ্যা বেড়েছে। এই অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে মোংলা বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ২৫ হাজার ২৮ টিইইউএস। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই সংখ্যা ছিলো ১৯ হাজার ১৬৫ টিইইউএস।

মাকরুজ্জামান আরো বলেন, কনটেইনারবাহী জাহাজ ভিড়ায় মোংলা বন্দরের রাজস্বও বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে মোংলা বন্দরের নিট মুনাফা হয়েছে ৭০ দশমিক ১৯ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরে একই সময়ে ছিল ৫৭ দশমিক ৮৭ কোটি টাকা।

চট্টগ্রাম বন্দরে কর্মরত কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো করোনা মহামারির প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছিল। ওই সময়ে হাজার হাজার কনটেইনার বন্দরে আটকা পড়ে থাকতো। কিন্তু বর্তমানে বন্দরে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে জাহাজের অপেক্ষমাণ সময় কমছে। দেশ-বিদেশে বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে ব্যাপক চাপ তৈরি হয়েছে। পণ্য পরিবহণ ব্যয় কমাতে হবে।

চট্টগ্রাম আধুনিক বন্দর টার্মিনালের সুবিশাল ক্রেনগুলো জাহাজের ডেক থেকে পণ্যবোঝাই কনটেইনারগুলো তুলে আনছে। এভাবে বন্দরের কনটেইনার জেটি দিনরাত ব্যস্ত থাকছে। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৮ হাজার টিইইউ কনটেইনার উঠানো-নামানো হয়। বন্দরের ইয়ার্ডগুলোয় প্রায়ই ৪০ হাজার একক (টিইইউ) কনটেইনার মজুত থাকে। এর মধ্যে প্রতিদিন বন্দর থেকে ৫ হাজার টিইইউ কনটেইনারের বেশি পণ্য খালাস করা হয়। দেশের সমুদ্রবন্দরগুলোয় আধুনিক যন্ত্রপাতির পাশাপাশি অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বন্দরের নতুন টার্মিনাল পরিচালনায় বিদেশি বিনিয়োগের সূচনা হয়েছে, আসছে আরো হাজার কোটি ডলারের বিনিয়োগ। নতুন প্রজন্মের বে-টার্মিনালের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা ৩ থেকে ৪ গুণ বেড়েছে। আঞ্চলিক হাব হয়ে ওঠার সম্ভবনায় মাতারবাড়িতে শুরু হয়েছে বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণকাজ।

বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম দিয়ে বার্ষিক ১২৫ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ পরিচালিত হয়। বর্তমানে এটি বিশ্বের ৬৭তম ব্যস্ততম কনটেইনার বন্দর। কিন্তু পাঁচ দশক আগেও কনটেইনারবাহী পণ্য পরিচালনার মতো অবস্থা ছিল না। ৭০’র দশকে বন্দরে পাঁচ বা ছয়টি ক্রেন ছিল। প্রতিটি ক্রেন মাত্র তিন টন ওজনের পণ্য বহন করতে পারত। এখন প্রায় ১৮টি বিশাল আকৃতির গ্যান্ট্রি ক্রেনে ঝামেলা ছাড়াই ৪০ টন ওজনের কনটেইনার তুলতে পারে।

দেশ-বিদেশে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে জাহাজে খরচ কম থাকায় কনটেইনারের ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পোশাক শিল্পের কাঁচামাল আমদানি ও পোশাক রপ্তানিতে কনটেইনারের ব্যবহার বেড়েছে। বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য সংকট ও লোহিত সাগরে অচলাবস্থায় দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য মন্দা থাকা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম বন্দর সচল ছিল। কনটেইনার পরিবহণ গত বছর সার্বিক পণ্য পরিবহণ আগের বছরের তুলনায় বেশি হয়েছে। গত এক দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে কার্গো পণ্যের পরিমাণ। চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে আসা জাহাজগুলো সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮০০ কনটেইনার বহন করতে পারে। বে-টার্মিনালে ৫ হাজার কনটেইনারবাহী জাহাজও ভিড়তে পারবে। এ টার্মিনালের বিভিন্ন জেটিতে একসঙ্গে ৩০ থেকে ৩৫টি জাহাজ নোঙর করতে পারবে। কয়লা, জ্বালানি তেল ও ক্লিঙ্কারের জন্য আলাদা জেটি থাকবে বে-টার্মিনালে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রপ্তানি হওয়া প্রায় সব পণ্য চট্টগ্রামের ১৯টি বেসরকারি অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপোতে লোড করা হয়। এছাড়া এ ডিপোগুলোয় খাদ্য সামগ্রীসহ ৩৮ ধরনের আমদানি পণ্য হ্যান্ডেল করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের দুই প্রবেশপথে দুইটি ফিক্সড স্ক্যানার চালু হয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে বন্দর দিয়ে জাহাজীকরণের আগে রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার পরীক্ষা করা হয়।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল বলেন, দেশ-বিদেশে পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে গত কয়েক দশকে চট্টগ্রাম বন্দরের আমূল পরিবর্তন হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত