প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তৃতীয়বার শপথগ্রহণ মোদির

আস্থা ও সুসম্পর্কের বন্ধনে লাভবান ভারত-বাংলাদেশ

প্রকাশ : ১০ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র ভারতে একটানা তৃতীয়বারের মতো বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেছেন। গতকাল সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি ভবন রাইসিনা হিলসের চত্বরে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠান ঘিরে রাষ্ট্রপতি ভবন নতুন রূপে সাজানো হয়। সর্বোচ্চ নিরাপত্তার চাদরে ভবনটি ঘিরে রাখা হয়। ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রিপরিষদের অন্য সদস্যদের শপথ পাঠ করান। বিজেপি তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসায় বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন করে আর কোনো সমীকরণের প্রয়োজন নেই। গত ১০ বছরের মতো আগামী ৫ বছরও দুই দেশের মধ্যে যেসব দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে সহযোগিতা চলমান আছে, তার ধারাবাহিকতা চলতে থাকবে; যার মাধ্যমে দুই দেশের পারস্পরিক বন্ধন আরো দৃঢ় হবে বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নয়াদিল্লি যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল সন্ধ্যায় শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেন তিনি। নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানের পর নতুন মন্ত্রিসভার সদস্য ও বিদেশি অতিথিদের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর নৈশভোজে আপ্যায়ন করা হয়। সেই অবসরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি কিছু সময় আলাপ-আলোচনা করেন। আর আজ সোমবার ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একান্তে বৈঠক করার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

শপথ অনুষ্ঠানে প্রায় ৯ হাজার অতিথির সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন প্রতিবেশী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী প্রবীণ কুমার জগন্নাথ, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং টোগবে, নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কুমার দহল ও মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু প্রমূখ শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি জয়ের পর বাংলাদেশের জন্য বেশকিছু বার্তা দিয়েছেন। সরকার গঠনের প্রাক্কালে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরো জোরালো করার বার্তা দেন নরেন্দ্র মোদি। গত বুধবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে নরেন্দ্র মোদি লিখেন- ‘উষ্ণ শুভেচ্ছার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই। ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। গত দশকে এই সম্পর্ক নজিরবিহীনভাবে বেড়েছে। আমাদের জনগণকেন্দ্রিক অংশীদারিত্ব আরো শক্তিশালী করার অপেক্ষায় আছি।’

জানা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর থেকে দুই দেশের রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ হয়েছে। আওয়ামী লীগ একটানা চতুর্থবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ও বিজেপি একটানা তৃতীয়বার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকছে। এতে দুই দেশের সম্পর্কে কোনো হেরফের ঘটেনি। এই সময়ে দুই দেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়, ভারতকে সড়কপথে ট্রানজিট দেওয়া, চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেওয়াসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে চুক্তি হয়েছে। এছাড়া দুই দেশের মধ্যে সাধারণ মানুষের আসা-যাওয়াও আগের চেয়ে বেড়েছে।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদির সরকার গঠনে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মাত্রায় তেমন পরিবর্তন আসবে না। বাংলাদেশকে এখন ভাবতে হবে কীভাবে সম্পর্কে আরো গতি আনা যায়। বাংলাদেশের কাছে এখন প্রাধান্য পাবে বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক যোগাযোগের বিষয়গুলো বাড়ানো। গত একদশকে নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের যেসব উদ্বেগের জায়গা ছিল, বাংলাদেশ সেসব ইস্যু গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সমাধান করার চেষ্টা করেছে, সেটা দুই দেশের সম্পর্কে আস্থা বাড়িয়েছে। আগামী দিনেও এই সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে।

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও ভারতে বিজেপি সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকায় দুই দেশের সম্পর্কে অনেক অগ্রগতি হবার পরও তিস্তাসহ কয়েকটি নদীর পানি বণ্টনসহ অমীমাংসিত রয়েছে। পানি বণ্টন নিয়ে বিজেপি সব সময় বলছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আপত্তিতেই মূলত তিস্তা চুক্তি আটকে আছে।

একটানা তৃতীয়বার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হওয়ায় নরেন্দ্র মোদিকে গত মঙ্গলবার পাঠানো অভিনন্দনবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেন- ভারতের সঙ্গে জোরালো বন্ধুত্ব অব্যাহত থাকবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ। টানা তৃতীয়বারের মতো ভারতে সরকার গঠনের সুযোগ পাওয়ায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট নেতা মোদিকে অভিনন্দনবার্তা পাঠান শেখ হাসিনা। নরেন্দ্র মোদির উদ্দেশে শেখ হাসিনা লিখেন- ‘বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের নেতা হিসেবে আপনি ভারতের জনগণের আশা ও আকাঙ্ক্ষা ধারণ করছেন। এই সুস্পষ্ট বিজয় আপনার নেতৃত্ব, অঙ্গীকার ও দেশের প্রতি নিরলস আত্মত্যাগের প্রতি ভারতের জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রমাণ। আপনি যখন টানা তৃতীয় মেয়াদে বিরল দায়িত্ব শুরু করতে যাচ্ছেন, তখন আমার দৃঢ়বিশ্বাস, আমাদের বন্ধুত্ব ও নিবিড় সম্পর্ক সব খাতেই অব্যাহত থাকবে।’ বাংলাদেশ ভারতের বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে দুই দেশের জনগণের মঙ্গলের পাশাপাশি সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ অঞ্চলের জন্য একসঙ্গে কাজ করা অব্যাহত রাখবে বলে অভিনন্দনবার্তায় শেখ হাসিনা আশ্বাস দেন। ভারতের জনগণের অব্যাহত শান্তি, উন্নতি ও সমৃদ্ধি কামনা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগদানকে ভারত-বাংলাদেশের বহুদিনের সৌহার্দ্য, বন্ধুত্ব, সম্প্রীতি ও সহযোগিতার পারস্পরিক কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে দেখছেন অনেকে। কারণ এবারই প্রথম বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। এই সফর অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভারত-বাংলাদেশের গভীর সম্পর্কের প্রতিফলন বলে ভাবছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। জানা গেছে, ভারতে ২০১৪ ও ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেননি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কাকতালীয়ভাবে দুবারই মোদির শপথ অনুষ্ঠানের সময় তার পূর্বনির্ধারিত জাপান সফর ছিল। তাই প্রধানমন্ত্রীর এই সফর বাংলাদেশের জন্য নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছে। নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। মোদির শপথ অনুষ্ঠানে যোগদান করে বাংলাদেশে কী পেল বা না পেল, এর চেয়ে বড় সত্য হলো বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের সরব উপস্থিতি, যা সবার নজর কাড়ছে। আগামীতে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বাংলাদেশ যে একটি বড় ফ্যাক্টর হবে, এটি এখন প্রায় ধ্রুব সত্যের মতো। ভবিষ্যতে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক কতটুকু সুসংহত হবে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।

নতুন মন্ত্রিসভায় কারা যোগ দিচ্ছেন, সেই তালিকা চূড়ান্ত করতে গতকাল প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে বিজেপি সংসদ সদস্যদের এক বৈঠকের আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী, বিজেপি গুরুত্বপূর্ণ চার মন্ত্রণালয়ের একটিও শরিকদের ছাড় দেওয়া হয়নি। পররাষ্ট্রনীতির বিশেষজ্ঞ ও দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে (জেএনইউ) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সাবেক অধ্যাপক ড. বলদাস ঘোষাল বলেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি দেশের ভেতরে তার কর্তৃত্ব কম-বেশি যাই থাকুক, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের যে উন্নতি হয়েছে, সেটাকে কোনোভাবেই নষ্ট হতে দেবেন না নরেন্দ্র মোদি।

উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে ১০ দিন ও ২০১৯ সালে সাত দিনের মাথায় শপথগ্রহণ করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায়নি। জোটের ভরসায় ক্ষমতায় থাকতে হবে এবারের বিজেপিকে। এনডিএ জোট শরিকদেরকে নিয়ে সরকার গঠন করতে হয়েছে।