শেষ হলো উপজেলা পরিষদ নির্বাচন

প্রভাব ফেলতে পারেনি জনমনে ভোটের হার নিয়ে হতাশায় ইসি

প্রকাশ : ১০ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আরিফুল ইসলাম

ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের শেষ ধাপের ভোট হয়েছে গতকাল। গতকাল সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ভোটগ্রহণ চলে। আগের চার ধাপের মতো এ ধাপেও ভোটারদের তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এবার উপজেলা ভোটে সব থেকে কম আগ্রহ ছিল ভোটারদের। এছাড়া সব থেকে কম ভোটও পড়েছে এবারের ভোটে।

ভোটার উপস্থিতি কম নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, এবার উপজেলা ভোটে রাজনৈতিকভাবে তো ব্যাপক অংশগ্রহণ হয়নি। যখন রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক অংশগ্রহণ হয়, তখন ভোটারদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা বেড়ে যায়। স্বাভাবিকভাবে সেদিক থেকে এটি একটি কারণ হয়ে থাকতে পারে। আর ভোটারদের কেন্দ্রে আনার দায়িত্ব হচ্ছে প্রার্থীদের। প্রার্থীরা তাদের কাছে আবেদন জানাতে পারে। এতে ভোটারা কতটুকু সাড়া দেবে, এটা তাদের ওপর নির্ভর করে। তারা রাজনৈতিকভাবে সচেতন। তারা সেটা বিবেচনা করতে পারে। তবে আমাদের জন্য সেটা বিবেচ্য নয়।

সিইসি বলেন, আমাদের জন্য বিবেচ্য হচ্ছে ভোটটা যেন শান্তিপূর্ণভাবে, সুষ্ঠুভাবে হয় এবং ভোটার যারা তারা যেন শান্তিপূর্ণভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। সেই দিকটা আমরা বিশেষ করে জোর দিয়েছি। কোনো কিছুই স্থির থাকে না। আশাকরি এটা ইম্প্রুভ হবে।

ভোট পড়ার হার নিয়ে তিনি বলেন, ভোট পড়ার হার ৬০ শতাংশ কিংবা ৭০ শতাংশ যদি হতো তাহলে আপনাদের মতো আমরাও সন্তোষ্ট হতাম। আশাকরি মানুষ আগামীতে আরো সচেতন হবে এবং সুশাসনের বিষয় নিয়ে আমাদের জনগণকে উপলব্ধি করাতে হবে এবং তারা সুশসানের যে গণতান্ত্রিক চেতনা তারাও হয়তো উপলব্ধি করে ভোটমুখী হবেন।

ইসি কর্মকর্তরা জানায়, চারটি ধাপে উপজেলা নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে আরেকটি ধাপ বেড়েছে। গতকাল পঞ্চম ধাপে ১৯টি উপজেলায় নির্বাচন হয়েছে। এ ধাপে ভোট পড়েছে ৪৩ দশমিক ৯১ শতাংশ। ৪৯৫টি উপজেলার মধ্যে এ পর্যন্ত ৪৬৯টিতে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। ২৬টি উপজেলা নির্বাচন বাকি আছে। এর মধ্যে কয়েকটি এখনো মেয়াদপূর্তি হয়নি। আদালতে নির্দেশনার কারণে কয়েকটি স্থগিত রয়েছে। যথা সময়ে ওগুলো করা হবে।

সূত্র জানায়, ধীরে ধীরে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ওপর মানুষের আগ্রহের কমতি দেখা যাচ্ছে। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তুলনায় সদ্যসমাপ্ত ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদে মানুষের আগ্রহ দেখা যায়নি। ইসির পক্ষ থেকে তেমন ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এর আগে ২০১৯ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত ৪৪৫টি উপজেলা নির্বাচনে গড়ে ভোট পড়ার হার ছিল ৪০.৪৯ শতাংশ। ওই হিসাবে এবার ভোটার উপস্থিতি কমেছে।

জানা যায়, চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে ভোট পড়ে ৪১.৮ শতাংশ। এর মাত্র চার মাস পর অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোট পড়ল ৩৬.১৩ শতাংশ। জাতীয় সংসদের চেয়ে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সাড়ে ৫ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি কম ছিল। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ৬১ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছিল। এবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার জন্য বড় একটি রাজনৈতিক দলের (বিএনপি) অংশ না নেওয়াকে অন্যতম বড় কারণ বলে মনে করছে ইসি।

উপজেলা নির্বাচন জৌলুস হারিয়েছে বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, নির্বাচনে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও উৎসবমুখর পরিবেশ থাকার কথা, এর কোনো কিছুই উপজেলা নির্বাচনে দেখা যায়নি। আমার মতে, এ নির্বাচনটি হলো ভোটার নেই, বিরোধী দল নেই এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাও নেই। নির্বাচন যে নির্বাসনে চলে গেছে, এটা এরই প্রতিফলন। এর মূল কারণ হলো আস্থাহীনতা।

অতীতের নির্বাচনগুলোর অভিজ্ঞতার ফলে মানুষ নির্বাচনব্যব্যবস্থারর প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। তিনি বলেন, নির্বাচনি ব্যবস্থা ভেঙে গেছে। তাই এ ব্যবস্থার প্রতি জনগণের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। আস্থাহীনতার কারণে বিরোধী দলগুলোও নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। তিনি আরো বলেন, আমরা ভোটপাগল জাতি। এখন ভোটখরায় ভুগছি। আমরা ভোটপাগল থেকে ভোটখরার জাতিতে পরিণত হয়েছি। নির্বাচন নির্বাসনে চলে গেছে।

নির্বাচন পরিচলনা শাখা জানায়, নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হলেও সহিংসতা কম হয়েছে। পাঁচ ধাপের উপজেলা নির্বাচনে ১৭ জন চেয়ারম্যান, ২৫ জন ভাইস চেয়ারম্যান ও ২৫ জন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মিলিয়ে সর্বমোট ৬৭ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৯ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শুধু চেয়ারম্যানই নির্বাচিত হয়েছিলেন ১০৭ জন। এছাড়া এবারের নির্বাচনে সহিংসতাও তুলনামূলক কম হয়েছে। এ হিসাবেই উপজেলা নির্বাচনে নিজেদের সাফল্য দেখছে ক্ষমতাসীন দল।

নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, প্রার্থীসংখ্যা বেশি হলে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়। প্রার্থীরাই তাদের জয়ের স্বার্থে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসেন। এ কারণে নির্বাচনে ভোটও বেশি পড়ে। কিন্তু এবারের নির্বাচনে এর ব্যতিক্রম দেখা গেছে। প্রতিটি ধাপেই বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের লাইন দেখা যায়নি।

যদিও নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, প্রথম ধাপের ১৩৯ উপজেলায় ৩৬.১০, দ্বিতীয় ধাপে ১৫৬ উপজেলায় ৩৭.৫৭, তৃতীয় ধাপে ৮৭ উপজেলায় ৩৬.১০ এবং চতুর্থ ধাপে ৬০ উপজেলায় ৩৪.৭৭ শতাংশ ভোট পড়েছে। গড় ভোট পড়ার হার ৩৬.১৩ শতাংশ।