ঢাকা ১১ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

টাকা হাতবদলে স্বস্তিতে প্রান্তিক খামারিরা

ঈদুল আজহায় চাঙা অর্থনীতি

ঈদুল আজহায় চাঙা অর্থনীতি

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গত সোমবার পালিত হলো- ঈদুল আজহা। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশের বাজারে হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। যোগাযোগ খাতের পাশাপাশি কোরবানির পশু কেনাকাটায় অর্থনীতির চাকা চাঙা হয়ে উঠেছে। জানা গেছে, প্রত্যেক বছরের মতো এবারেও কোরবানির ঈদে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার অর্থনীতির বাজার ধরা হয়। যার মধ্যে কোরবানির পশু কেনাকাটায় ৮৫ শতাংশ লেনদেন হয়েছে। পশু কেনাকাটায় উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের বিপুল অঙ্কের টাকা হাতবদল হয়ে প্রান্তিক খামারিদের কাছে গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের মুসলমানদের দুটি ধর্মীয় উৎসবের একটি ঈদুল ফিতর, অন্যটি ঈদুল আজহা। ঈদুল ফিতরে পোশাক কেনাকাটার ধূম থাকলেও ঈদুল আজহায় কোরবানির পশু কেনাকাটায় ধূম পড়ে। এতে প্রান্তিক খামারিরা লাভমান হোন। সুতরাং দুটি ঈদ কেন্দ্র করে দেশের অর্থনীতির চাকা চাঙা হয়ে ওঠে। শহর থেকে গ্রাম এবং গ্রাম থেকে শহরে মানুষ যাতায়াতে পরিবহন খাতও চাঙা হয়। শুধু বাস নয়, ট্রাক মালিকদেরও ভালো ব্যবসা হয়। ট্রলারে গরু-ছাগল পরিবহনও বেড়ে যায়। এভাবেই ঈদের আগে-পরে কয়েকদিন সড়ক ও নৌপথ ব্যস্ত থাকে।

এবার রাজধানীর কয়েকটি কোরবানির পশুর হাট ঘুরে দেখা গেছে, গো খাবারের দাম বাড়ায় পশুর দাম বাড়তি ছিল, যা মূল্যস্ফীতির হারের অন্তত দ্বিগুণ বলে মনে হয়েছিল। কারণ খামারে গরু পালনের ব্যয় নিয়ে আলোচনা হয়ে আসছিল, অনেকদিন ধরেই। কিন্তু কোরবানির পশুর দাম বাড়ায় গরু না পারলে ছাগল, ভেড়া এবং তা না পারলে ভাগেও কোরবানি দিয়েছেন মুসল্লিরা। তাই অর্থনৈতিক সংকটকালেও কোরবানি দেওয়া পশুর সংখ্যা খুব একটা কমতে দেখা যায়নি। কোরবানি ঈদ ঘিরে প্রবাসী আয় লাফিয়ে বেড়েছে। হুন্ডিতেও প্রবাসী রেমিট্যান্স পাঠানো বেড়ে যায়। আর এর প্রভাব সমাজ-অর্থনীতিতে পড়েছে।

পরিসংখ্যান ব্যুরার হিসাব মতে, ঈদুল আজহায় দেশে বছরে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ গরু ও ৭০-৭৫ লাখ খাসি কোরবানি হয়। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ)-এর মতে, ২০২৩ সালে ৮০-৮৫ লাখ গরু ও ৭০ লাখ খাসি কোরবানি হয়। গরুপ্রতি গড় মূল্য ৬০ হাজার টাকা দাম ধরলে ৮৫ লাখ গরু বাবদ লেনদেন হয়েছিল ৩৪ হাজার কোটি টাকা এবং ৭০ লাখ খাসি (গড়ে ৮০০০ টাকা দরে) ৮ হাজার কোটি টাকা অর্থাৎ পশু কোরবানিতে প্রায় ৪০-৪২ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছিল। ব্যবসায়ীদের হিসাবে, এ বছর ১ কোটি ৭ লাখ চাহিদার বিপরীতে কোরবানিযোগ্য পশু ছিল ১ কোটি ৩০ লাখ। যার মধ্যে গরু ৫৫ লাখের বেশি। পশুর হাটে ১ থেকে দেড় লাখ টাকা দামের গরুর চাহিদা বেশি ছিল। বাকিটা ছাগল, ভেড়া ও অন্যান্য। বাজারে বেশিরভাগ ছাগল ও ভেড়া বিক্রি হয়েছে ১২ থেকে ১৮ হাজার টাকা। কোরবানি ঈদের পশু কেনাবেচা হয়েছে প্রায় ৬৫ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকার। এর সঙ্গে পশু পরিবহন, খাদ্য, কসাই ও আনুষঙ্গিক খরচ ৫ হাজার কোটি টাকা। কাঁচা চামড়া-লবণ ও শ্রমিকের মজুরি ১ হাজার কোটি টাকা। পেঁয়াজ, রসুন ও মসলার বাজার ৮ হাজার কোটি টাকার। ফ্রিজ-ইলেকট্রনিক্স পণ্য, পোশাক, পর্যটন ও যাতায়াত খরচ ১০ হাজার কোটি। তবে এসবের ভিড়ে পোশাক ও বাহারি পণ্য কেনা কাটার বাজারে ছিল ভাটা।

মাগুরার মুহাজিদ খন্দকার নিজের খাবার থেকে ২৭টি গরু গাবতলীর হাটে নিয়ে আসেন। এরইমধ্যে ২৫টি গরু বিক্রি করেছেন। তার গরুগুলো ১ লাখ থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে বিক্রি করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের এলাকায় এখন অনেক ছোট ছোট খামার গড়ে উঠেছে। ওই সব খামারে কোরবানির জন্য গরু লালন-পালন করা হয়। গরু বিক্রি করে অনেক পরিবারে আর্থিক সঞ্চলতা ফিরেছে। ২৭ বছর বয়সি শিমুল রহমান ৫টি গরু নিয়ে ফরিদপুর থেকে যাত্রাবাড়ী শনিরআখড়া হাটে এসেছিলেন। তিনি কোরবানিতে বিক্রির জন্য ৫টি গরু লালন-পালন করেছিলেন। তিনি বলেন, হাটে কোরবানির পশুর চাহিদা ছিল, আমি ৫টি গরু বিক্রি করতে পেরেছি। আমার মতো অনেকেই এখন ছেলে-মেয়ের বিয়ে, লেখাপড়া বা ঘর মেরামতসহ নানা কাজে বাড়তি টাকার আশায় গরু ও মহিষ লালন-পালন করেন। ছাগলে লাভ কম তাই গরুর প্রতি আগ্রহ বাড়ছে।

বাংলাদেশ ডেইরি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. ইমরান হোসেন বলেন, দেশে প্রান্তিক কৃষক থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে ১৭ লাখ ছোট বড় খামার আছে। ১২ লাখ হলেন একমদম প্রান্তিক কৃষক। এর সঙ্গে এক কোটি লোক যুক্ত। এটা গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখাছে। দেশে বছরে যে ১ কোটি ২০ লাখ গরুর চাহিদা- তারমধ্যে ৫০-৫৫ লাখ গরু কোরবানির সময় লাগে। ফলে কোরবানির ঈদে অর্থনীতি চাঙা হয়ে ওঠে। ঈদের সময় ৭৫ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। তারমধ্যে ৬০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন গবাদি পশুকেন্দ্রিক।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, কোরবানির ঈদের অর্থনীতির আকার ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ৭৫ হাজার কোটি টাকার হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংকের পুরোনো হিসাব। কারণ গবাদিপশু ছাড়াও এরসঙ্গে আরো অনেক বিষয়যুক্ত হয়েছে। এখানে মসলার বাজার আছে, কসাইদের আয় আছে, পশু খাদ্যের ব্যবসা আছে। আর কম হলেও এই ঈদেও মানুষ নতুন পোশাক কেনে। গৃহস্থ, ছোট ছোট কৃষক চার-পাঁচটি গরু লালনপালন করে কোরবানির বাজারে বিক্রি করে। এখান থেকে বছরে সে ভালো পরিমাণ অর্থ আয় করে। যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙা করছে।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুঈদ রহমান বলেন, আমার বিবেচনায় কোরবানির ঈদের অর্থনীতির এখন ১ লাখ কোটি টাকার কম হবে না। ঈদসহ যেকোনো উৎসবেই বাংলাদেশের অর্থনীতি চাঙা হয়। কিন্তু কোরবানির ঈদের বিশেষত্ব হলো গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা হয়।

বছরের অন্য যেকোনো মাসের চেয়ে ঈদের আগের মাসে রেমিট্যান্স আসে সবচেয়ে বেশি। সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী এবং গার্মেন্টস শ্রমিক ও সারা দেশের দোকান কর্মচারীদের বেতন-বোনাসযুক্ত হয় ঈদ বাজারে। রোজার ঈদে পোশাক ও খাদ্যপণ্যে মানুষ বেশি ব্যয় করে। তবে ঈদুল আজহায় পশু কেনাকাটায় সবচেয়ে বেশি টাকা লেনদেন হয়। একইভাবে লবণ, মসলা, ছুরি-চাকু, পরিবহন, ভ্রমণবিনোদন বাবদও বেশ মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয়। অর্থনীতিবিদের মতে, ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতির গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। কোরবানির আগে ও পরে কয়েকদিন বিচ্ছিন্নভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। পশুর হাট থেকে শুরু করে ব্যাংকপাড়া এবং পণ্যবাজার থেকে কামারবাড়ি-সবখানেই ব্যস্ততা ছিল।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, যদিও অতি উচ্চ মূল্যস্ফীতি। দেশের মানুষের আর্থিক টানাটানি আছে। এরপরও কোরবানির ঈদ ঘিরে দেশের অর্থনীতি চাঙা হয়। কারণ এ সময় অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের অধিকাংশই চলে ঈদকে ঘিরে। আর এ কারণেই প্রতি বছরই দেশের অর্থনীতিতে ঈদের গুরুত্ব বাড়ছে।

অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জানান, কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে এলোমেলোভাবে বিশাল পরিমাণের টাকা দেশের বাজারে যুক্ত হয়। এর সঠিক হিসাব রাখা খুবই কঠিন, তবে এই বিপুল পরিমাণের অর্থ পরিকল্পিতভাবে দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত করা গেলে তা জিডিপিকে সমৃদ্ধ করবে। একইসঙ্গে সরকারের রাজস্ব ভাণ্ডারও সমৃদ্ধ হবে।

ঈদের আগে বেশি রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। চলতি মাসের প্রথম ১২ দিনে প্রবাসীরা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে ১৪৬ কোটি ডলার পাঠান। কোরবানির ঈদে প্রবাসীরা কত কোটি ডলার দেশে পাঠালেন, এর পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে কিছুটা অপেক্ষা করতে হবে। তবে গত মাসের তুলনায় চলতি মাসের প্রথম ১২ দিনে প্রবাসী আয় আসার গড় হার বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসের প্রথম ১২ দিনে এসেছে দৈনিক গড়ে ১২ কোটি ১৭ লাখ ডলার। অর্থাৎ গত মাসের তুলনায় চলতি মাসের শুরুতে দিনে গড়ে প্রায় ৫ কোটি ডলার বেশি এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, চলতি মাসের ১ থেকে ১২ জুন পর্যন্ত মোট প্রবাসী আয় এসেছে ১৪৬ কোটি ডলার। গত বছরের জুনের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৮৪ কোটি ডলার। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে প্রবাসী আয় বেড়েছে ৬২ কোটি ডলার বা প্রায় ৭৪ শতাংশ। প্রবাসী আয় আসার এ ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি মাস শেষে প্রবাসী আয় ২৫০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন ব্যাংক খাত-সংশ্লিষ্টরা।

কোরবানির পশুর চামড়া অর্থনীতিতে রপ্তানি বাণিজ্যে, জুতা, পাদুকা শিল্প পোশাক, হস্তশিল্পে উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই চামড়া সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, বিক্রয় ও ব্যবহার উপলক্ষ্যে অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের কর্মযোজনা সৃষ্টি হয়। এই চামড়া সংগ্রহ সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে ১৬ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ও ব্যবসা জড়িত। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো প্রতি বছর প্রায় ৫০০ কোটি বিশেষ ঋণ দিয়ে থাকে, বেসরকারি ব্যাংকগুলো ৮০-১০০ কোটি টাকা ঋণ দেয়।

বাংলাদেশে রপ্তানি খাতে চামড়ার অবস্থা বিশ্বের তৃতীয় স্থানে রয়েছে। কোরবানির ওপর ভর করেই টিকে আছে বিপুল সম্ভাবনার এ খাতটি। বাংলাদেশ থেকে ইতালি, নিউজিল্যান্ড, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়। ব্যবসায়ীদের মতে, প্রতি বছর দেশে দেড় কোটিরও বেশি পশুর চামড়া পাওয়া যায়। এর প্রায় ৬০ শতাংশই আসে কোরবানির পশু থেকে। চামড়া ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ খাতের মূল বাজার ৪-৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত অন্যান্য বাজারসহ এ খাতে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়। এ বাবদ ট্যানারি মালিকরা বিভিন্ন পর্যায়ের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের শত শত কোটি টাকা দাদন দিয়ে থাকেন। সংশ্লিষ্টদের দাবি, কোরবানির সময় চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে ১ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা জড়িত।

রাজধানীতে কোরবানির পশুর চামড়া বেচাকেনা হয়েছে। গতকাল আড়তগুলোতে রাজধানীর বাইরে থেকে ট্রাক করে চামড়া আসছে। পোস্তার আড়তদার মোখলেছুর রহমান বলেন, ঢাকার বাইরের চামড়াগুলো লবণযুক্ত ও লবণ ছাড়া দু’ভাবে এসেছে। গরুর চামড়া ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় কেনা হচ্ছে।

ছাগলের চামড়া কেনার বিষয়ে মোখলেসুর রহমান বলেন, ঈদের সময় ছাগলের চামড়া কিনে তা প্রক্রিয়া করার মতো ট্যানারিতে জায়গা নেই। এজন্য ট্যানারিতে ছাগল-ভেড়ার চামড়া নিতে চায় না। আমরা কয়েকজন ২০০ পিস চামড়া কিনেছি। এগুলো এখন গলার কাঁটা হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত