ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর

শেখ হাসিনাকে নয়াদিল্লিতে উষ্ণ অভ্যর্থনা

* নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক আজ * প্রথম দিন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত
শেখ হাসিনাকে নয়াদিল্লিতে উষ্ণ অভ্যর্থনা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে গতকাল শুক্রবার বিকালে নয়াদিল্লি গিয়েছেন। তাকে ভারতের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল এবং বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. মুস্তাফিজুর রহমান বিমান বন্দরে অভ্যর্থনা জানান। পরে সন্ধ্যায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর শেখ হাসিনার সঙ্গে তার অবস্থানস্থলে বৈঠক করেন।

সূত্র জানায়, লোকসভা নির্বাচনে জয়ী বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠনের পর ভারতে কোনো সরকার প্রধানের এটিই প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফর। এ সফর নিয়ে দুই দেশের মধ্যে ব্যাপক অগ্রহ দেখা গিয়েছে। সফরে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে। এসব চুক্তির ফলে উভয় দেশ লাভবান হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় জানায়, সফরকালে উভয় প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে একান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে এবং তারপর প্রতিনিধি পর্যায়ে আলোচনা হবে। উভয় দেশের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরো জোরদার করতে ঢাকা ও নয়াদিল্লির মধ্যে বেশ কিছু চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হবে।

আজ শনিবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানাতে রাষ্ট্রপতি ভবনে লাল গালিচা বিছানো হবে। এ সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আনুষ্ঠানিকভাবে শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানাবেন এবং দু’দেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গার্ড অব অনার দেয়া হবে এবং তিনি গার্ড পরিদর্শনও করবেন।

এরপর তিনি রাজঘাটে ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। সেখানে পরিদর্শন বইয়ে তিনি স্বাক্ষর করবেন। একই দিন শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে একান্ত বৈঠক এবং প্রতিনিধি পর্যায়ে আলোচনার জন্য হায়দরাবাদ হাউজে যাবেন।

উভয়েই সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করবেন। এরপর দুই প্রধানমন্ত্রী বিবৃতি দেবেন। হায়দরাবাদ হাউজে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী আয়োজিত ভোজসভায় যোগ দেবেন তিনি।

বিকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখারের সঙ্গে তার সচিবালয়ে সাক্ষাৎ করবেন। সন্ধ্যায় শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি ভবনে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে দেখা করবেন।

স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টায় প্রধানমন্ত্রী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে পালাম বিমানবন্দর থেকে ভারতের রাজধানী ত্যাগ করবেন এবং রাত ৯টায় ঢাকায় অবতরণ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী সফরে ভারতের সাথে আগে হওয়া ঋণচুক্তির দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য সমঝোতা স্মারক বা চুক্তি স্বাক্ষর হতে পারে। এ ছাড়া বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরেই চাইছিল যে, পেঁয়াজ বা চিনির মতো জরুরি দরকারি পণ্যগুলোর বাংলাদেশে আমদানির সুযোগ যাতে নিরবচ্ছিন্ন থাকে ভারত যেন তা নিশ্চিত করে। এর আগে অনেকবারই দেখা গেছে পেঁয়াজসহ কিছু পণ্যের ওপর ভারত আকস্মিকভাবে রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ঘটনায় বাংলাদেশের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। এবার এ নিয়ে আলোচনা ও সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও বহুল আলোচিত তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা নতুন করে আলোচনায় আসার প্রেক্ষাপটে দুই প্রধানমন্ত্রীর আলোচনাতেও এটি আসতে পারে।

কারণ চীন এ প্রকল্পে অর্থায়ন করতে চাইছে অনেক দিন ধরেই। আবার ভারতও জানুয়ারির নির্বাচনের পরে এ প্রকল্পে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এখানে চূড়ান্তভাবে কী হবে বলা মুশকিল। হয়তো বাংলাদেশে চীনের ফুটপ্রিন্ট বেড়ে যাচ্ছে এ নিয়ে ভারতের তরফ থেকে উদ্বেগও আসতে পারে। আবার বাংলাদেশ হয়তো ভারতকে বুঝিয়ে বলতে পারে যে, এ নিয়ে ভারতের নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের কোনো কারণ থাকবে না। সেক্ষেত্রে একটা লিমিটেড ওয়েতে (সীমিতভাবে) চীনকে তিস্তা পরিকল্পনায় কাজ করতে দিতে উভয় পক্ষ একমতও হতে পারে।

সূত্র জানায়, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের অস্বস্তিকর সম্পর্কের কারণে এ অঞ্চলের ভূ-রাজনীতি এখন জটিল আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্কের মাত্রা এবং গভীরতা বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের ওপরে বর্তমানে প্রভাব ফেলে। ফলে এখানে ভারসাম্য রক্ষা করা ক্রমেই জটিল হয়ে পড়ছে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক একজন কূটনীতিক বলেন, দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বিষয়, যেমন- পানি, সীমান্তে হত্যা, বাণিজ্য, কানেক্টিভিটি, বিদ্যুৎ, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা চলমান ঘটনা। এগুলো নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি, ভারতের রাজনীতি ও আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি- এই তিন ক্ষেত্রেই বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। তিনটি বিষয়ই বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে। আমার ধারণা, তিনটি বিষয় নিয়ে দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে আলোচনা স্বাভাবিক কারণেই হতে পারে।

ভারতের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন : জোটবদ্ধভাবে ভারতে সরকার গঠন করেছে বিজেপি। এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ার কারণে জোটসঙ্গী দলগুলোর মধ্যে তেলেগু দেশাম পার্টি এবং বিহারের নিতীশ কুমারের জনতা দলের (ইউনাইটেড) ওপর অনেকটা নির্ভর করছে ভারত সরকারের ভাগ্য। এ পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণভাবে নিজেদের সক্ষমতা দেখানোর জন্য বাংলাদেশসহ অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের সহায়তা চাইতে পারে বিজেপি। বাংলাদেশের আরেকজন সাবেক কূটনীতিক এ বিষয়ে বলেন, ২০১৪ সালে ২৮২ এবং ২০১৮ সালে ৩০৩ আসন পেয়ে এককভাবে সরকার গঠন করেছিল বিজেপি। এবার এককভাবে আসন সংখ্যা ২৪০-এ নেমে আসার কারণে জোটবদ্ধভাবে সরকার গঠন করেছে বিজেপি।

শরিক দলগুলো এবং গোটা ভারতের কাছে স্বাভাবিকভাবে নিজেদের সবল প্রমাণ করার জন্য প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্কের বিষয়টি বড় করে দেখাতে চাইবে বিজেপি বলে মনে করেন এই সাবেক কূটনীতিক।

তিনি বলেন, শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি উভয়ই ঝানু রাজনীতিবিদ এবং তাদের সরকার পরিচালনার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। বিজেপির অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রতিবেশীকে কাছে পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে আলোচনা এবং এ বিষয়ে বাংলাদেশের পূর্ণ সহযোগিতা চাইতে পারেন নরেন্দ্র মোদি।

আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি : ভারতের সঙ্গে চীনের রাজনৈতিক সম্পর্কে অস্বস্তি রয়েছে এবং সেটি গোপন বিষয় নয়। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে বড় দেশ হিসেবে ভারতের স্বাভাবিক একটি প্রভাব-বলয় আছে। কিন্তু পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীন ওই প্রভাব বলয়ে ভাগ বসাতে চায়, যা ভারতের জন্য উদ্বেগের বিষয়।

এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বলেন, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে প্রভাব বলয় বাড়ানোর জন্য আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে চীন এখন অনেক বেশি তৎপর। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। অন্য দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা বা মালদ্বীপে বড় ধরনের সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করছে চীন। সীমান্ত নিয়ে ভারত ও চীনের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধ হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে ডোকলাম সংঘর্ষের পর দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক কিছুটা শীতল হয়ে পড়ে জানিয়ে তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে বাংলাদেশের সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ভারতের। বেইজিং বা অন্য যে কোনো দেশের কারণে এই সম্পর্কে ভিন্ন কোনো প্রভাব পড়ুক, এটি ভারতের কাম্য নয়।

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, তিস্তা প্রকল্প নিয়ে চীন প্রথমে আগ্রহ প্রকাশ করে। পরবর্তী সময়ে এই প্রকল্পে বাংলাদেশকে সহায়তা করার জন্য ভারতও আগ্রহ দেখায় এবং তারা বাংলাদেশকে বিষয়টি জানায়।

শহীদুল হক আরো বলেন, ভারত ও চীনের পাশাপাশি জাপানও এ অঞ্চলের প্রতি আগ্রহী। বাংলাদেশে কক্সবাজারের মাতারবাড়িকে কেন্দ্র করে যে গভীর সমুদ্রবন্দর ও অন্যান্য লজিস্টিক সুবিধা গড়ে উঠছে, সেটিতে বিনিয়োগ করছে জাপান। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে, উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং এর সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলো, নেপাল এবং সেইসঙ্গে ভুটানও রয়েছে।

প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়ে এই সাবেক পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বাংলাদেশের কাছে প্রতিরক্ষাসামগ্রী বিক্রি করতে আগ্রহী ভারত এবং এ জন্য ৫০ কোটি ডলারের লাইন অব ক্রেডিটও দিয়েছে তারা। এই প্রতিরক্ষা সহযোগিতা শুধু বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে হবে না, বরং এর যে বড় ক্যানভাস অর্থাৎ চীন, জাপান, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ, সেটির আলোকে বিবেচনা করতে হবে। আঞ্চলিকভাবে ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং ওই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দুই দেশের (বাংলাদেশ-ভারত) সহযোগিতা ও ভূমিকা কী হবে, সেটি নিয়ে দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে আলোচনা হওয়া খুবই স্বাভাবিক বলে জানান তিনি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত