পশ্চিম-দক্ষিণ মংডুতে উড়ছে ধোঁয়ার কুণ্ডলী

ভেসে আসছে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ

প্রকাশ : ২৩ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংঘাতের জের ধরে প্রকম্পিত সীমান্ত উপজেলা টেকনাফের মানুষ। কখনো দিনে আবার কখনো রাতে বিস্ফোরণের বিকট শব্দে সীমান্ত এলাকার মানুষ চরম অস্বস্তিকর জীবন অতিবাহিত করছেন। একই সঙ্গে রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের পশ্চিমণ্ডদক্ষিণ গ্রামগুলোতে দেখা মিলছে আগুনের ধোঁয়ার কুণ্ডলিও। টেকনাফ উপজেলার সীমান্ত এলাকার লোকজন ও জনপ্রতিনিধিদের দেয়া তথ্য বলছে, গত ১৮ জুন মঙ্গলবার সকাল থেকে মিয়ানমারের ওপার থেকে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ ভেসে আসতে শুরু করে। যা গতকাল শনিবার বিকাল ৪টা পর্যন্ত থেমে থেমে অব্যাহত রয়েছে। এর আগে ১৫ জুন শনিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে ছয়টি ও রাত সাড়ে ১২টার দিকে থেমে থেমে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গিয়েছিল। ১৬ জুন রোববার ও ১৭ জুন সোমবার (ঈদের দিন) আর কোনো শব্দ শোনা যায়নি। ঈদের পরের দিন ১৮ জুন মঙ্গলবার থেকে আবারো বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছে থেমে থেমে। সর্বশেষ গত শুক্রবার থেকে মাঝরাতে মর্টার শেল ও শক্তিশালী গ্রেনেড বোমার বিস্ফোরণে ঘুম ভাঙল টেকনাফ সীমান্তের বাসিন্দাদের।

গত শুক্রবার রাত দেড়টা পর থেকে মিয়ানমার সীমান্তের ওপার থেকে বিকট শব্দ ভেসে আসে। মাঝরাত থেকে গতকাল শনিবার বিকাল ৪টা পর্যন্ত থেমে থেমে মুহুর্মুহু বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। অসংখ্য বিকট শব্দের পাশাপাশি থেমে থেমে অন্তত ৪০-৫০টির মতো মর্টার শেল ও শক্তিশালী গ্রেনেডের শব্দ পাওয়া যায়। এতে টেকনাফ উপজেলার পৌরসভা, টেকনাফ সদর ও সাবরাং ইউনিয়নের নাইট্যংপাড়া, চৌধুরীপাড়া, জালিয়াপাড়া, পল্লানপাড়া, অলিয়াবাদ, কুলালপাড়া, খাংকার ডেইল, টেকনাফ সদরের ডেইলপাড়া, নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, সাবরাং পানছড়িপাড়া, সিকদারপাড়া, মগপাড়া, আচারবনিয়া, ঝিনাপাড়া, শাহপরীরদ্বীপ জালিয়াপাড়া, উত্তরপাড়া ও মিস্ত্রিপাড়াসহ অন্তত ২৭ গ্রামের ঘরবাড়ি কাঁপছে। সাবরাং ইউপির ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোহাম্মদ শরিফ বলেন, গত শুক্রবার মাঝরাত থেকে শনিবার বিকাল পর্যন্ত তিনি প্রায় ৫০-৬০টি মর্টার শেলের শব্দ শুনেছেন। কয়েক মাসের বেশি সময় ধরে সীমান্তে এমন বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। ঘটনাগুলো মিয়ানমারের হলেও এপারের আতঙ্ক যাচ্ছে না। সাবরাং এলাকার বাসিন্দা ও সাবেক জেলা পরিষদের সদস্য শফিক মিয়া বলেন, এলাকার মানুষ ভালোভাবে ঘুমাতেই পারছে না। দিনের বেলা তো যেমন-তেমন। রাতের বেলায় বিকট শব্দেই আতঙ্কে থাকে এলাকার মানুষজন। জনগণের নিরাপত্তায় সেখানে বিজিবি টহল ও তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। পৌরসভার বাসিন্দা এম কায়সার বলেন, মাঝরাতে পর পর বিকট শব্দে ঘরের দরজা-জানালা কেঁপে উঠেছে। ঘুম ভাঙলেও ভয়ে ঘুমাতে পারিনি।

মৌলভীপাড়ার আবদুল করিম বলেন, বার্মা (মিয়ানমার) থেকে প্রথমে আসল যুদ্ধবিমানের শব্দ শোনা গেছে। এর এক-দুই মিনিট পর ভয়ংকর অনবরত কয়েকটি বিকট বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠল মাটি, বাড়িঘরের দরজা-জানালা। এ সময় মংডু শহরের পশ্চিম ও দক্ষিণের গ্রাম থেকে আগুনের কুণ্ডলি দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে গ্রামগুলো বোমায় জ্বলে যাচ্ছে। সীমান্তে বসবাস করা লোকজন জানান, টেকনাফের নাফ নদীর পূর্ব পাশে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপের কাদিরবিল, মংনিপাড়া ও সুদাপাড়া গ্রাম। ওইসব এলাকায় মানুষের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এসব ঘরবাড়িতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। আগুন দেওয়া বাড়িঘরের অধিকাংশের মালিক রোহিঙ্গা নাগরিকরা। রোহিঙ্গাদের উল্লেখযোগ্য অংশ নাফ নদী অতিক্রম করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।

তবে নাফ নদী অতিক্রম করে মিয়ানমারের লোকজনের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে সতর্ক অবস্থায় আছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও কোস্ট গার্ড বাহিনী। গোয়েন্দা নজরদারি, টহলও বাড়ানো হয়েছে। সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নুর হোসেন বলেন, মাঝরাতে পর পর বিকট কয়েকটি শব্দে কেঁপে উঠল বাড়িঘর। প্রথমে মনে হলো ভূমিকম্প পরে শুনতে পেলাম মর্টার শেল ও শক্তিশালী গ্রেনেডের বিকট আওয়াজ। কয়েক কিলোমিটার ব্যবধানের কারণে ওপার থেকে আসা বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শোনা যাচ্ছে।

এতে করে এপারের মানুষগুলোকে আতঙ্কিত করে তুলছে। টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, মর্টার শেল, গ্রেনেড বোমার বিস্ফোরণের শব্দ এবং রাখাইন রাজ্যে এলাকার ঘরবাড়িতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। টেকনাফ-২ বিজিবির ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদী ও সীমান্তে কঠোর অবস্থানে বিজিবি। রাখাইন পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, এটি মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হলেও এপারের মানুষগুলো শান্তিতে থাকতে পারছে না। এমনকি বিকট বিস্ফোরণে তারও ঘুম ভাঙছে বলে জানান। তবে বাংলাদেশ সীমান্তে বিজিবি ও কোস্ট গার্ডের টহল জোরদার করা হয়েছে। কক্সবাজারের টেকনাফ সেন্টমার্টিন নৌরুটে বিকল্প পথে চলছে নৌযান চলাচল। যাত্রী ও জরুরি পণ্য আনা-নেয়ার জন্য টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ হয়ে সেন্টমার্টিনে চলছে এসব নৌযান। গতকাল শনিবার সকালে শাহপরীরদ্বীপ থেকে জরুরি পণ্য নিয়ে কিছু সংখ্যক যাত্রী নিয়ে সেন্টমার্টিন গেছে দুইটি ট্রলার। একই সঙ্গে সেন্টমার্টিন থেকে রোগীসহ ১৫ যাত্রী নিয়ে শাহপরীরদ্বীপ এসেছে দুইটি স্পিড বোট। স্বাভাবিক রুটের চেয়ে বিকল্প রুটটিতে উত্তাল সাগর পাড়ি দিতে হলেও নৌযান চলাচল স্বাভাবিক হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন দ্বীপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান। তিনি জানিয়েছেন, গতকাল শনিবার সকালে শাহপরীরদ্বীপের বদরমোকাম এলাকা হয়ে দুইটি ট্রলার সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে যাত্রা দেয়। ট্রলার দুইটি বেলা ১২টার দিকে দ্বীপে গিয়ে পৌঁছেছে। এই ট্রলার দুইটিতে ৩০০ গ্যাস সিলিন্ডার, কিছু খাদ্য পণ্য ও ৩০-৪০ জন যাত্রী ছিল। এর আগে গত বৃহস্পতিবার দুইটি ট্রলারযোগে দ্বীপের ৩৫ শিক্ষার্থীসহ ৯২ জন যাত্রী নিয়ে দুইটি ট্রলার শাহপরীরদ্বীপে নিরাপদে পৌঁছেছে।

সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান ও স্পিডবোট মালিক সমিতির সভাপতি খোরশেদ আলম জানিয়েছেন, গতকাল শনিবার প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে দ্বীপ থেকে রোগীসহ ১৫ যাত্রী নিয়ে দুইটি স্পিডবোট শাহপরীরদ্বীপ নিরাপদে পৌঁছেছে। এই দুই প্রতিনিধি বিকল্প পথে সীমিত পরিসরে নৌযান চলাচল স্বাভাবিক হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন।

বলেছেন, কোস্ট গার্ড, বিজিবি, নৌবাহিনীর সার্বিক নজরধারী ও নিরাপত্তায় দ্বীপে আসা-যাওয়া স্বাভাবিক হচ্ছে। এতে এখনো কিছুটা আতঙ্ক থাকলেও স্বস্তিতে দ্বীপবাসী। যদিও বিকল্প পথটিতে উত্তাল সাগর পাড়ি দিতে হয়। এতে কিছুটা ঝুঁকিও রয়েছে। তবুও দ্বীপের প্রয়োজনে এটিকে মঙ্গল মনে করছেন তারা। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় টেকনাফ নৌ-পুলিশের দায়িত্বরত পুলিশ পরিদর্শক তপন কুমার বিশ্বাস ‘বিকল্প পথে সেন্টমার্টিন নৌ-যোগাযোগ স্বাভাবিক হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, সেন্টমার্টিনবাসীর সুবিধার্থে সাগরে নৌ-চলাচলের ক্ষেত্রে নৌপুলিশে বিশেষ নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।

মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের কারণে গত ১ জুন বিকালে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে যাওয়া পণ্যসহ ১০ জন যাত্রীর ট্রলারকে নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকা থেকে কয়েকটি গুলি বর্ষণ করা হয়। গত ৫ জুন সেন্টমার্টিনের স্থগিতকৃত একটি কেন্দ্রে টেকনাফ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদের ফলাফল নির্ধারণের জন্য ভোটগ্রহণ করা হয়। ভোট শেষে ফেরার পথে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেটসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ফেরা ট্রলারকে আবারো গুলি করা হলো একই পয়েন্টে। গত ৮ জুন আরো একটি ট্রলারকে গুলি করা হয় একই পয়েন্টে। সর্বশেষ ১১ জুন একটি স্পিডবোটকে লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করা হয়। তবে এই গুলি বর্ষণের ঘটনা বাংলাদেশের অভ্যন্তরের জলসীমায় ছিল। মিয়ানমারের জলসীমা থেকে ট্রলারযোগে এগিয়ে এসেই এই গুলি বর্ষণের ঘটনাটি করা হয়। একই সময় চারবার গুলি বর্ষণের ঘটনায় কোনো হতাহত ছিল না। এই কারণে নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌযান বন্ধ হয়ে যায়। এতে দ্বীপে খাদ্য সংকট ও জরুরি আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলো। কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ১২ জুন জরুরি সভা করে বঙ্গোপসাগরকে ব্যবহার করে যাত্রীর আসা-যাওয়া ও পণ্য নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৩ জুন থেকে টেকনাফের সাবরাং মুন্ডার ডেইল উপকূল ব্যবহার করে যাত্রী আসা-যাওয়া শুরু হলো। ১৪ জুন কক্সবাজার শহর থেকে পণ্য নিয়ে গেল জাহাজ।