ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

থেমে থেমে বৃষ্টি

ভয়াবহ রূপ নিতে পারে ডেঙ্গু

ভয়াবহ রূপ নিতে পারে ডেঙ্গু

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টির পানি যত্রতত্র জমে এডিস মশার বংশ বিস্তারের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করছে। এভাবে চলতে থাকলে এ বছরের জুলাইয়ের শেষের দিকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়বে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এডিস মশার কামড়ে কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলক বাড়ছে। আগেভাগে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপের অভাব থাকলে এবারও ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়বে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, চলতি বছরেও ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বাড়তে শুরু করেছে। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সারাদেশে ৩ হাজারের বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে মারা গেছে ৪১ জন। প্রতি ৮১ জনে একজনের মৃত্যু হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে প্রতি ১৫৬ জনে একজনের মৃত্যু হয়েছিল। ৪১ জনের মধ্যে ২৯ জনেরই মৃত্যু হয়েছে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে মৃত্যু হয় ২৫ জনের। উত্তর সিটিতে চারজনের। ঢাকার বাইরে সর্বোচ্চ আটজনের মৃত্যু হয়েছে বরিশাল বিভাগে। অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এ বছরের জানুয়ারিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ১ হাজার ৫৫৫ জন এবং মারা যান ১৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্ত ৩৩৯ জন এবং মারা যান তিনজন, মার্চে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৩১১ জন এবং মারা যানন পাঁচজন, এপ্রিলে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫০৪ জন এবং মারা যান দুইজন। মে মাসে আক্রান্ত রোগী ৬৪৪ জন এবং মারা যান ১২ জন, জুনের ২০ তারিখ পর্যন্ত আক্রান্ত রোগী ৪৫১ জন এবং মারা যান পাঁচজন। জানা গেছে, এডিস মশা নিধনে আগেভাগেই বিশেষ মনোযোগী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা প্রদানেও বিশেষ ব্যবস্থা নিচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ঢাকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের বড় অংশই দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার সংক্রমিত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই গুরুতর রোগীদের ঢাকায় পাঠানো হয়। সংক্রমণ কমানো না গেলে মৃত্যুও ঠেকানো সম্ভব হবে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, ডেঙ্গুর চারটি ধরনের মধ্যে এ বছর তিনটি ধরনই সক্রিয়। ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেশি হওয়ার এটিও একটি কারণ। প্রথমবার আক্রান্ত হলে তত বেশি সমস্যা হয় না। অনেকে বুঝতেই পারে না। কিন্তু দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বার কিংবা চতুর্থবার আক্রান্ত হলে রোগী ভয়ংকর অবস্থায় চলে যেতে পারে।

কীটতত্ত্ববিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, এখনকার বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রা দুটিই এডিস প্রজননের জন্য উপযোগী। ধারণা করা হচ্ছে, জুলাইয়ের শেষ ভাগে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়বে। তিনি আরো বলেন, দীর্ঘদিন মশা নিয়ে গবেষণা করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এ বছর ডেঙ্গু বেশ ক্ষতিগ্রস্ত করবে। বিশেষ করে ঢাকার বাইরের কিছু জেলায় যেমন- চট্টগ্রাম, বরিশাল, বরগুনা, কক্সবাজার, চাঁদপুর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর ও খুলনায় ডেঙ্গুর ব্যাপক সংক্রমণ হতে পারে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ডেঙ্গুর ভয়াবহতার বিপরীতে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা খুব অপ্রতুল। গ্রামাঞ্চলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে উঠলেও সেখানে যথেষ্ট পরিমাণ জনবল-সরঞ্জাম নেই। চিকিৎসাব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া মৃত্যু কমানো সম্ভব নয়।

সাধারণ ডেঙ্গুর প্রকোপ মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু এবার মে মাসে বৃষ্টিপাত কম হয়েছে। তবে জুলাইয়ের শেষের দিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। গত ২২ এপ্রিল থেকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এডিস মশার বংশ বিস্তার রোধে জনসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধি কাজ করছে। এছাড়া নতুন ওষুধের প্রয়োগ, গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা ও নতুন কিছু ধারণাও এনেছে ডিএনসিসি। এলাকায় এলাকায় লিফলেট বিতরণ, মাইকিং, স্কুলে শিশুদের মধ্যে ডেঙ্গুবিষয়ক বই বিতরণসহ ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতেও জনসাধারণকে সচেতনতার বার্তা দেওয়া হচ্ছে। ডাবের খোসা, ওয়ানটাইম প্লাস্টিকের গ্লাস, চিপসের প্যাকেট, গাড়ির টায়ারে পানি জমে এডিস মশা জন্মাতে পারে- এমন সব বস্তু নগদ অর্থে ক্রয় করছে ডিএনসিসি। এসব কার্যক্রম পরিচালনার জন্য স্থানীয় কাউন্সিলরদের ৫০ হাজার টাকাও করে দেওয়া হয়েছে। এডিস মশা নিধনে পিছিয়ে নেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। সংস্থাটি এরই মধ্যে এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসের মাধ্যমে ডেঙ্গু রোগ নিয়ন্ত্রণে পরিচ্ছন্নতা ও মশক নিধন অভিযান পরিচালনা করছে। দক্ষিণ সিটির আওতাধীন ২৬টি থানা ও ১১টি পুলিশ ফাঁড়িতে অভিযান চালানো হয়। এসব থানা ও পুলিশ ফাঁড়ির মধ্যে রয়েছে- শাহবাগ, রমনা, ধানমন্ডি, কলাবাগান, নিউমার্কেট, মুগদা, শাহজাহানপুর, পল্টন, রামপুরা, খিলগাঁও, সূত্রাপুর, যাত্রাবাড়ী, গেন্ডারিয়া, শ্যামপুর, ডেমরা, কদমতলী, বংশাল, কোতোয়ারি, হাজারীবাগ, লালবাগ, চকবাজার, কামরাঙ্গীরচর, মতিঝিল থানা। এছাড়া পুলিশ ব্যারাক, ওয়ারী থানা ও পুলিশ ভবন, দুটি উপ-পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়, ১১টি পুলিশ ফাঁড়ি, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সদর দপ্তরে ‘বিশেষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও মশক নিধন’ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ব্যক্তিমালিকাধীন ভবনের চারপাশে যাতে বৃষ্টির পানি না জমে, সেজন্য জনসচেতনতা কার্যক্রম করছে ডিএসসিসি।

কীট বিশেষজ্ঞরা বলেন, থেমে থেমে বৃষ্টি আবার কখনো উত্তপ্ত তাপমাত্রা এডিস মশার বংশবিস্তার করতে পারে। এছাড়া এখন কেবল স্বচ্ছ পানি নয়, নোংরা পানিতেও এডিস মশা জন্মায়। তাই এক্ষেত্রে ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনার বিকল্প নেই। বাসাবাড়িতে জমে থাকা পানি এডিস মশা প্রজননের আদর্শ স্থল। ডিএনসিসির পক্ষ হতে খাল, জলাশয় ও ড্রেনগুলোতে ওষুধ ছেটানো সহজ হলেও বাসাবাড়ি ও এর আশপাশে জমে থাকা পানিতে ওষুধ ছিটানো সব সময় সম্ভব হয় না নানা কারণে। তাই প্রত্যেকে নিজ নিজ উদ্যোগে বাসাবড়ি ও এর আশপাশ পানি জমতে না দিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখলে শুধু এডিস মশা নয়, যে কোনো মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। এছাড়া দেশের প্রতিটি হাসপাতালে ডেঙ্গু কর্নার স্থাপনের বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত