জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে খালেদা জিয়া

* হৃদযন্ত্রে বসানো হলো পেসমেকার * দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছে পরিবার ও বিএনপি

প্রকাশ : ২৪ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আমিরুল ইসলাম অমর

বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বয়স এখন প্রায় ৮০ ছুঁইছুঁই। তিনি দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি জটিলতা, চোখের সমস্যা ও হৃদরোগে ভুগছেন। এছাড়া তার মেরুদণ্ড, ঘাড়, হাত, হাঁটুর সমস্যাসহ আরো কিছু শারীরিক জটিলতা আছে। এছাড়া তিনি পরিপাকতন্ত্রে রক্তক্ষরণ ও লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত।

গত শুক্রবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টায় গুলশানের বাসা ফিরোজায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে খালেদা জিয়াকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে নেয়া হয়। দ্রুতই তাকে সিসিইউতে ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু করে মেডিকেল বোর্ড। তারপর তাকে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। গতকাল রোববার সন্ধ্যায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হৃদযন্ত্রে পেসমেকার বসানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ম্যাডামের হৃদরোগের সমস্যা আগে থেকেই ছিল। হার্টে ব্লক ধরা পড়েছিল। সেখানে একটা স্টেন্টও (রিং) লাগানো ছিল। সবকিছু পর্যালোচনা করে মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তার হার্টে পেসমেকার বসানো হয়েছে।

‘ম্যাডামের পরিবার ও বিএনপি দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন বলেও জানান ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন।’

পেসমেকার হলো হৃদস্পন্দন নিয়মিত রাখার কৃত্রিম বৈদ্যুতিক যন্ত্র, যা বৈদ্যুতিক স্পন্দন তৈরি করে হৃদপেশিতে পাঠায় এবং হৃদপিণ্ডের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। যখন হৃদপিণ্ডের নিজস্ব পেসমেকার বা এসএ নোড যথেষ্ট পরিমাণে বা গতিতে ‘ইমপাল্স’ তৈরি করতে না পারে বা হৃদপিণ্ডের তড়িৎ পরিবহণের রাস্তা আটকে যায়, তখন হৃদপিণ্ডের গতি একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় নিয়ে যাওয়া হলো পেসমেকারের প্রাথমিক কাজ, যাতে হৃদপি- ঠিকভাবে কাজ করতে পারে।

হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের অধীনে খালেদা জিয়া চিকিৎসাধীন আছেন। ওই গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা গত শনি ও রোববার কয়েক দফা বৈঠকে বসে পেসমেকার লাগানোর সিদ্ধান্ত দেন।

লন্ডন থেকে খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবায়েদা রহমান এবং যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়ার কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ভার্চুয়ালি মেডিকেল বোর্ডের এসব সভায় যুক্ত থাকেন।

এর আগে দীর্ঘ ৫ মাস এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার পর গত ১১ জানুয়ারি গুলশানের বাসায় ফিরেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। কারাগার থেকে গুলশানের ফিরোজা বাসায় যাওয়ার পর লিভার জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণে বেশ কয়েক দফা হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসনকে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে একটি মেডিকেল বোর্ডের অধীনে তার চিকিৎসা চলে। এর আগে গত ২ মে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য এভারকেয়ার হাসপাতালে যান খালেদা জিয়া। ওই সময় চিকিৎসকরা তাকে দুই দিন সিসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেন।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন বলে জানিয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আজকে খালেদা জিয়া অত্যন্ত কষ্ট করছেন। তিনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। সবাই তার জন্য প্রাণখুলে দোয়া করবেন। আল্লাহ যেন তাকে সুস্থ অবস্থায় আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দেন। গতকাল রোববার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক দোয়া মাহফিলে এসব কথা বলেন তিনি।

মির্জা ফখরুল বলেন, বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় খালেদা জিয়া দীর্ঘকাল ধরে বন্দি রয়েছেন। সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলায় তাকে সাজা দিয়ে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দিতে কারাগারে আটক রাখা হয়েছিল। তাকে বাসায় থাকতে সুযোগ দেওয়া হলেও তিনি প্রকৃতপক্ষে পুরোপুরি অবরুদ্ধ হয়ে আছেন।

মির্জা ফখরুল বলেন, খালেদা জিয়ার এভার কেয়ার হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ড বারবার বলেছে, ম্যাডামের যে অসুখ তার চিকিৎসা এখানে সম্ভব নয়। কারণ, তার বহু রোগ আছে, সেটার চিকিৎসা করতে হলে উন্নত দেশের উন্নত মাল্টি সেন্টারের প্রয়োজন। দলের পক্ষ থেকে, সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে, এমনকি বিদেশি মিশনগুলোর পক্ষ থেকে ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠাতে বলা হচ্ছে। কিন্তু তাকে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে এই সরকার। মুক্তি পেয়ে বাসায় আসার পর তাকে শর্ত দেওয়া হয়েছে তিনি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে পারবেন না।

এদিকে গতকাল রোববার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, যে আইনে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে সে আইনে তাকে বিদেশে পাঠানোর সুযোগ নেই। খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে নতুন করে কোনো আবেদনও আসেনি। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার অসুস্থতার বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিতে দেখেন বলেই ২০২০ সাল থেকে তার সাজা স্থগিত রেখে বাসায় থাকার ব্যবস্থা করেছেন। খালেদা জিয়া তার পছন্দমতো হাসপাতালে বিদেশ থেকে চিকিৎসক এনে চিকিৎসা করাচ্ছেন।

সূত্র মতে, খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যান। দেশে করোনা মহামারি শুরুর পর পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ তাকে নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে সাময়িক মুক্তি দেয় সরকার। তখন থেকে তিনি গুলশানের ফিরোজা বাসায় অবস্থান করছেন। এরপর থেকে তার দণ্ডাদেশ স্থগিতের মেয়াদ ছয় মাস করে বাড়ানো হচ্ছে।