ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বেপরোয়া অসাধু কারবারিরা

পণ্য আমদানির সরলীকরণে ভেজাল

পণ্য আমদানির সরলীকরণে ভেজাল

কর ফাঁকি ও অর্থ পাচারের উদ্দেশ্যে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানির ঘটনা বাড়ছে। এ ঘটনায় গড়ে প্রতিদিন দুটির বেশি মামলা করছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। তবে সংস্থাটির মামলার বেড়াজালেও অসাধু আমদানিকারকদের দৌরাত্ম্য কমেনি। বিভিন্ন উপায়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে কর ফাঁকি অব্যাহত রাখছে।

কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে, ২০২১-২২ অর্থবছর পণ্য আমদানি-রপ্তানির মিথ্যা তথ্যের ঘটনায় ৮৬৭টি মামলা করা হয়। এ বছরে মামলায় জড়িত পণ্যের মূল্য ছিল ৩৩৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। ঘোষিত শুল্ককরাদির পরিমাণ ২৩৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এছাড়া অতিরিক্ত আদায়কৃত শুল্ককরাদির পরিমাণ ১২৯ কোটি ৪৯ লাখ টাকার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮২০টি মামলা হয়। ওই বছর মামলায় জড়িত পণ্যের মূল্য ছিল ৪৫৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা। শুল্ককরাদির পরিমাণ ৩৬৩ কোটি ৫৭ লাখ। এছাড়া অতিরিক্ত আদায়কৃত শুল্ককরাদির পরিমাণ ২০১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ২৪৭টি মামলা হয়। এখানে মামলায় জড়িত পণ্যের মূল্য ১০৯ কোটি টাকা, যেখানে শুল্ক করাদির পরিমাণ ৯৭ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এছাড়া অতিরিক্ত আদায়কৃত শুল্ককরাদির পরিমাণ ৬৭ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের কর ফাঁকি দেয়ার জন্য প্রতিনিয়ত নতুন কৌশল অবলম্বন করছেন অসাধু আমদানিকারকরা। তাদের মধ্যে স্বল্প সংখ্যক ধরা খেলেও অনেকে সফলভাবে বেরিয়ে যাচ্ছে, এটির সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কাস্টমস কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে অবৈধভাবে বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য আমদানি করছে। পণ্যের প্রকৃত মূল্য না দেখিয়ে কমবেশি দেখিয়ে আন্তর্জাতিক আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে অবৈধভাবে দেশ থেকে বিপুল অর্থ পাচার করছে বলে ধারণা করা হয়। এতে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের ব্যবসা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।

জানা গেছে, দেশের বেশিরভাগ পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর, বেনাপোল ও শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে। বিভিন্ন সময়ে কর ফাঁকি দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানির চালান আটক করা হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে মূলহোতা আমদানিকারক ও চোরাকারবারিরা। কারণ অনেক ক্ষেত্রে অসাধু আমদানিকারক বিল অব এন্ট্রি ও ব্যাংকের ঋণপত্রে (এলসি) যে সব নাম ও ঠিকানা উল্লেখ করে তা প্রায় সব ভুয়া থাকে। বিল অব এন্ট্রিতে আমদানিকারকের উল্লেখিত ঠিকানায় সরাসরি গিয়েও কখনো অস্তিত্ব খুঁজে পান না কাস্টমস কর্মকর্তারা। ফলে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে মূলহোতারা।

সম্প্রতি ক্যালসিয়াম কার্বোনেট ঘোষণা দিয়ে চার কনটেইনার পণ্য এনেছিল আমদানিকারক এক প্রতিষ্ঠান। চালানটি খালাসের সময় বিল অব এন্ট্রিতেও ঘোষণা ছিল ক্যালসিয়াম কার্বোনেট। কিন্তু পণ্য চালানটি খুলে সেখানে গুঁড়া দুধ ও ডেক্সট্রোজ পাওয়া যায়। মিথ্যা ঘোষণায় পণ্যগুলো এনে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান প্রায় ১ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিতে চেয়েছিল। শুধু এই চালানটি নয়, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে প্রতিনিয়ত আমদানি হচ্ছে নানা পণ্য। তবে অসাধু উপায়ে কী পরিমাণ পণ্য আমদানি হচ্ছে তার কোনো তথ্য নেই।

কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, অনিয়মের বিষয়টা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয় কমার্শিয়াল পণ্যে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল পণ্যে এটি খুব একট হয় না। আমাদের দেশে কমার্শিয়াল পণ্য আমদানি হয় ১০ শতাংশের মতো। এর মধ্যে কিছু অসাধু আমদানিকারক আছেন যারা অনিয়মের আশ্রয় নেন। এতে প্রত্যেক মাসে মিথ্যা ঘোষণায় আনা পণ্যের ১৫ থেকে ২০টি চালান আটক হচ্ছে। এসব পণ্য কখনো ধরা পড়ে। আবার কখনো অসাধু কাস্টমস কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় বের হয়ে যাচ্ছে। ফলে বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

কাস্টমস সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের ২ বছর চার মাসে ১ হাজার ৯৩৪টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় জড়িত পণ্যের মূল্য ছিল ৮৯৭ কোটি টাকা। ঘোষিত শুল্ককরাদি হয়েছে ৬৯৩ কোটি টাকা। অনিয়মের বিপরীতে আদায়কৃত অতিরিক্ত রাজস্ব ছিল ৩৯৭ কোটি টাকা। বাস্তবে অনিয়মের মাধ্যমে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আসছে এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। কাস্টমসের অসাধু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগসাজশে এসব পণ্য ছাড় করিয়ে নেন আমদানিকারকরা। শুল্ককর ফাঁকি দিতেই আমদানিকারকরা নানা অনিয়মের আশ্রয় নিচ্ছেন। কখনো পণ্যের এইচএস কোড পরিবর্তন করে মাল নিয়ে আসছেন, আবার কখনো যেই পণ্য ঘোষণা দিচ্ছেন ওই পণ্যের ভেতরে অন্য পণ্য লুকিয়ে নিয়ে আসছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কাস্টম হাউসের এক রাজস্ব কর্মকর্তা বলেন, গত অর্থবছরে অনিয়মের মাধ্যমে আমদানি করা যেসব পণ্য চালান আটক করা হয়েছে, এগুলোর প্রায় প্রত্যেকটির ক্ষেত্রে অনিয়মের ধরনটা ছিল ভিন্ন। একটি চালানে এইচএস কোড পরিবর্তন করে আনা হলে, অন্যটি আনা হয়েছে কম মূল্য দেখিয়ে। কোনোটি ঘোষিত পণ্যের মাঝখানে লুকিয়ে আনা হলে অন্যটি আনা হয় আমদানিকারকের মিথ্যা নাম ঠিকানা ব্যবহার করে।

আমদানিকৃত পণ্যের মিথ্যা ঘোষণাকে অর্থ পাচারের প্রধান মাধ্যম হিসেবে অভিহিত করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, সুতরাং একটি দেশের অর্থনীতি মূলত দুটি দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়- একটি হলো কর ফাঁকি, অন্যটি অর্থ পাচার। প্রতারণা ধরা পড়ার পরও কর্তৃপক্ষ যখন দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয় না, তখন তারা অপরাধের পুনরাবৃত্তি করতে উৎসাহিত হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত