ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দেশে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে

দেশে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে

নজরুল ইসলাম মিঠুর মাথায় কারুকাজ খচিত বাহারি রকমের টুপি। টুপিটি গুলিস্তান কিংবা নিউমার্কেটে সচরাচর দেখা মিলবে না। কারণ বাজারের সাদামাটা টুপির চেয়ে কিছুটা ভিন্ন রকম ও নান্দনিক।

ঢাকার সেগুনবাগিচা থেকে আমিজপুর গাড়িতে যাওয়ার পথে নজরুল ইসলাম মিঠুর জিজ্ঞাসা- টুপিটি কি তৈরি? কোথাকার? এমন প্রশ্নে পাশে থাকা ব্যক্তি বললেন- এটি কাপড়ের, বাংলাদেশেই তৈরি। সঙ্গে সঙ্গে মিঠু বললেন- টুপিটি চীন থেকে আমদানি করা হয়েছে, আর এটি প্লাস্টিকের তৈরি। এভাবেই টুপি, খেলনা, মেডিকেল সামগ্রিসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য চীন থেকে বাংলাদেশে আমদানি হচ্ছে। আর বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের একাংশ কাজের অভাবে রিকশা, মোটরসাইকেলে যাত্রী টানছেন। আবার কেউ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনে কারখানা কিংবা ব্যবসায় এলেও লোকসানে পড়ে মুখ থুবড়ে পড়ছেন। এতে বছরে বছরে দেশে বেকারত্বের সংখ্যা বাড়ছে।

এদিকে লিয়াকত সিকদারের নামের সঙ্গে বাস্তবে কোনো সিকদারীর ছোঁয়া নেই। দশ বছর আগে এইচএসসির গণ্ডি পেরিয়ে গাইবান্ধার ফুলছড়ির প্রত্যন্ত চর অঞ্চল থেকে ঢাকা মোহাম্মদপুর একটি বাড়ির নিরাপত্তার কাজ নিয়েছিলেন। সেখানে দু’বছর কাজ করলেও বেতন বাড়ানো হয়নি। বাধ্য হয়ে, তিন চাকার বাহন রিকশা হাতে তুলে নেন। দেখতে দেখতে আট বছর ধরে মোহাম্মদপুর ও শ্যামলী এলাকায় রিকশা চালাচ্ছেন, এতে তার দৈনিক আয় বাড়ছে, সেই আয়ের সঙ্গে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। সংসার চালানোর আয়-ব্যয়ের হিসাব কষে বছর শেষ। লিয়াকত সিকদারের মতোই রাজধানীসহ সারা দেশে তিন চাকার রিকশা ছাড়াও তরুণ প্রজন্ম দুই চাকার ঝুঁকিপূণ বাহন মোটরসাইকেলে যাত্রী টানছেন। তবে দেশে উৎপাদনমুখী কারখানা বাড়লে কাজের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি বেকারত্ব কমে আসবে।

চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকের (জানুয়ারি-মার্চ) বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ শ্রমশক্তি জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে এই বছরের প্রথম তিন মাসে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে। গত বছরের শেষ তিন মাসের তুলনায় চলতি বছরে প্রথম তিন মাসে বেকার বেড়েছে প্রায় আড়াই লাখ। বেকারের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৫ লাখ ৯০ হাজার। এসময়ে নারীর চেয়ে উল্লেখযোগ্য হারে পুরুষ বেকারের সংখ্যা বেড়েছে বেশি।

বিবিএস’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে বর্তমানে ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ বেকার। এর মধ্যে পুরুষ বেকারের হার ৩ দশমিক ৫৯ শতাংশ আর নারী বেকারের হার ৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ। অর্থাৎ নারী বেকারের চেয়ে পুরুষ বেকার হার শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি। এই হার গত বছর ছিল ৩ দশমিক ৩৬।

ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের হিসাবে, পায়ে চালিত নিবন্ধিত রিকশা লাখ দুয়েক। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) ২০১৭ সালের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ঢাকায় ১১ লাখ রিকশা চলাচল করছে। বর্তমানে রিকশা চালকের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। রিকশার পাশাপাশি যাত্রী টানায় নতুন বাহন হিসেবে যোগ হয়েছে মোটরবাইকেল। লাখো মানুষের জীবিকার মাধ্যম হয়ে উঠেছে অ্যাপভিত্তিক মোটরসাইকেল। বিআরটিএ’র গত বছরের তথ্য অনুযায়ী ঢাকায় নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ১০ লাখ ৬৮ হাজার ৮৬৬টি। এর বেশিরভাগই অ্যাপভিত্তিক সেবা প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রার্ড বাইক। যুক্তরাষ্ট্রের রাইড শেয়ারিং অ্যাপভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘উবার’-এর মোটরের প্রায় এক লাখ চালক রাজধানীতে মোটর চালিয়ে যাচ্ছেন। ঢাকায় আরেকটি জনপ্রিয় বাইক রাইডিং পাঠাও’র আছে প্রায় দেড় লক্ষাধিক রাইডার। এ ছাড়াও রাজধানীতে সহজ ডট কম, স্যাম, ওভাই, ওবোন ইত্যাদির আওতায় আছে আরো প্রায় ৫০ হাজার রেজিস্ট্রার্ড বাইক। এই হিসাবে রাজধানীতে মোট রেজিস্ট্রার্ড বাইকারের সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ। তবে রাইডারদের অনেকেই একসঙ্গে কয়েকটি অ্যাপে যুক্ত আছেন।

জানা গেছে, গত বছরে ৬ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশ বা ৪ লাখ কোটি টাকার পণ্যই এসেছে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, মালয়েশিয়া, রাশিয়া ও জাপান থেকে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর আমদানিবিষয়ক তথ্য বলছে, বাংলাদেশে আমদানি পণ্যের সবচেয়ে বড় উৎস চীন ও ভারত। দেশে শিল্পের মেশিনারিজ ও খাদ্যশস্যের বাজার যত বড় হচ্ছে, পণ্য সরবরাহে এ দুই দেশের অংশীদারত্ব ততই বাড়ছে। পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশের বাজারে ৬০ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকার মেশিনারিজসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য সরবরাহ করেছিল চীন। ২০২৩ সালে সেখান থেকে এসেছে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার পণ্য। পাঁচ বছরের ব্যবধানে দেশের আমদানি পণ্যের বাজারে চীনের অংশীদারত্ব বেড়েছে ৫০ শতাংশেরও বেশি। চীন থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আমদানি করে শিল্পকারখানার যন্ত্রপাতি। দেশটি থেকে গত অর্থবছর ৪২৫ কোটি ডলারের যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে। তারপর সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে বস্ত্র খাতের কাঁচামাল তুলা। গত অর্থবছরে চীন থেকে ২২৮ কোটি ডলারের তুলা আমদানি করা হয়েছে। এছাড়া ১৯১ কোটি ডলারের ইলেকট্রনিক পণ্য, ১৩৭ কোটি ডলারের নিট কাপড়, ১২২ কোটি ডলারের কৃত্রিম তন্তু আমদানি হয়েছে চীন থেকে।

উদ্যোক্তারা বলছেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের খেলনা শিল্প পিছিয়ে রয়েছে। কারণ খাতটিতে শুল্ককর জটিলতার কোনো সমাধান হয়নি। খেলনা তৈরিতে ৩৫ থেকে ৪০ ধরনের উপকরণ বা কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। কিন্তু এসব কাঁচামাল আমদানিতে ২৫ থেকে ৮৯ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ককর রয়েছে, যা উৎপাদনকারীদের বড় বোঝা। এ শুল্ককর কমালে দেশীয় বাজারে খেলা শিল্পের প্রসারের সঙ্গে বিদেশেও রপ্তানি করা যাবে। খেলনা উৎপাদনকারীদের বেশিরভাগ ছোট উদ্যোক্তা। তবে ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে বেশ বেগ পেতে হয় তাদের। বিশেষ করে পুরান ঢাকায় যেসব কারখানা রয়েছে, সেগুলোতে কোনো ধরনের ঋণ দেওয়া হচ্ছে না। নবায়ন করা হচ্ছে কোনো সনদ। সরকারের অন্যান্য সেবা পেতেও তাদের পড়তে হচ্ছে বিড়ম্বনায়। উদ্যোক্তারা বলেন, দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খেলনা শিল্পের ক্লাস্টার তৈরি হয়েছে, যাতে অনেক অর্থ বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। এসব শিল্পের প্রসারে কর ছাড় দেওয়া এখন খুবই জরুরি। একই সঙ্গে দরকার সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা। বাংলাদেশি খেলনার অন্যতম প্রতিযোগী বাজার চায়না, তাইওয়ান ও ভিয়েতনাম। খেলনা উৎপাদনে এসব দেশ প্রযুক্তির ব্যবহারে শীর্ষস্থানে রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দিক থেকে এখনও অনেক পিছিয়ে।

বিপিজিএমইএর সিনিয়র সহসভাপতি কে এম ইকবাল হোসেন বলেন, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি খেলনার কদর আছে। রপ্তানি বাজারে নিজেদের দখল বাড়াতে এ শিল্পকে সম্প্রসারণ করা জরুরি। সে জন্য সরকারের নীতিগত সহায়তা প্রয়োজন। প্রযুক্তিগত খেলনা বানানোর মতো দেশে অভিজ্ঞ জনশক্তি নেই। তাই দেশে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা দরকার।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বাংলাদেশে সামগ্রিক বাণিজ্যের ৯২ শতাংশ সমুদ্রবন্দর ও নদীপথে হয়ে থাকে। আর পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে সমুদ্রবন্দরগুলোর মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে চট্টগ্রাম বন্দর।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় পণ্য আমদানি-রপ্তানি বেড়েছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে (জুলাই-মে) এ বন্দর দিয়ে কনটেইনার পরিবহন হয়েছে ২৮ লাখ ৯৩ হাজার ৯১৭টি। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছিল ২৭ লাখ ১৯ হাজার ২৩টি। শুধু কনটেইনারই নয়, বন্দরে বেড়েছে কার্গো পরিবহনও। চলতি অর্থবছরে গত মে মাসেই চট্টগ্রাম বন্দরের অধীনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১ কোটি ১১ লাখ কার্গো পরিবহণ হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এর চেয়ে বেশি কার্গো পরিবহন হয়েছিল গত মার্চে ১ কোটি ১৩ লাখ ৩৪ হাজার। তবে অর্থবছরের ১১ মাস হিসাব করলে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ কোটি ৩৪ লাখ ৮৭ হাজার। গত অর্থবছরে একই সময়ে (২০২২-২৩) মোট কার্গো (কনটেইনার পণ্য ও কনটেইনারবিহীন পণ্য) পরিবহন হয়েছিল ১০ কোটি ৮০ লাখ ৩৬ হাজার।

চট্টগ্রাম বন্দরের সাত বছরের আমদানির পরিসংখ্যান বলছে, আমদানিতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬ কোটি ৬৩ লাখ ৮৪ হাজার ৮৮৫ মেট্রিক টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭ কোটি ৭৮ লাখ ৭৩ হাজার ৬১৫ মেট্রিক টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ কোটি ২৯ লাখ ৩৯ হাজার ৭৩১ মেট্রিক টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮ কোটি ৭২ লাখ ৭৫ হাজার ২৪৮ মেট্রিক টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯ কোটি ৯২ লাখ ৪০ হাজার ৭৫৯ মেট্রিক টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১০ কোটি ১৮ লাখ ৫৪ হাজার ৪৭৪ টাকা এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০ কোটি ১৮ লাখ ৪৫ হাজার ৯৯৮ মেট্রিক টন আমদানি করা হয়েছে। এখানে প্রত্যেক বছরে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে আমদানির মাত্রা বাড়ছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের সাত বছরের রপ্তানির পরিসংখ্যান বলছে, রপ্তানিতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬৭ লাখ ৯ হাজার ৭৫৯ মেট্রিক টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬৯ লাখ ৯৫ হাজার ২৮৫ মেট্রিক টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬৮ লাখ ৪৬ হাজার ৪০৬ মেট্রিক টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬৬ লাখ ৪৫ হাজার ১৪৫ মেট্রিক টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭৩ লাখ ৬৮ হাজার ৬৪ মেট্রিক টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭৯ লাখ ৬৯ হাজার ৩৬৬ মেট্রিক টন এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭৩ লাখ ৫১ হাজার ২৫৮ মেট্রিক টন পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে। দেশীয় পণ্য রপ্তানির তুলনায় বহুগুণ পণ্য বিদেশ থেকে দেশে আমদানি করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত