খরচের লাগাম টানতে ক্রেতারা কিনছেন কম

প্রকাশ : ২৯ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

বাজারে এখন ক্রেতার উপস্থিতি স্বাভাবিক সময়ের মতোই। নিত্যপণ্যের চড়া দামের কারণে তারা কেনাকাটা করছেন কম। ক্রেতারা বলছেন, খরচের লাগাম টানতেই কম পরিমাণে কিনছেন। একদম না হলেই না, তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখছেন কেনাকাটা।

বিক্রেতারাও ক্রেতাদের সুরে বলছেন, কোনো ক্রেতা আগে যে পরিমাণ পণ্য তাদের কাছ থেকে সাধারণত কিনত, এখন কিনছে না। পণ্যের দাম বেশি স্বীকার করে বিক্রেতারা জানান, সবকিছুর দাম বেশি বলে ক্রেতারা কিনতে পারছেন না। এমনকি তারাও (বিক্রেতা) পাইকারি বাজার থেকে আগের মতো কিনছেন না। গতকাল রাজধানীর মিরপুর ১ নম্বর কাঁচাবাজার সরেজমিন ঘুরে দেখা যায় এমন চিত্র। ভিড় থাকলেও অন্য সময়ের মতো কেনাকাটা নেই। দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী থাকায় নিজেদের কেনাকাটায় সংযত হতে হয়েছে। সরকারি চাকরি থেকে ১১ বছর আগে অবসরে গিয়েছেন আবু তাহের। তিনি এসেছিলেন পরিবারের জন্য বাজার করতে। বাজারে এসে তিনি অন্যান্য কেনাকাটার সঙ্গে দুই টুকরো আদা কিনেছেন। এ সময় কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি এক কেজির নিচে কখনও আদা কিনিনি। আজকে আমাকে দুই পিস আদা কিনতে হচ্ছে। বাসায় দুই পিস আছে আর এখন দুই পিস কিনলাম, দুটো মিলিয়ে আধা কেজি হয়ে যাবে। এভাবেই চলতে হচ্ছে। সবকিছুর দাম বেশি কী করব! আমার পারিবারিক খরচের বাজেট মাসে ৮০ হাজার টাকা। কিন্তু সেটা দিয়েও কুলাতে পারি না এখন। কী করব বলেন! আবু তাহেরের মতো বাজারে আসা অন্য ক্রেতাদের অবস্থাও প্রায় একই। তারাও স্বাচ্ছন্দ্যে পণ্য কিনতে পারছেন না। বাজার করতে এসেছেন গৃহিণী জেসমিন আক্তার। তিনি বলেন, সবজির দাম আমাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এটা সত্যি বলতে আমাদের ওপর চাপ হয়ে যাচ্ছে। আগে আমি পটোল কিনতাম ২ কেজি করে, আজকে কিনলাম আধা কেজি। ফুলকপি আমি একসঙ্গে কিনতাম ৪টা করে, আজকে একটা কিনলাম। আমার মতো সবারই একই অবস্থা। কেউই ঠিকমতো কিছু কিনতে পারছে না। বাজারে পেঁয়াজের দাম পৌঁছেছে ১০০ টাকায়। আকার ও মানভেদে ক্রস জাতের পেঁয়াজ ৯০-১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে ছোট আকারের পেঁয়াজ ৯০ টাকা এবং বড় আকারের ১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। আর দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা করে। এ ক্ষেত্রে দেখা যায় সব ধরনের পেঁয়াজের দাম বেড়েছে প্রতি কেজিতে ১০ টাকা করে। এছাড়া আজকে লাল আলু ৬০ টাকা, সাদা আলু ৬০ টাকা, বগুড়ার আলু ৮০ টাকা, নতুন দেশি রসুন ২২০ টাকা, চায়না রসুন ২০০-২২০ টাকা, চায়না আদা ৩০০ টাকা, ভারতীয় আদা ৩০০ দরে বিক্রি হচ্ছে। এক্ষেত্রে দেখা যায়- লাল ও সাদা আলুর দাম অপরিবর্তিত থাকলেও বগুড়ার আলুর দাম বেড়েছে ১০ টাকা। চায়না রসুনের দাম কমেছে ১০ টাকা। আদার দাম রয়েছে অপরিবর্তিত। বাজারে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী মো. জসিমউদ্দিন বলেন, কেনাকাটা আগের চেয়ে কমিয়ে দিয়েছি। আগে আলু কিনতাম ৫ কেজি করে, পেঁয়াজ কিনতাম ৩ কেজি করে। এখন আলু কিনি ২ কেজি, পেঁয়াজ কিনি ১ কেজি করে। কম খরচ করার চেষ্টা করছি। সবকিছুর দাম বাড়াতে আমাদের বাজারের খরচে লাগাম টানতে হয়েছে।

বিক্রেতা শামসু বলেন, মানুষের কেনাকাটা আসলেই কমেছে। আর পেঁয়াজের দাম হুট করে বেড়ে যাওয়ায় যেটার দাম কম সেটাতেই ঝুঁকছেন ক্রেতারা। ছোট যেই ক্রস পেঁয়াজ আছে সেটা আমার বেশি বিক্রি হচ্ছে। অন্য পেঁয়াজের থেকে এটার দাম ১০ টাকা কম। এদিকে সবজির বাজারের চিত্রও অভিন্ন। এখানেও বিক্রির পরিমাণ কমেছে। বেশিরভাগ সবজির দামই আজকে বেড়েছে। কমেছে অল্প কয়েকটি সবজির দাম। আজকের বাজারে টমেটো ২২০-২৪০ টাকা, দেশি গাজর ৮০, চায়না গাজর ১৪০, লম্বা বেগুন ৮০, সাদা গোল বেগুন ৮০, কালো গোল বেগুন ৯০, শসা ১২০-১৪০, উচ্ছে ৮০-৯০, করলা ৮০-৯০, কাঁকরোল ৮০, পেঁপে ৬০, ঢ্যাঁড়স ৫০, পটোল ৫০-৮০, চিচিঙ্গা ৫০, ধুন্দল ৫০, ঝিঙা ৭০-৮০, বরবটি ৮০, কচুর লতি ৮০-৯০, কচুরমুখী ৮০-১১০, মিষ্টি কুমড়া ৩০, কাঁচা মরিচ ২৪০, ধনেপাতা ৩০০ কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর মানভেদে প্রতিটি লাউ ৮০ টাকা, চাল কুমড়া ৬০, ফুলকপি ৮০, বাঁধাকপি ৬০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতি হালি কাঁচা কলা ৩০ টাকা, এক হালি লেবু বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা করে। দাম বিশ্লেষণে দেখা যায়, এক সপ্তাহের ব্যবধানে টমেটোর দাম বেড়েছে ৯০ টাকা। আর উচ্ছে, করলা, কাঁকরোল, ঝিঙা, কচুর লতি, চাল কুমড়ার দাম বেড়েছে ১০ টাকা থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত। এছাড়া সাদা ও কালো গোল বেগুনের দাম কমেছে ১০ টাকা। কাঁচা মরিচ ও ধনেপাতার দাম কমেছে যথাক্রমে ৬০ টাকা ও ৫০ টাকা। বাদবাকি সবজির দাম রয়েছে অপরিবর্তিত।

সবজি বিক্রেতা শাহাদাত হোসেন বলেন, বাজারে কাস্টমার (ক্রেতা) কমে গেছে। শুক্রবার-শনিবার কাস্টমার একটু বেশি থাকে, কিন্তু তাও তাদের কেনার পরিমাণ কমেছে। আমার অনেক বাঁধা কাস্টমার আছে, যারা আমার কাছ থেকেই সবসময় কিনে, তারাও কেনার পরিমাণ কমিয়েছে। এটা আমার নিজেরই দেখা। তারা আগে দুই কেজি ধুন্দল কিনলে এখন কিনেন আধা কেজি করে। দেড় কেজিই কমিয়ে দিয়েছেন। আমি সবজি বিক্রি করি সত্যি, কিন্তু আমিই বলি যে সবজির দাম অনেক বেশি। টমেটোর কেজি ২৪০ টাকা- এটা কী সবাই কিনতে পারবে? অনেকেই এসে ২-৩ পিস করে কিনে নিচ্ছে। সবার কেনার ক্ষমতাও নাই। আগে আমি নিজেই এক-দেড় কেজি টমেটো বাসায় নিয়ে যেতাম খাওয়ার জন্য। এখন ২-৩টার বেশি নেই না, যুক্ত করেন শাহাদাত। বাজার করতে আসা আনোয়ার হোসেন বলেন, আগে এমন হতো যে- যা যা দরকার সেগুলো তো কিনতামই, আর হুট করে লাগতে পারে এমন সবজিও কিনে রাখতাম। কিন্তু এখন আর সেটা করি না। যা প্রয়োজন তার বাইরে অতিরিক্ত কিছুই কিনি না। সাধারণত কোরবানি ঈদের সপ্তাহখানেক পরে মাছের চাহিদা বেড়ে থাকে। মাছ বাজারে ক্রেতার উপস্থিতি বাড়ে। এর কোনও ব্যত্যয় ঘটেনি। মাছ বাজারে ক্রেতাদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। তবে মাছের দোকানের সামনে ভিড় থাকলেও অনেককেই দেখা যায় দাম জিজ্ঞেস করে চলে যেতে। তারা বাজার ঘুরে বেড়াচ্ছেন কিন্তু দামে পোষাচ্ছে না। এক ক্রেতা কামরুল ইসলাম। তিনি বিভিন্ন দোকানে গিয়ে মাছের দাম জিজ্ঞেস করছিলেন। তার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, এসেছিলাম রুই বা কাতল মাছ কিনতে কিন্তু যে দাম দেখলাম একটা মাছ কিনতে গেলেই এক হাজার টাকার উপরে চলে যাবে। তাই দেখছিলাম অন্য কী মাছ কেনা যায়। পাবদা মাছের দাম তুলনামূলক কম আছে, বাচ্চারাও পছন্দ করবে- এটাই কিনে নিয়ে যাবো। বাজারে ইলিশ মাছ ওজন অনুযায়ী ১৬০০-২২০০ টাকা, রুই মাছ ৪০০-৬৫০, কাতল মাছ ৪০০-৬০০, কালিবাউশ ৫৫০, চিংড়ি মাছ ১০০০-১৪০০, কাঁচকি মাছ ৫০০, কৈ মাছ ২২০-৩০০, পাবদা মাছ ৪০০-৬০০, শিং মাছ ৪৫০-৮০০, টেংরা মাছ ৫০০-৮০০, বেলে মাছ ৭০০-১৪০০, বোয়াল মাছ ৮০০-১২০০, রূপচাঁদা মাছ ৮০০-১৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

সাধারণ মানুষ মাছ কেমন কিনছেন জানতে চাইলে বিক্রেতা গিয়াস উদ্দিন বলেন, এখন মানুষের কেনাকাটা কমেছে। মানুষের বেতনের থেকে জিনিসের দাম বেড়ে গেছে- তাই কিনছে কম। এখন আমরা ইলিশ বিক্রি করছি ওজন অনুযায়ী ১৬০০ থেকে ২২০০ টাকা পর্যন্ত। এটা কিন্তু সবাই কিনতে পারে না, কারণ সবার কেনার ক্ষমতা নাই। এটা আমি বিক্রি করি তো, আমি দেখি যে কারা কিনতে পারে। এই ইলিশ যদি ১২০০ টাকার মধ্যে হতো তাহলে মোটামুটি সবাই কম-বেশি কিনতে পারতো। এটা শুধু ইলিশ মাছ না, সব মাছেরই একই অবস্থা, দাম অনেক বেশি। সব মানুষ সব মাছ কিনতে পারে না। আর মাছের দাম বেশি থাকার কারণ হচ্ছে এখন আগের মতো নদী বা বিলে মাছ পাওয়া যায় না। অনেক জেলে বিষ দিয়ে মাছ মারে, তাই অনেক মাছ প্রায় হারিয়েও যাচ্ছে, যেমন আইড় মাছ। আগে নদীতে জাল ফেললে প্রচুর চিংড়ি মাছ উঠতো, এখন আর ওঠে না। এই কারণেই চিংড়ির দাম হাজার টাকার উপরে।

মাছ বিক্রেতা সুনীল বলেন, বাজারে কিন্তু কাস্টমার আছে। কিন্তু তারা কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। আগে যারা ২ কেজি চিংড়ি কিনতো তারা এখন কিনে আধা কেজি, এক কেজি। আর যারা এক কেজি করে কিনতো তারা কিনছে এক পোয়ার (২৫০ গ্রাম) মতো। এদিকে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকা কেজি দরে। এছাড়া খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ১১৫০ টাকা কেজি দরে। এই দুই মাংসের দাম আর কমছেই না। আর মুরগির লাল ডিম ১৪০ টাকা এবং সাদা ডিম ১৩৫ টাকা প্রতি ডজন বিক্রি হচ্ছে। এক্ষেত্রে সাদা ও লাল ডিমের দাম কমেছে প্রতি ডজনে ১০ টাকা করে।

এছাড়া আজকে সব ধরনের মুরগির মাংসের দামই কমেছে। আজকে ওজন অনুযায়ী, ব্রয়লার মুরগি ১৭২-১৭৫ টাকা, কক মুরগি ২৭৫-২৯৫ টাকা, লেয়ার মুরগি ৩৫০ টাকা, দেশি মুরগি ৬০০-৬২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এক্ষেত্রে দেখা যায়- ব্রয়লার মুরগির দাম কমেছে ১৫ টাকা, কক মুরগির দাম কমেছে ২৫ টাকা, দেশি মুরগির দাম কমেছে ৮০-১০০ টাকা ও লেয়ার মুরগির দাম কমেছে ৫০ টাকা।

এদিকে, অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম ওঠানামা করলেও মুদি দোকানের পণ্যের দাম রয়েছে অপরিবর্তিত। প্যাকেট পোলাওর চাল ১৫৫ টাকা, খোলা পোলাওর চাল মানভেদে ১১০-১৪০ টাকা, ছোট মসুর ডাল ১৩৫ টাকা, মোটা মসুর ডাল ১১০ টাকা, বড় মুগ ডাল ১৬০ টাকা, ছোট মুগ ডাল ১৮০ টাকা, খেসারি ডাল ১০০ টাকা, বুটের ডাল ১১৫ টাকা, ডাবলি ৮০ টাকা, ছোলা ১০৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬৭ টাকা, খোলা সয়াবিন তেল ১৪৭ টাকা, কৌটাজাত ঘি ১৩৫০ টাকা, খোলা ঘি ১২৫০ টাকা, প্যাকেটজাত চিনি ১৩৫ টাকা, খোলা চিনি ১৩০ টাকা, দুই কেজি প্যাকেট ময়দা ১৫০ টাকা, আটা দুই কেজির প্যাকেট ১১৫ টাকা, খোলা সরিষার তেল প্রতি লিটার ১৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া এলাচি ৪০০০ টাকা, দারুচিনি ১৫০ টাকা, লবঙ্গ ১৬০০ টাকা, সাদা গোল মরিচ ১৬০০ টাকা ও কালো গোলমরিচ ৯০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।