ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আপত্তি যেসব কারণে

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আপত্তি যেসব কারণে

দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীকে পেনশন সুবিধার আওতায় আনতে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই স্কিমের উদ্বোধন করেন। চলতি বছরের মার্চে পেনশন স্কিম বিধিমালা সংশোধন করে তাতে স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বশাসিত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থার অন্তর্ভুক্তিকে বাধ্যতামূলক করা হয়।

শিক্ষকদের আপত্তি যেসব কারণে : শিক্ষকরা বলছেন, এ স্কিম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও শিক্ষকদের জন্য অমর্যাদাকর। শিক্ষকরা বর্তমান ও নতুন স্কিমের তুলনামূলক চিত্র দেখিয়ে বলেছেন, এ স্কিমের কারণে তারা ১৩ ধরনের বৈষম্যের শিকার হবে। সেগুলো হলো- ১. বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক যখন অবসরে যান অবসর সময়কালীন তার মূল বেতন থাকে ৭৮ হাজার টাকা। বিদ্যমান পেনশনে তার বেতন থেকে পেনশন বাবদ কোনো অর্থ কর্তন করা হয় না। প্রত্যয় স্কিমে মূল বেতনের ১০ শতাংশ কর্তন করা হবে। সমপরিমাণ প্রতিষ্ঠান দেবে। অর্থাৎ, মাসিক পেনশন হিসেবে প্রত্যয় স্কিম হতে অবসরকালীন যা পাবেন তার অর্ধেক আপনার নিজের কিন্তু বিদ্যমান পেনশনে অবসরকালীন যা পাবেন তার পুরোটাই সরকারের। অঙ্ক কষলে বোঝা যাবে ‘প্রত্যয় স্কিমে’ সরকারি অংশটুকু কত। ২. একজন ছাত্র পাস করার পর ৩০ বছরেও যদি শিক্ষকতায় যোগদান করে তার চাকরিকাল দাঁড়ায় ৩৫ বছর। ধরে নিলাম সে মাসিক ৫ হাজার টাকা মূল বেতন হতে কর্তন করে বাকি ৩৫ বছরের জন্য। সে হিসাবে মোট কর্তনের পরিমাণ দাঁড়ায় ২১ লাখ টাকা। বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় মোট কর্তনের পরিমাণ শূন্য। ৩. বর্তমানে একজন অধ্যাপক বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় এককালীন আনুতোষিক পান ৮০ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় বা প্রত্যয় স্কিমে এককালীন আনুতোষিকের পরিমাণ শূন্য। ৪. মাসিক পেনশন ও অন্যান্য ভাতাদি যুক্ত করলে একজন অধ্যাপক মাসিক ৪৫ হাজার ৭৯০ টাকা পান বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায়। প্রত্যয় স্কিমে যুক্ত হলে ৩০ বছর পর পাবেন মাসিক ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬০ টাকা, যার অর্ধেক অর্থাৎ ৬২ হাজার ৩৩০ টাকা নিজের বেতন হতে কর্তনের জন্য। ৫. বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় এককালীন আনুতোষিক যদি ১০ শতাংশ হারে পেনশন ফান্ডে অথবা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে তাহলে মাসিক পেনশন দাঁড়ায় ১ লাখ ১৩ হাজার ৬৫ টাকা (৬৭, ২৭৫+৪৫, ৭৯০)। অর্থাৎ, বিদ্যমান প্রচলিত সুবিধা অর্ধেক করার প্রত্যয় স্কিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর চালু করার নীরব ষড়যন্ত্র চলছে। ৬. বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় পেনশনার ও নমিনি আজীবন পেনশনপ্রাপ্ত হন। কিন্তু প্রত্যয় স্কিমে পেনশনার যদিও আজীবন পেনশনপ্রাপ্ত হবেন। কিন্তু, পেনশনারের যদি কোনো কারণে মৃত্যু হয় তবে নমিনি পেনশনারের বয়স ৭৫ বছর পূর্তি পর্যন্ত পেনশনপ্রাপ্ত হবেন। এক্ষেত্রে নমিনি বৃদ্ধ বয়সে একটা ঝুঁকির মধ্যে পড়বেন। আবার নমিনিও যদি পেনশনার হন, তাহলে উনি কি ডাবল বেনিফিট পাবেন কি না তা নিশ্চিত নয়। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় ধরে নিতে পারি এক সময় সব বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ সর্বজনীন পেনশনে থাকবেন। ৭. বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় নিট পেনশনের ওপর ৫ শতাংশ হারে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট দেয়া হয়। কিন্তু প্রত্যয় স্কিমে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট শূন্য যা বাস্তবিক নয়। পেনশনারের ক্রয়ক্ষমতাকে বিবেচনায় না নিয়ে প্যাকেজসমূহ তৈরি কোনোভাবেই বাস্তবিক নয় এবং এক্ষেত্রে বিদ্যমান পেনশন স্কিমের সাথে প্রত্যয় স্কিম সাংঘর্ষিক। ৮. বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় বর্তমানে একজন অধ্যাপক কমপক্ষে ১ লাখ ১৩ হাজার ৬৫ টাকার মাসিক সুবিধা ভোগ করতে পারেন। কিন্তু প্রত্যয় স্কিমে ভবিষ্যতে যে সুবিধার কথা বলা হয়েছে তা বর্তমান পেনশন গ্রহীতার তুলনায় অতি নগণ্য। এ যে কারণে প্রত্যয় স্কিম বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ৯. বিদ্যমান পেনশনে অর্জিত ছুটি অবসরকালীন জমা থাকলে তার পরিবর্তে অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা থাকলেও প্রত্যয় স্কিমে এ বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই। অতএব, বিদ্যমান ব্যবস্থার সাথে তুলনা করলে প্রত্যয় স্কিম বিশ্ববিদ্যালয় সমাজের সাথে বৈষম্যপূর্ণ আচরণ করছে বলে প্রতীয়মান হয়। ১০. বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় একজন এলপিআর সুবিধাপ্রাপ্ত হন। কিন্তু প্রত্যয় স্কিমে এ বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। এলপিআরের অর্থ বিবেচনায় নিলে বিদ্যমান পেনশন স্কিম হতে প্রাপ্ত সুবিধা প্রত্যয় স্কিমের তুলনায় আরো অনেক বেশি বলে প্রতীয়মান হয়। ১১. বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদকাল ৬৫ বছর, কর্মকর্তাদের ৬২ বছর এবং কর্মচারীদের ৬০ বছর পর্যন্ত। প্রত্যয় স্কিমে অবসরকালীন বয়স স্থির ধরা হয়েছে ৬০ বছর। এক্ষেত্রে শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের বয়সসীমা কত হবে বা প্রত্যয় স্কিমে কীভাবে সামঞ্জস্য আনা হবে এ ব্যাপারে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। এতে প্রতীয়মান হয় বিশদ বিশ্লেষণ ছাড়া প্রত্যয় স্কিম চালু করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ১২. বিদ্যমান পেনশন স্কিমে মাসিক পেনশনের সাথে মাসিক চিকিৎসা ভাতা, বছরে দুটি উৎসব ভাতা ও একটি বৈশাখি ভাতা প্রদান করা হয় যা অর্থমূল্যে অনেক। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় প্রত্যয় স্কিম প্রকল্পে এসব কোনো কিছুই বিবেচনায় নেয়া হয়নি। প্রত্যয় স্কিম অন্যান্য স্কিমের মতোই বিবেচনা করা হয়েছে। যার ফলে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ১৩. প্রচলিত পেনশন ব্যবস্থায় পিএফ থেকে ১০ শতাংশ কর্তন করা হয় কিন্তু পেনশন বাবদ কোনো অর্থ কর্তন করা হয় না। বর্তমান সুবিধা অব্যাহত রাখতে হলে ১০ শতাংশ হারে পিএফ চালু রাখতে হবে এবং ১০ শতাংশ হারে বা ৫ হাজার টাকা যা কম তা কর্তনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। অর্থাৎ, চাকরির শুরুর দিকে ২০ শতাংশ কর্তন চাকরিজীবীদের জন্য বোঝা হয়ে যায় কি না তা ভাবনার বিষয়। এ থেকেই প্রতীয়মান প্রত্যয় স্কিম প্রচলিত পেনশন স্কিমের তুলনায় ভবিষ্যৎ কর্মজীবীদের অবসরোত্তর জীবন যাত্রায় কতটুকু ভূমিকা রাখবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত