প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর

বাংলাদেশ-চীনের মেলবন্ধন আরো দৃঢ় করার আশাবাদ

প্রকাশ : ০৫ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

সব ঠিকঠাক থাকলে চলতি মাসেই চীন সফরে যাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে অন্যান্য বারের চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর এবারের চীন সফর বেশ গুরুত্ববহন করছে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে বাংলাদেশের তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে চীনের অংশীদারিত্বের পাশাপাশি গ্যাস সংকট নিরসনসহ সাতটি প্রকল্পে চীনের অর্থায়নের প্রস্তাব থাকবে। যা বাংলাদেশের অর্থনীতির খাত আরো চাঙা করবে। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী আগামী ৮ থেকে ১১ জুলাই বেইজিং সফর করবেন। ভারত সফর থেকে ফিরে এসে সম্প্রতি তিনি বলেছেন, তিস্তা নিয়ে যাদের প্রস্তাব বেশি লাভজনক হবে, সেটাই বাংলাদেশ গ্রহণ করবে।

এর আগে ২৪ জুন রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ৮ থেকে ১১ জুলাইয়ের মধ্যে চীন সফরে যেতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন চীন সফরে বাণিজ্য, নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিভিন্নবিষয় গুরুত্ব পাবে। এছাড়া ব্রিকসে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি এবং বাণিজ্য বৃদ্ধি ও ট্রেড ডেফিসিট নিয়েও এই সফরে কথা হতে পারে।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বায়নের যুগে বাণিজ্যে বিশ্বের প্রতিটি দেশ একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। মূলত মুক্তবাজার অর্থনীতির ফলে সৃষ্ট নেতিবাচক দিকগুলো থেকে রাষ্ট্রকে রক্ষার যে প্রয়াস বা চেষ্টা সেটিকেই বলা হয় মূলত সংরক্ষণবাদ। এ সংরক্ষণবাদ বিষয়টি বর্তমান বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে খুবই জরুরি এবং বর্তমানে প্রাসঙ্গিক। মুক্তবাজার অর্থনীতির বিপরীতে সংরক্ষণবাদের অবস্থান নেয়ার পেছনে বেশ যুক্তি রয়েছে। সেই যুক্তির সামনে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্যকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের দেশের স্বার্থরক্ষা এবং উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। নিজের দেশের স্বার্থে বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র ভারতের ওপর শতভাগ নির্ভর না করে চীনের সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে। একটি দেশের দক্ষ নেতৃত্ব ছাড়া, এটি করা কখনই সম্ভব নয়। শেখ হাসিনার এবারের চীন সফরে বাংলাদেশের তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন প্রকল্পের সুষ্ঠু সমাধান হতে পারে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় চীনের সহায়তা চায়। অন্যদিকে বেইজিং চায় নিকট প্রতিবেশীর উন্নয়নে অবদান রাখার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের অবস্থান আরো শক্ত করতে। বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দুপক্ষের জাতীয় স্বার্থের মধ্যে মিল খুঁজে বের করে প্রধানমন্ত্রীর সফরকে সফল করতে চায় বাংলাদেশ।

জানা গেছে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০ বছরে অন্তত চারবার গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছেন। এর মধ্যে ২০১৪ সালে বেইজিংয়ে প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় সফর, ২০১৬ সালে শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফর, ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর আবার বেইজিং সফর এবং ২০২৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের সাইডলাইনে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য প্রায় পুরোটাই চীনের পক্ষে। গত বছর চীন থেকে আমদানি করা হয়েছে প্রায় ২১০০ কোটি ডলারের পণ্য। অন্যদিকে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে প্রায় ৭০ কোটি ডলারের সামগ্রী। বাংলাদেশকে ৯৮ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় চীন এবং বাংলাদেশ যা রপ্তানি করে সেটির ৭০ শতাংশ ওই সুবিধার মধ্যে পড়ে। বাংলাদেশ চায় রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং ওইসব খাতে চীনা বিনিয়োগ, যা আবার চীনে রপ্তানি করা সম্ভব। বর্তমানে ছয় শতাধিক চীনা কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা করে এবং এর মধ্যে প্রায় ২৫টির আঞ্চলিক প্রধান দপ্তর বাংলাদেশে।

২০১৬ সালে যে ২৭টি প্রকল্পের বিষয়ে দুইপক্ষ সম্মত হয়েছিল, তারমধ্যে ১৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে, ছয়টির কাজ চলছে এবং ছয়টির বদলে অন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।

এর মধ্যে আটটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প, যেমন- পদ্মা রেল লিংক, ইনফো সরকার, সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিংসহ টেলিকম ও বিদ্যুৎ খাতের প্রকল্প রয়েছে। ওই প্রকল্পগুলোতে মোট চীনা অর্থের পরিমাণ প্রায় ৭৮০ কোটি ডলার। বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্পে চীন আগ্রহ দেখালেও বাংলাদেশ তা দেখায়নি। অন্যদিকে দুই দেশের মধ্যে প্রথম যে জয়েন্ট এক্সারসাইজ করার কথা ছিল, সেটি পিছিয়ে দেওয়া হয়। তবে এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরে তিস্তা প্রকল্পটি গুরুত্ব পেতে পারে।

বাংলাদেশ অংশে তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার মহাপরিকল্পনায় চীনের অর্থায়ন যখন চূড়ান্ত হওয়ার অপেক্ষায়, ঠিক তার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে তাতে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে ভারত সরকার। তবে গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ (ডিকাব) আয়োজিত ‘ডিকাব টক’ অনুষ্ঠানে ঢাকাস্থ চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছেন, তিস্তা প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশের যে কোনো সিদ্ধান্তে চীন ‘খোলা মন নিয়ে’ কাজ করবে। এক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে ‘কোনো উত্তেজনা’ তিনি দেখছেন না। যেমনটা আমি আগে বলেছি, যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হবে, সেটাই আমাদের সবার স্বার্থে, আমরা চাই এ প্রকল্পটি দ্রুত শুরু হোক। যেহেতু বাংলাদেশের প্রায় তিন কোটি মানুষের জন্য প্রয়োজন এই প্রকল্প, সুতরাং আমরা চাই প্রকল্পটি দ্রুত শুরু এবং শেষ হোক।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে তিস্তা প্রকল্পে আগ্রহ দেখিয়েছে ভারত সরকার। এর অংশ হিসাবে একটি কারিগরি দল শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবে বলে ২২ জুন শেখ হাসিনার সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

ভারতের সঙ্গে পানিবণ্টন চুক্তি ঝুলে থাকার মধ্যে তিস্তা প্রকল্পও বাস্তবায়ন দীর্ঘসূত্রিতায় যাতে না পড়ে, সেই দাবি জানিয়ে আসছেন তিস্তাপাড়ের মানুষ। অন্যদিকে, তিস্তার মতো ‘বেশ বড়’ প্রকল্পে ভারত ও চীন উভয় দেশকেই বাংলাদেশ সম্পৃক্ত করতে পারে বলে মনে করছেন কোনো কোনো আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।

এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বলেছিলেন, ভারত যেহেতু আমাদের পানি দিচ্ছে না, নতুন করে পানি দেওয়ার আশ্বাস দেয়নি, সুতরাং আমরা আমাদের ভেতরে কী করছি, সেটা আমরা নিজেরা বুঝে দেখব।

তিনি আরো বলেন, আমরা যদি দেখি যে, এই রকম সুযোগ আছে, যেহেতু প্রকল্পটা অনেক বড়, সেহেতু প্রকল্পের কিছু অংশে ভারতকেও হয়তো অংশীদার হিসাবে নিতে পারি। এটা আমার ধারণা।

ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে চীন রাজি কি না, এমন প্রশ্নে গতকাল বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন সহাস্যে বলেন- এটা খুব ভালো প্রশ্ন। এরপর তিনি বলেন, আমি শুধু বলতে পারি, আমরা প্রস্তুত এবং আমরা উন্ম্ক্তু। আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত দেখব এটা বাংলাদেশের জন্য সহায়ক, চীন খোলামেলা আছে। পরবর্তী পদক্ষেপে কীভাবে এগোবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ বাংলাদেশের রয়েছে। বাংলাদেশের যে কোনো সিদ্ধান্তে চীন খোলা মন নিয়ে আছে।

এদিকে গতকাল সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন চীন সফরে মহেশখালী থেকে একটি গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণসহ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সাতটি প্রকল্পে অর্থায়নের প্রস্তাব দেওয়া হবে। ২০২৭ সালের মধ্যে গ্যাস সংকট দূর করতে তারা কাজ করছেন।

তিনি বলেন, মহেশখালী থেকে একটি এলএনজি পাইপ লাইন নির্মাণের প্রস্তাব থাকবে। এখন দৈনিক ৩৫০০ এমএমসিএফ গ্যাসের চাহিদা থাকলেও আগামী ৫ বছরের মধ্যে তা ৬০০০ এমএমসিএফডি হয়ে যাবে। সে কারণে আমদানি ও দেশীয় যোগান থেকে এটা মেটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি। ২০২৭ সালের মধ্যে দেশে ১৪৬টি কূপ খনন করব। সেজন্য অনশোর বিডিংয়ের একটি পিএসসি প্রস্তুত করা হচ্ছে। আমরা আরও কিছু পরিকল্পনা নিয়েছি। এর অংশ হিসেবে আমরা চীনকে গ্যাস পাইপ লাইনের প্রস্তাব দিচ্ছি।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার মো. শহীদুল হক বলেন, চীনের ব্যবসায়িক ও কৌশলগত স্বার্থে বাংলাদেশে কাজ করতে চায়। চীনের মতো বড় দেশের সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ‘স্ট্র্যাটেজিক ফ্রিডম’ যেন নষ্ট না হয়, সেদিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়ে শহীদুল হক বলেন, এই সফরকে অন্য দেশগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে, এতে কোনও সন্দেহ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে চীনের একটি আদর্শগত যুদ্ধ (আইডোলজিক্যাল ব্যাটেল) আছে। এটি কোনও গোপন বিষয় নয়।