পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা

দাবি আদায়ে শিক্ষকরা অনড়

প্রকাশ : ০৫ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত পেনশন সংক্রান্ত বৈষম্যমূলক প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার, প্রতিশ্রুত সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতনস্কেল প্রবর্তনের দাবিতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের আহ্বানে ৪র্থ দিনের মতো সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এর আগে গত সোমবার থেকে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি শুরু করেন তারা। এতে দেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। হচ্ছে না ক্লাস ও পরীক্ষা। গ্রন্থাগার বন্ধ থাকায় ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা। অনলাইন, সান্ধ্যকালীন ও প্রফেশনাল কোর্সের ক্লাসও বন্ধ রয়েছে। ‘প্রত্যয়’ চালুর বিরোধিতা করে বেশ কিছুদিন ধরে আন্দোলন করে আসছিলেন শিক্ষকরা। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ার কথা জানিয়ে গত রোববার একাডেমিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকার ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। সে অনুযায়ী দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি।

এ কর্মসূচির কারণে ক্লাস-পরীক্ষার পাশাপাশি বন্ধ রয়েছে দাপ্তরিক কাজ। ঢাবির মেডিকেল সেন্টারে গিয়ে জরুরি চিকিৎসা না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন কয়েক শিক্ষার্থী। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার বন্ধ থাকায় প্রধান প্রবেশপথ ভাঙচুর করেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন হল ও বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও কর্মবিরতি পালন করছেন। আন্দোলনকারী শিক্ষকরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। এর আগে গত রোববার সংবাদ সম্মেলনে সর্বাত্মক কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক নিজামুল হক ভূঁইয়া জানান, তাদের দাবি হলো, ‘প্রত্যয়’ স্কিমের প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার, সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি ও শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন।

এদিকে, সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয়’ কর্মসূচির প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবিতে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একযোগে সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে অচল হয়ে পড়েছে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে গতকাল বৃহস্পতিবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের যে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল, তা স্থগিত করা হয়েছে। কারণ হিসেবে ওবায়দুল কাদেরের রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ততার কথা বলা হেেয়ছে। যদিও টানা চার দিন ধরে সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালনে এতে অচল হয়ে পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৩৫টি পাবলিক ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম।

এমন পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগের একজন সাবেক নেতার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. নিজামুল হক ভূঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে শিক্ষকদের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনায় বসার কথা বলেন ওবায়দুল কাদের। এ বৈঠক সামনে রেখে গত বুধবার রাতে ফেডারেশনের একটি সভাও হয়। কিন্তু গতকাল সকালে সভাটি স্থগিত করা হয়েছে।

নিজামুল হক ভূঁইয়া জানান, সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর সঙ্গে গতকাল আমাদের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কাজে ওবায়দুল কাদেরের ব্যস্ততার কারণে বৈঠকটি স্থগিত করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া সকালে ফোন করে বিষয়টি জানিয়েছেন। তবে শিগগির ওবায়দুল কাদের আমাদের সঙ্গে বসবেন।

আন্দোলনরত শিক্ষকরা বলেন, শিক্ষকদের আত্মমর্যাদা এবং গৌরব রক্ষায় গত মে ২০২৪ থেকে গণস্বাক্ষর, মানববন্ধন, পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি ও সর্বাত্মক কর্মবিরতিসহ নানা কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছি। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, অদ্যাবধি যথাযথ কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। আমরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। আমরা দ্রুত এর সমাধান নিয়ে ক্লাস-পরীক্ষায় ফিরে যেতে চাই।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ-সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. আলমগীর কবীর বলেন, গত মে মাসের শুরু থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সুস্পষ্ট দাবিতে তাদের চলমান কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা অত্যন্ত ধৈর্য ও নমনীয়ভাবে তাদের দাবিগুলো জানিয়ে আসছে। গণস্বাক্ষর, মানববন্ধন, কালোব্যাজ ধারণ, বিভিন্ন কর্মসূচি, কর্মবিরতিসহ পরবর্তীতে কঠোর থেকে কঠোর আন্দোলনের দিকে শিক্ষকরা যেতে বাধ্য হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় যা বলছে : পেনশন কর্মসূচি ‘প্রত্যয়’ নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন পেনশন ব্যবস্থায় মাসে এখনকার চেয়ে ২ দশমিক ৭ গুণ টাকা পাওয়া যাবে। কিন্তু এজন্য শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন থেকে টাকা কাটা হবে। অবসরের পর এককালীন কোনো টাকা পাওয়া যাবে না, বছর বছর পেনশন বাড়বে না এবং পেনশনারের মনোনীত ব্যক্তি এখনকার মতো আজীবন পেনশন পাবেন না। আরো কয়েকটি সুবিধা না থাকার কথা উল্লেখ করে শিক্ষকরা বলেন, সব মিলিয়ে নতুন ব্যবস্থায় তাদের সুবিধা কমে যাবে। এটা বৈষম্যমূলক। এ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে, এতদিন যে পদ্ধতিতে পেনশন সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তাতে বছর বছর এই খাতে ব্যয় বাড়ছে। সরকারের আয় দিয়ে এটি বহন করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া এতদিন অল্প সংখ্যক মানুষ পেনশনের আওতায় ছিলেন। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে সরকার দেশের প্রাপ্তবয়স্ক প্রত্যেক নাগরিকের অবসরকালীন আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালু করেছে। এ কর্মসূচির আওতায় ‘প্রত্যয়’ স্কিমে স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং তাদের অধীন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এর আওতায় আনা হয়েছে। শুধু এই স্কিমে চাকুরেদের বেতন থেকে টাকা কাটা হবে- এমনটি নয়। আগামী বছর জুলাইয়ে সরকারি চাকরিজীবীরা পেনশন কর্মসূচির আওতাভুক্ত হবেন এবং একইভাবে তাদেরও বেতন থেকে টাকা কাটা হবে। কারণ ‘অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সুবিধা’ সর্বজনীন পেনশনের মূল দর্শন। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের মতে, সার্বিকভাবে পেনশন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগের পেনশন সুবিধার সঙ্গে ‘প্রত্যয়’ স্কিমের লাভণ্ডলোকসান তুলনা করার সুযোগ নেই। কারণ পদ্ধতি দুটি আলাদা। সংসদে পাস হওয়া আইনের মাধ্যমে নতুন চাকুরেদের ‘প্রত্যয়’ স্কিমে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত হয়েছে। পুরোনো পদ্ধতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই নতুন পদ্ধতির সুবিধা নির্ধারিত হয়েছে। যাদের জন্য এটি প্রযোজ্য, তারা লাভবান হবেন।