বৃষ্টি রেকর্ড ১৩০ মিলিমিটার

জলযটে ভোগান্তিতে রাজধানীবাসী

* আজও ভারি বৃষ্টির আভাস * আগাম বার্তার পরেও ছিল না সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগ * রাজধানীবাসীর ক্ষোভ

প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  মো. সাইফ আহমেদ সনি

আষাঢ়ের বিদায়ক্ষণে বৃষ্টির পরিমাণ বেড়েছে। ছুটির দিনে টানা বৃষ্টিতে কাকভেজা রাজধানী ঢাকা। আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ছয় ঘণ্টায় ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। যা এই বর্ষা মৌসুমে সর্বোচ্চ। এর আগে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ২৭ মে ২২৪ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড হয়। আবহাওয়াবিদ কাজী জেবুন্নেছা বলেন, মনসুন (বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে) শুরু হওয়ার পর এটা সর্বোচ্চ বৃষ্টি। বর্ষা মৌসুমে এটা স্বাভাবিক বৃষ্টি, যা এ বছরে সর্বোচ্চ। তিনি বলেন, গতকাল সকাল থেকে বৃষ্টি শুরু হয়। প্রথম ৩ ঘণ্টায় সকাল ৯টা পর্যন্ত ৬০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। এরপর বৃষ্টি আরো ভারি হয়ে পরবর্তী ৩ ঘণ্টায় দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৭০ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। দুপুরের পরও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ছিল, তবে তা সামান্য। ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টিতে নগরীর বেশিরভাগ রাস্তা ডুবে গেছে। কোথাও কোথাও মূল সড়কে কোমড় আবার কোথাও হাঁটু পর্যন্ত পানি জমে থাকতে দেখা গেছে। অলিগলির অবস্থা ছিল আরো ভয়াবহ। অনেকে ঘরের বাইরেও বের হয়ে পড়েছেন চরম দুর্ভোগে। এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত নাগরিকদের জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করতে বেশ তৎপরত হয়ে মাঠে নামতে দেখা যায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে। সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ বিভাগ থেকে জানানো হয়, গতকাল শুক্রবার ভোর থেকে ভারি বৃষ্টির ফলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিরসনে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পাঁচ হাজারের অধিক পরিচ্ছন্নতা কর্মী। এছাড়া ১০টি অঞ্চলে কাজ করছে ১০টি কুইক রেসপন্স টিম। প্রতিটি কুইক রেসপন্স টিমে ১০ জন করে কর্মী রয়েছেন। এছাড়া ভারি বৃষ্টির ফলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিরসনে মাঠ পর্যায়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ ও প্রকৌশল বিভাগের ১০০টি টিম। ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাসের জানিয়েছেন, কমলাপুর টিটিপাড়া পাম্প স্টেশনে ৫ কিউসেক ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি বড় পাম্প এবং তিনটি ছোট পাম্প সচল ছিল তাদের। ধোলাইখাল পাম্প স্টেশনে ৭.৫ কিউসেক ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি পাম্প সচল রেখে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয়। বড় চারটি ও ছোট তিনটি পাম্প দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ২৫ হাজার ৪২৫ লিটার পানি নিষ্কাশন করার কথা জানান এই কর্মকর্তা। এদিকে আবহাওয়াবিদ কাজী জেবুন্নেছা আরো বলেন, আজ শনিবারও রাজধানীতে ভারি বৃষ্টি হতে পারে। তবে দিনভর বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। রোববার থেকে আবার বৃষ্টির প্রবণতা কিছুটা কমতে পারে। গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে টানা বৃষ্টির কারণে পানিতে ডুবে যায় রাজধানী ঢাকার অনেক এলাকা। ডুবে যায় বেশ কয়েকটি সড়ক। এসব সড়কে চলাচলরত যানবাহনের ইঞ্জিনে পানি ঢুকে অনেক গাড়ি বিকল হয়ে পড়ে। মাঝ সড়কে গাড়ি বিকল হয়ে পড়ে থাকায় যান চলাচল বিঘ্ন হয়, সৃষ্টি হয় যানজট। সব মিলিয়ে বৃষ্টি, যানজট আর জলাবদ্ধতায় দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে রাজধানীবাসিকে। সকাল থেকে রাজধানীর ২০টিরও বেশি সড়কে সরেজমিন ঘুরে এসব চিত্র দেখা গেছে। জানা গেছে, গত ৩০ মে টেকনাফ উপকূলে পৌঁছায় দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বা বর্ষা। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বঙ্গোপসাগর থেকে প্রচুর জলীয়বাষ্প নিয়ে আসে। এর প্রভাবে মেঘ সৃষ্টি হয় ও বর্ষাকালে বৃষ্টি হয়ে থাকে। এটি অতিমাত্রায় সক্রিয় থাকলে সারা দেশে ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টি হয়ে থাকে। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে অনেককেই বিভিন্ন দোকান, ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে দেখা গেছে। অনেকেই আবার হাঁটুপানি মাড়িয়ে গন্তব্য ফিরেছেন। থেমে থেমে এই বৃষ্টি চলছে। রাজধানীর কারওয়ান বাজার, ইস্কাটন, দিলু রোড, শাহজাহানপুর, মালিবাগ রেলগেট, মৌচাক, ফার্মগেট, তেজকুনিপাড়া, ধানমন্ডি, পশ্চিম শ্যাওড়াপাড়া, বাড্ডাসহ অনেক এলাকার রাস্তায় এরই মধ্যে পানি জমে গেছে। কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও কোমরসমান পানি। পথচারীদের দুর্ভোগের শেষ নেই। বৃষ্টিতে কারওয়ান বাজারে বেশিরভাগ অংশই হাঁটুপানিতে ডুবে থাকতে দেখা গেছে। বাজারে ক্রেতাও ছিল কম। মগবাজার রেলগেটে থেকে কারওয়ান বাজার রিকশা এসেছেন যাত্রী ইয়াসির আরাফাত। তিনি বলেন, পুরো বাজারে হাঁটুপানি। অন্য সময় ভাড়া ৪০ থেকে ৫০ টাকা। আজ ১২০ টাকা দিয়ে এলাম। রাজধানী ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বললেও ভারি বা টানা বর্ষণে এই শহর ডুবে যায় চোখের পলকে। বৃষ্টি শেষ হলেও দীর্ঘ সময় সড়ক থেকে সরে না পানি। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়ে নগরবাসী।

ঢাকাবাসীর অভিযোগ, জলাবদ্ধতা নিরসনে তেমন কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই নগরের মেয়রদের। অন্যদিকে নগর কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, জনগণের অসচেতনতায় এই দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়। নগরবাসী বলছেন বৃষ্টির অগ্রিম বার্তা পাওয়ার পরও সড়কের পানি সরাতে দেরি হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে রাজধানীবাসী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে বিদ্রূপও করছেন অনেকেই। সড়কে চলাচলকারী পথচারীরাও অসন্তোষ প্রকাশ করেন। সবচেয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন সরকারি নিয়োগ পরীক্ষা দিতে বের হওয়া চাকরিপ্রত্যাশীরা। অতি ভারী বৃষ্টির কারণে পানি জমে খালে পরিণত হওয়া সড়কগুলো দিয়ে রিকশা বা সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলারও অবস্থা ছিল না। এতে অনেকে নানা ভোগান্তি নিয়ে যেমন পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছান, অনেকে আবার নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য যেতেই পারেননি। এছাড়া ঢাকায় বৃষ্টির কারণে সকালের দোকানপাট খুলতে দেরি হয়েছে। তার ওপর সড়কে জলাবদ্ধতার কারণে কার্যক্রম পরিচালনা করতেও অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে। অনেকের দোকানের সামনের রাস্তায় পানি জমে থাকায় ক্রেতারাও ফিরে অন্য দোকানে যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ কারও কারও।

সুমি বলেন, বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বাসা থেকে বের হয়েছিলাম কিন্তু বাসার সামনেই পানি থইথই করছিল। কোন রিকশাও পাওয়া যাচ্ছিল না। পানি মাড়িয়ে কিছু দূর যাওয়ার পরও কোনও গাড়ি পাচ্ছিলাম না। পরে দেরি হয়ে যায় দেখে বাসায় ফিরে আসছি। মিরপুর ১১-এর মার্কেটের দোকানিরা সকালে দোকান খুলে রাখলেও কোনও ক্রেতা পাননি বলে জানান। মুন্না স্টোরের দোকানি মো. মুন্না বলেন, দোকান খুলতে দেরি হয়েছে। শুক্রবার সবার ছুটি থাকে। এদিন সবাই বাজারসদাইয়ের জন্য আসেন। কিন্তু আজ কোনও কাস্টমারের দেখা নাই। দেখেন না বাজারের ভেতর দিয়ে ঝরনার মতো পানি বয়ে যাচ্ছে। এদিকে বৃষ্টিতে রিকশা নিয়ে বের হয়েও সুবিধা করতে পারেননি বলে জানান রুহুল আমিন নামে একজন চালক। তিনি বলেন, সকাল থেকে তিনটা ট্রিপ দিতে পেরেছি। বেশিরভাগ সময় বসেই ছিলাম। মিরপুর ঝুটপট্টি দিয়ে তো পানির কারণে যাওয়ায় যায় না। রিকশা ডুবে যায় এমন অবস্থা। জলাবদ্ধতা নিরসনের বিষয়ে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলেছেন, আগের মতো এখন আর দিনব্যাপী জলাবদ্ধতা থাকে না। যেহেতু খালগুলো আমরা ভরাট করে ফেলছি, দখল করছি। এছাড়া যেখানে-সেখানে পলিথিন, বোতল, আবর্জনা ফেলছি। যেগুলো গিয়ে ড্রেনে পড়ছে, সেগুলো পানি নামতে বাধাগ্রস্ত করছে। পানিপ্রবাহ নষ্ট হয়ে যেতে না পেরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। সেই পানি নেমে যেতে সময় লাগছে, সেই সময় তো দিতে হবে।

তিনি আরো বলেছেন, খাল উদ্ধারে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এছাড়া স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে ড্রেন নির্মাণ করে তারপর রাস্তা নির্মাণ হবে। আগে কখনো পরিকল্পিতভাবে ড্রেন ও রাস্তা নির্মাণ হয়নি। এদিকে ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলামের নির্দেশে প্রকৌশল বিভাগ, বর্জ্য বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ ভোর থেকে কাজ করছে। জলাবদ্ধতা পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক তদারকি করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানানো হয় নগর ভবন থেকে। ডিএনসিসির প্রত্যাশা সঠিক ব্যবস্থাপনা ও জনসচেতনতা বাড়লে জলাবদ্ধতা আর থাকবে না। জলাবদ্ধতার জন্য জরুরি সেবা লাইনে ফোন দেওয়ারও অনুরোধ জানায় দুই সিটি। রাজধানীর কোথাও জলাবদ্ধতা তৈরি হলে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের জরুরি সেবার হটলাইনে ফোন দিয়ে জানানো যাবে।