গ্যাস সংকটে তেলে ফিরছে পরিবহন খাত

প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

পরিবহনের জ্বালানি কেনাকাটায় আর্থিক সাশ্রয়ের কথা বিবেচনায় নিয়ে প্রাকৃতিক গ্যাস (সিএনজি) ফিলিং স্টেশনের দিকে ঝুঁকে পড়েন পরিবহন মালিকরা। এতে দেশজুড়ে প্রসার ঘটে সিএনজি ফিলিং স্টেশনের। এখন গ্যাস সংকটে তেলে ফিরছে পরিবহন খাত।

জানা গেছে, খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। দেড় দশক আগে দেশের সিএনজি স্টেশনের প্রসার ঘটে। সরকারের সহযোগিতায় সারা দেশে শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করে পরিবেশবান্ধব সিএনজি স্টেশন স্থাপন করেন বেসরকারি উদ্যোক্তরা। এই সিএনজি স্টেশনকে কেন্দ্র করে নানামুখী সংযোগ শিল্প গড়ে ওঠে। সেখানেও বিনিয়োগ হয়েছে শত শত কোটি টাকা। যেমন সিলিন্ডার, সিএনজি কিটস ফিটিংস, ওয়ার্কশপ ইত্যাদি। মাত্র বারো বছরের মাথায় এসে সরকার সিএনজি স্টেশনকে নিরুৎসাহিত করছে। নতুন করে সিএনজি স্টেশনের অনুমোদন দেওয়া বহু আগে থেকেই বন্ধ রয়েছে।

ডিজেল ও অকটেন স্টেশনগুলোয় পরিবশবান্ধন সিএনজি ফিলিং স্টেশন চালু করতে বাধ্যতা করা হয়। এতে দেশের বিভিন্ন ডিজেল ও অকটেন স্টেশনে সিএনজি চালু করে। এখন সিএনজি স্টেশনগুলো গ্যাসের চাপ কম থাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। চলমান গ্যাসের সংকটে দেশের বহু পরিবহন তেলে চলে গেছে। অন্যদিকে দেশের সিএনজি ফিলিং স্টেশনের মালিকরা তাদের সিএনজি বিক্রির কমিশন প্রতি ঘনমিটারে ৫ টাকা ১০ পয়সা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন। বর্তমানে তারা প্রতি ঘনমিটারে ৮ টাকা কমিশন পান যেটি ২০১৫ সালে নির্ধারণ করা হয়েছিল। তাদের যুক্তি হচ্ছে- ২০১৫ সালের পর শুধু বিদ্যুতের দাম বাড়ার ফলে প্রতি ঘনমিটার গ্যাস বিক্রিতে তাদের ব্যয় বেড়েছে ১ টাকা ৬০ পয়সা। এছাড়া, স্টেশন পরিচালনায় ব্যয় বৃদ্ধি, গ্যাসের চাপ কম থাকায় বিক্রি কমে যাওয়া, মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় প্রতি ঘনমিটারে আরো ৩ টাকা ৫০ পয়সা খরচ হচ্ছে।

বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভার্সন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ফারহান নূর আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, সারাদেশে ৫২৪টি ফিলিং স্টেশন চালু রয়েছে। ৬০ এর অধিক ফিলিং স্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধের পথে। ২০১৪ সালে একটি সিএনজি ফিলিং স্টেশনের বিদ্যুতের দাম ছিল প্রতি ইউনিট (১ কিলোওয়াট-ঘণ্টা) ৩.৪৫ টাকা, যা কয়েকবার বৃদ্ধির পর এখন প্রতি ইউনিট ৫.০৪ টাকায় দাঁড়িয়েছে। গ্যাস সরবরাহে প্রতি ইউনিটে বিদ্যুৎ খরচ গড়ে ১.৬০ টাকা বেড়েছে।

ফিলিং স্টেশনগুলিতে সিএনজি (কমপ্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস) বিক্রিও গত এক দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে বলে জানান অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ফারহান নূর। তিনি বলেন, ২০১৫ সালের মার্চ মাসে যে সিএনজি স্টেশনটি ৯৬ হাজার ৯৩ ঘনমিটার সিএনজি বিক্রি করেছে, ২০২৪ সালের মার্চে সেটির বিক্রি দাঁড়িয়েছে ৬৬ হাজার ৭১৮ ঘনমিটার। ২০১৪ সালে গ্রাহকের কাছে প্রতি ঘনমিটার সিএনজি ৩০ টাকায় বিক্রি করেও ৩.৫৪ টাকা লাভ ছিল। এখন এটি ৪৩ টাকায় বিক্রি করে লাভ ২.৬৮ টাকায় নেমে এসেছে।

পরিবহনের মালিকরা বলেন, পরিবহনে এক লিটার ডিজেল যাত দূর যাওয়া যায়, সেই দূরত্ব অতিক্রম করতে দুই ঘন ফুট সিএনজি লাগে। তার ওপরে সিএনজি চালিত যানবাহনের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ ডিজেল চালিত যানবাহনের চেয়ে বেশি। সিএনজি ফিলিং স্টেশনে গ্যাসের চাপ কম থাকলেও তেলের গাড়িতে সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে- সব সময় তেল পাওয়ায় যায়।

২২টি গাড়ির মধ্যে ৪টি সিএনজি থেকে তেলে রূপান্তর করেছি। সিএনজিচালিত গাড়ির ইঞ্জিন তাড়াতাড়ি খারাপ হয়। কিন্তু তেলচালিত গাড়ির ইঞ্জিন বেশি দিন টেকসই হয়। পরিবহন মালিকেরা সিএনজি বাদ দিয়ে তেলের দিকে ঝুঁকছেন এবং ফিলিং স্টেশনগুলোর মেইটেইনেন্স খরচ বাড়ছে। ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে সারাদেশের সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলো।

অ্যাসোসিয়েশনের দাবি বিবেচনার জন্য এক দশক আগে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বিইআরসিকে (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন) চিঠি দেয়া হয়েছে জানিয়ে ফারহান নূর বলেন, ২০১৭ সালের জুনে আমাদের দাবি পর্যালোচনার জন্য মন্ত্রণালয় নীতিগত কিছু সুপারিশ দিয়ে বিইআরসিকে চিঠি দিয়েছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। আশা করছিলাম, সমাধান পাবো, কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি। আমরা এখন আমাদের বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছি। তবে এটি জরুরি পণ্য হওয়ায় ধর্মঘট কিংবা আল্টিমেটামে যাচ্ছি না।

জ্বালানি মন্ত্রণালয় বলছে, দেশজুড়ে গ্যাস সংকটের কারণেই এ রকম একটি সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। আর সিএনজি নয়, ফের জ্বালানি তেলে ফিরে যেতে হবে পরিবহন খাতকে। সিএনজি স্টেশনগুলো মাত্র ৫ শতাংশ গ্যাস ব্যবহার করে।

গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ শিল্পকারখানা বাঁচিয়ে রাখার জন্য এলএনজি বা তরল গ্যাস আমদানিতে তোড়জোড় চলছে। তবে আমদানি করা গ্যাস সিএনজি স্টেশনকে দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। সরকারের এই নীতিগত অবস্থানের কারণে শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগ সংকটে পড়েছে। সিএনজি স্টেশনের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত ব্যবসায়ীরা।

নাম না প্রকাশ করা শর্তে একজন সিএনজি স্টেশন মালিক বলেন, তার সিএনজি স্টেশন বসেছে ২০১৩ সালে। লাভ তো দূরে থাক, এখনো তার বিনিয়োগ উসল হয়নি। তিনি শুনছেন, সরকার সিএনজি নিরুৎসাহিত করতে চায়। এই ব্যবসা আর বেশিদিন থাকবে না। এখন চিন্তায় পড়েছি। কীভাবে সরকার সিএনজির ব্যবসা নিরুৎসাহিত করতে চায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথম দিকে সিএনজি স্টেশনের দিকে সরকারের যেভাবে নজর রেখেছিল, বর্তমানে সেটি নেই। সিএনজি স্টেশনের সমস্যা নিয়ে নেতারা বহুবার জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছে কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি।