ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সারা দেশে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত

সারা দেশে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত

সারা দেশে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। কোনো কোনো নদনদীর পানি কমলেও বেড়েছে বেশ কয়েকটি নদীর পানি। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে খাবার ও নিরাপদ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। গোচারণ ভূমি ডুবে থাকায় গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন দুর্গতরা।

সিরাজগঞ্জে পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা : উজানের ঢল ও বর্ষণে যমুনা নদীর পানি আবারো বাড়তে শুরু করেছে। এতে সিরাজগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি অবনতির আশংকা দেখা দিয়েছে। গত ২৪ ঘন্টায় ১২ সেন্টিমিটার পানি বেড়ে বিপৎসীমার ৫০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লক্ষাধিক মানুষ এবং পানিতে ডুবে এ পর্যন্ত ৪ শিশুসহ ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে রাতভর দফায় দফায় বৃষ্টি ও উজানের ঢলে যমুনা নদীর পানি আবারো বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে নদীর তীরবর্তী চৌহালী, বেলকুচি, শাহজাদপুর, কাজিপুর ও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার নিম্নাঞ্চল আবারো বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। বন্যার পানিতে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে নিম্নাঞ্চলের অনেক পরিবার স্থানীয় ওয়াবদা বাঁধ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। পানি বাড়তে থাকায় বন্যাকবলিত মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। এদিকে নদী তীরবর্তী ওই ৫টি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে তীব্রভাঙন শুরু হয়েছে। এতে বহু ঘরবাড়ি, গাছপালা ও জায়গাজমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। বিশেষ করে চৌহালী উপজেলার ভূতের মোড় থেকে ময়নাল সরকারের কবরস্থান পর্যন্ত তীব্রভাঙনে কবরস্থানের বেশ কয়েকজনের লাশ যমুনায় ভেসে গেছে। সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন এবং বিষয়টি স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অবহিত করা হয়েছে।

এছাড়া কাজিপুর উপজেলার খাসরাজবাড়ি, তেকানী, নিশ্চিন্তপুর, চরগিরিস, শাহজাদপুর উপজেলার হাটপাচিল, জালালপুর, কৈজুড়ী ও সদর উপজেলার চরাঞ্চলে ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। অনেক পরিবার ভাঙনের মুখ থেকে অনত্র আশ্রয় নিচ্ছে। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (হেডকোর্য়াটার) নাজমুল হাসান জানান, যমুনায় পানি আবারো বাড়ছে। এতে নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন স্থানে ভাঙন শুরু হয়েছে। এর মধ্যেই এ ভাঙন রোধে জরুরি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নজর রাখছেন।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আকতারুজ্জামান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, যমুনায় আবারো পানি বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ১২ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে প্রায় দেড় সপ্তাহ ধরে স্থানীয় এমপি, ব্যক্তিগত উদ্যোগে ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যাকবলিত এলাকার বিভিন্ন স্থানে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। বানের পানি ও পুকুরে ডুবে এ পর্যন্ত ৪ শিশুসহ ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

সুনামগঞ্জে রাতে বেড়ে দিনে কমছে পানি : সুনামগঞ্জে সবকটি নদ-নদীতে রাতে পানি বাড়লেও তা দিনে কমতে শুরু করেছে। তবে রাতের পানিতে শহরের সাহেববাড়ি ঘাট, বাজার এলাকা ও লঞ্চঘাট প্লাবিত হয়েছে। ভারতের মেঘালয় এবং সুনামগঞ্জে ভারি বর্ষণের কারণে নদনদীতে পানি বেড়েছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। গত বুধবার সন্ধ্যায় সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৪৪ সেন্টিমিটার নিচে থাকলেও গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তা ১১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। আর গতকাল শুক্রবার সকালে পানি বিপৎসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও তা বেলা ৩টার দিকে ১৬ সেন্টিমিটারে নেমে আসে বলে জানায় পাউবো।

পানি বাড়ায় দোয়ারাবাজার, ছাতক, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সীমান্ত ও নদী তীরবর্তী এলাকার রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে জেলা শহরের বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, গত বুধ ও বৃহস্পতিবার মেঘালয়ে ৩১০ ও ১১৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। সুনামগঞ্জেও এ দুই দিন ২৬০ ও ১৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে পাহাড়ি ঢলে পানি বেড়েছে। রাতে নদ-নদীর পানি বাড়লেও গতকাল শুক্রবার দুপুর থেকে পানি কমতে শুরু করেছে। বেলা ৩টায় পানি ১৬ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ৭ দশমিক ৯৪ মিটার উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছে। তবে এখনো পানি বিপৎসীমার ১৪ সেন্টিমিটার উপরে আছে। ভারি বর্ষণ ও ঢল অব্যাহত থাকলে সুনামগঞ্জে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে জানান পাউবোর এই কর্মকর্তা। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, নদ-নদীর পানি বাড়লেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। আশ্রয়কেন্দ্র ও ত্রাণ প্রস্তুত আছে। এখনও ২১টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় পাঁচ শতাধিক বন্যার্ত লোকজন আছেন। রাতে পানি বাড়লেও দুপুর থেকে তা কমতে শুরু করেছে; তবে নতুন করে কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠেননি বলে তিনি জানান।

কুড়িগ্রামের বন্যার দুর্ভোগ দীর্ঘ হচ্ছে : কুড়িগ্রামের ১৬টি নদনদীর পানি গত দুদিন ধরে কিছুটা কমে আবারো বাড়তে শুরু করেছে। ফলে জেলার ৯ উপজেলার ৫৫ ইউনিয়নের প্রায় দুই লাখ পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি আর গবাদিপশুর খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। জেলা প্রশাসন থেকে ত্রাণ কার্যক্রম চলমান থাকলে গোখাদ্য সংকট নিয়ে দুঃশ্চিন্তা আছে বানভাসীরা।

গত ১০ দিন ধরে জেলার ৯ উপজেলার দুই লাখ পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। রাস্তাঘাট তলিয়ে যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। কয়েক দিনের বন্যায় নাগেশ্বরী উপজেলার দুটি বাঁধ ভেঙে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। চর দ্বীপ চর ও নিম্নাঞ্চলের মানুষের ঘরে চাল ডাল থাকার পরেও রান্না করে খেতে পারছেন না। ফলে খেয়ে না খেয়ে কোনোরকম বেঁচে আছেন এই বানভাসী মানুষগুলো। অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে পরিবারের লোকজন উঁচু স্থানে অবস্থান করছে। উপায় না পেয়ে অনেককে নৌকার ভেতর রাত কাটাতে হচ্ছে। এমন দুর্ভোগে সরকারি ও বেসরকারিভাবে সহযোগিতার আশা করছেন বানভাসীরা। সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের রলাকাটা গ্রামের মো: আজগার আলী বলেন, টানা ১০ দিন ধরে ঘরে বাইরে পানি। মাচার উপর ছোট বাচ্চাদের নিয়ে খুব কষ্টে আছি। কাজ কামাই নাই, খাওয়ার কষ্ট, থাকার কষ্ট। কী করি, কোথায় যাই। আরেক বাসিন্দা মো: মামুন বলেন, ‘পানি কমে আবার বাড়তেছে। মানুষের দুর্ভোগের মতো গরু ছাগল নিয়ে আমরা বিপাকে পড়েছি। পানিতে কতক্ষণ গরু দাঁড়িয়ে থাকে? দূরে কোনো জায়গায় রেখে আসব, সে ভরসা পাই না। কখন যে চুরি হয়ে যায়?’

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আব্দুল হাই সরকার বলেন, জেলার বন্যাকবলিতদের জন্য গত বুধবার দুপুর পর্যন্ত ৫৪২ টন চাল, ৩২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ও ২৩ হাজার ১২০ প্যাকেট শুকনা খাবার ৯ উপজেলায় বিতরণ চলমান রয়েছে। গোখাদ্যের কোনো বরাদ্দ নেই।

রাজবাড়ীতে বিপৎসীমার ওপরে পদ্মার পানি : উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও গত কয়েক দিনের ভারি বর্ষণে রাজবাড়ী জেলার সকল নদনদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় জেলার ছয়টি পয়েন্টেই নদনদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে পদ্মা নদীর গোয়ালন্দ পয়েন্টে ২৪ ঘণ্টায় ১৪ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া জেলার প্রত্যেকটি নদনদীতে প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটারের বেশি পানি বাড়ছে। এভাবে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে অচিরেই জেলার নিম্নাঞ্চলগুলোতে বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। এর মধ্যেই পানি বৃদ্ধির কারণে জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া এলাকায় নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দৌলতদিয়ার পানি পরিমাপক (গেজ পাঠক) সালমা খাতুন জানান, উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে রাজবাড়ী জেলার সকল নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। গোয়ালন্দ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। রাজবাড়ী পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।

সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় (১১ জুলাই সকাল ৬টা থেকে ১২ জুলাই সকাল ৬টা পর্যন্ত) ১৪ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে পদ্মা নদীর গোয়ালন্দ পয়েন্টে পানির লেভেল রয়েছে ৭ দশমিক ৯৩ সেন্টিমিটার, এই পয়েন্টে পানির বিপৎসীমা ৭ দশমিক ৯০ সেন্টিমিটার। গোয়ালন্দে পদ্মার পানি বিপৎসীমার ৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় কুমার নদীর পানি ২৪ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে পানির লেভেল রয়েছে ৮ দশমিক ২৩ সেন্টিমিটারে, এই পয়েন্টে পানির বিপৎসীমা ৯ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার। একইসঙ্গে গত ২৪ ঘণ্টায় গড়াই নদীর পানি বেড়েছে ৩১ সেন্টিমিটার, এই নদীর কামারখালী ব্রিজ পয়েন্টে পানির বর্তমান লেভেল রয়েছে ৫ দশমিক ৮৫ সেন্টিমিটার। এই পয়েন্টে পানির বিপৎসীমা ৭ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার। অপরদিকে, গত ২৪ ঘণ্টায় হড়াই নদীর মহেন্দ্রপুর পয়েন্টে পানি বেড়েছে ২৪ সেন্টিমিটার। এই পয়েন্টে পানির লেভেল রয়েছে ৮.৩৮ সেন্টিমিটার। এই পয়েন্টে পানির বিপৎসীমা ৯.৭৫ সেন্টিমিটার। পানি বৃদ্ধি পেয়েছে চন্দনা নদীতেও। গত ২৪ ঘণ্টায় গতমপুর এলাকায় চন্দনা নদীর সেনগ্রাম পয়েন্টে পানি বেড়েছে ২৭ সেন্টিমিটার। এই পয়েন্টে বর্তমানে পানির লেভেল ৮ দশমিক ৫২ সেন্টিমিটার। এই পয়েন্টের পানির বিপৎসীমা ১০ দশমিক ৫২ সেন্টিমিটার এবং গত ২৪ ঘণ্টায় চত্রা নদীর নাড়ুয়া পয়েন্টে পানি বেড়েছে ৩১ সেন্টিমিটার। এই পয়েন্টে পানির লেভেল রয়েছে ৫ দশমিক ৯৫ সেন্টিমিটার। এই পয়েন্টে পানির বিপৎসীমা ৭ দশমিক ৮৫ সেন্টিমিটার।

রাজবাড়ী জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সৈয়দ আরিফুল হক জানান, বন্যার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে সভা করেছেন এবং তাদের ব্যাপক প্রস্তুতিও রয়েছে। এখন পর্যন্ত জেলার কোথাও বন্যা ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার খবর পাননি। তারপরও প্রস্তুতি হিসেবে ১২টি ফ্লাড শেল্টার প্রস্তুতের পাশাপাশি ৬০০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১২ লাখ টাকা মজুত রাখা হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত