ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

এবার ভয়াবহ রূপ নিতে পারে ডেঙ্গু

এবার ভয়াবহ রূপ নিতে পারে ডেঙ্গু

দেশে নানা ডামাডোলের মধ্যে ডেঙ্গুর প্রকোপের বিষয়টি অনেকটা আড়ালে পড়ে গেছে। অথচ সারা দেশে ডেঙ্গু-আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে এ বছর ভয়াবহ রূপ নিতে পারে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। অন্যদিকে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন মশা নিধনে ওষুধ ছিটানোর চেয়ে এবার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি বিপজ্জনক হয়ে ওঠার কারণ মূলত অপরিকল্পিত নগরায়ণ, মশক নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা এবং স্বাস্থ্য খাতের দুরবস্থা। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মশার ওষুধ ছিটানো এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মতো বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা থাকলেও এখনো সেভাবে তা চোখে পড়ছে না।

তারা বলেছেন, একদিনে বা এক বছরে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা যায় না। অব্যাহত প্রচেষ্টায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সুফল মিলতে পারে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এডিসের উৎপাত বেড়েছে। এ প্রজাতির মশা প্রতিকূল জলবায়ুর সঙ্গে টিকে থাকার সক্ষমতা অর্জন করতে শুরু করছে। তাই ধারণা করা যায়, এডিসের উৎপাত বছরজুড়েই বাড়বে। কাজেই ডেঙ্গু থেকে সুরক্ষা পেতে বছরব্যাপী মশক নিধন ও অন্যান্য কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। সেই সঙ্গে নাগরিকদেরও খেয়াল রাখতে হবে-তাদের বাসার আশপাশের খোলা স্থানে কোথাও যেন পানি জমে না থাকে।

এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ গতবারের চাইতে বেশি হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি বলেন, এবার এডিসের লার্ভার ঘনত্ব বেশি। বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু বেড়ে যেতে পারে। সিটি কর্পোরেশনের এমন কোনো কাজ চোখে পড়েনি যাতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রিত থাকবে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে অংশীজন কর্তৃপক্ষ-সংস্থা ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। তিনি বলেন, দৈনন্দিন নিয়মিতভাবে সকালে-বিকালে আমাদের মশককর্মীরা কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়াও এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসের মাধ্যমে ডেঙ্গু রোগ নিয়ন্ত্রণে আমরা গত মে মাসে সকল সংশ্লিষ্ট সংস্থা, কর্তৃপক্ষের সাথে মতবিনিময় করেছি, দিকনির্দেশনা দিয়েছি। মন্ত্রণালয় থেকেও সভা করে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে তিনি বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট অংশীজন সংস্থা-কর্তৃপক্ষকে দায়িত্বশীলতার সাথে এগিয়ে আসতে হবে। নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান নিজেরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবে। পানি জমতে দিবে না। নিয়মিত জমা পানি ফেলে দিবে। এজন্য যদি ব্লিচিং পাউডার, কেরোসিন, লার্ভিসাইডিং, এডাল্টিসাইডিং - যা যা প্রয়োজন তা আমরা দিতে প্রস্তুত। আমাদেরকে জানানোর সাথে সাথে আমাদের কর্মীবাহিনীর মাধ্যমে সে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। কিন্তু তাদের সে দায়িত্বটা অবশ্যই নিতে হবে।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেছেন, বর্ষার মৌসুম চলছে। কখনো বৃষ্টি আবার কখনো রোদ। এটি এডিস মশার বংশ বিস্তারের উপযুক্ত সময় ও পরিবেশ। আমাদের সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে আমাদের বাসা-বাড়িসহ আঙিনার কোথাও পানি জমে থাকছে কি না। যদি পানি জমে থাকে পাত্রটি উল্টে দিন। পরিত্যক্ত পাত্র কাজে না লাগলে ধ্বংস করে ফেলুন। কারণ এসব পাত্রেই এডিস মশা বংশ বিস্তার করে।

এসব বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, মশা নিধনে বাংলাদেশে ডেল্টামেথ্রিন, আলফাসাইপারমেথ্রিন, পারমেথ্রিন, ইটোফেনপ্রক্স, বেনডিওক্রাব ও মেলাথিয়ন নামীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিন্তু মেলাথিয়ন ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ কার্যকরী না। এসব ওষুধ দিয়ে মশা মরবে না। এটি নিয়ে আরো গবেষণা করা দরকার। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ শুধুমাত্র সিটি কর্পোরেশনের পক্ষে সম্ভব নয়। এ কাজে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি ও জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে।

তিনি বলেন, আমরা জানি ডেঙ্গু মশা পরিস্কার পানিতে ডিম পারে, এটি সত্য নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ডেঙ্গু মশা পরিষ্কার পানি না পেলে ময়লা পানিতেই ডিম পারে। ডেঙ্গু মশা সব ধরনের পানিতে তাদের জীবনচক্র গঠন করতে পারে। শুধুমাত্র পরিষ্কার পানির কথা বিবেচনায় নিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের কর্মসূচি নিলে তা হলে ভুল হবে। এতে ডেঙ্গু মশা বাড়তেই থাকবে।

ডঙ্গু মশা কামড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, মানুষের ধারনা ডেঙ্গু মশা দিনের বেলায় কামড়ায়। এখন কৃত্রিম আলোর তীব্রতা বাড়ায় রাতের বেলায়ও ডেঙ্গু মশার কামড়ায়। ডেঙ্গু শুধু শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। মহিলাদের মধ্যে মৃত্যুহার বেশি। গবেষণালব্ধ ফলাফলগুলোকে আরো কার্যকরী প্রতিরোধের জন্য বিবেচনায় নেওয়া উচিত।

অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার আরো বলেন, সার্ভিলেন্স কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। সার্ভিলেন্স কার্যক্রম ভালো মতো করা হলে দেখা যাবে কোথায় মশার ডেনসিটি বেশি এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের সবচেয়ে বেশি গুরত্ব দিতে হবে লার্ভা রিডাকশন। আমাদের ভবনগুলোর কারপার্কিংয়ের যেখানে গাড়ি ধোয়া হয়, সেই পানি নিষ্কাশনে ড্রেনেজ সিস্টেমটা ভালো নয়। ফলে গাড়ি ধোয়ার পানি এক কোনায় গিয়ে জমা হচ্ছে আর সেই পানিতে ডেঙ্গু মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। বাড়ির কোথায় যেন পানি না জমে সেই দিকে নজর দিতে হবে।

জানা যায, গত এক দিনে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে ৪৫ জন ঢাকা মহানগরের। মহানগরের বাইরে ঢাকা বিভাগের ১৫ জন, চট্টগ্রামের ২৩, বরিশালের ১০, খুলনার ৮ ও ময়মনসিংহ বিভাগের দুজন রয়েছে।

বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ৩১৫ জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে। তাদের মধ্যে ঢাকায় ভর্তি আছে ১৫৩ জন এবং ঢাকার বাইরে এই সংখ্যা ১৬২ জন।

নতুন রোগীদের নিয়ে চলতি বছরের এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৩১১ জনে। তাদের মধ্যে ৪৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।

জনস্বাস্থ্যবিদ বেনজির আহমেদ বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসায় সফল হয়েছে এমন প্রমাণভিত্তিক পদক্ষেপ দরকার ছিল। কিন্তু স্থানীয় সরকার ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তা নেয়নি, সেই সক্ষমতা তাদের নেই, সক্ষমতা তৈরির প্রচেষ্টাও নেই। ডেঙ্গুকে দুই মন্ত্রণালয় হালকাভাবে নিয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল বড় শহরসহ সারা দেশে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত