সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী

জঙ্গিবাদ থামিয়েছি, এখন দুর্নীতিবাজদের ধরছি

* কোটাবিরোধী ও শিক্ষকদের আন্দোলন নিয়ে ‘কঠোর’ * প্রশ্নফাঁসের সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা * হাওয়া ভবনের তালিকায় বিসিএসের চাকরি হয়েছে * আন্দোলনকারী শিক্ষকরা ক্লান্ত হোক, তখন কিছু বলবো

প্রকাশ : ১৫ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  বিশেষ প্রতিবেদক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, প্রথমে আমরা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি, এতে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ হয়েছে। এবার দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সরকার কঠোর হওয়ার কারণেই দুর্নীতিবাজরা ধরা পড়ছে। এর আগে কেউ দুর্নীতির বিরুদ্ধে এভাবে অভিযান করেনি। দুর্নীতি দীর্ঘদিনের সমস্যা। এসব জঞ্জাল সাফ করতে হবে। আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি বলেই জানতে পেরেছেন। গতকাল রোববার গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রতিক চীন সফর নিয়ে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

নানা খাতে দুর্নীতির চিত্র সামনে আসছে। ভবিষ্যতে দুর্নীতির বিষয়ে অবস্থান কী হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দুর্নীতিবাজদের ধরলেই সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে, এটা বিশ্বাস করি না। আমার দায়িত্ব, অনিয়মগুলো ধরে দেশকে একটা অবস্থায় নিয়ে যাওয়া। দুর্নীতি নিচের দিকে বেশি হচ্ছে। দুর্নীতি এমন পর্যায়ে ছিল, কাজই করা যেত না। সেখান থেকে পরিস্থিতি তো বদলেছে। হাত যখন দিয়েছি, ছাড়ব না। আপন-পর জানি না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সই থাকবে।’ দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের বাসার সাবেক এক কর্মীর অর্থসম্পদের বিষয়টি সামনে এনেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার বাসায় কাজ করেছে, পিয়ন ছিল সে, এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না। বাস্তব কথা। কী করে বানাল এত টাকা? জানতে পেরেছি পরেই ব্যবস্থা নিয়েছি।’ সরকারি চাকরিতে বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা সুবিধা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-নাতনিরা কোটা সুবিধা পাবে? এমন প্রশ্ন রেখে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিরা কোটা পাবে? তা তো আমরা দিতে পারি না। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার তাদের কে দিয়েছে? তারা দেশ স্বাধীন করার জন্য জীবনপণ লড়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায় কীভাবে? মুক্তিযুদ্ধ তাদের এখন ভালো লাগে না।’

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে আন্দোলনে নেমেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা। পাশাপাশি সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কিম বাতিলের দাবিতে টানা দুই সপ্তাহ সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করছেন শিক্ষকরা। এ দুই ইস্যুতে দেশে অস্থিরতা বিরাজ করছে। দুর্ভোগে পড়েছে মানুষ। কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে সরকারের কিছুই করার নেই বলে আবারো সাফ জানিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন করে মানুষকে দুর্ভোগে ফেলানোয় আন্দোলনকারীদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। একইসঙ্গে এ আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবার সম্পর্কে নেতিবাচক যেসব কথাবার্তা বলা হচ্ছে, তা সহ্য করার মতো নয় বলেও মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালে তারা একবার আন্দোলন করেছিল। সেটা আন্দোলন তো নয়, সহিংসতা। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করেছিল। তখন আমি বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম ঠিক আছে, সব কোটাই বাদ দিয়ে দিলাম। তখনই বলেছিলাম যে, কোটা বাদ দিলাম দেখেন কী অবস্থাটা হয়। সেটা এখন তো দেখতে পারছেন, কী অবস্থার তৈরি হয়েছে?’

আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করলেও সরকার কীভাবে চলে, বিচার বিভাগ কীভাবে চলে; তা নিয়ে ধারণা নেই বলেও ক্ষোভ জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আমরা যেভাবেই হোক কোটা বাতিল করেছিলাম। এখন সেটা যখন আদালতে গেলো। তখন তো সেটা নিয়ে আমাদের কিছু করার নেই।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা এখন আবার আন্দোলন করছে, তারা তো আইন-আদালত মানবে না। সংবিধান কী, সেটা তারা চেনে না। সরকার কীভাবে চলছে, সেই জ্ঞানও নেই। হ্যাঁ, পড়াশোনাটা করছে, ভালো রেজাল্ট হয়তো করছে। তবে রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়েও তাদের জানা উচিত, শেখা উচিত।’

অন্যদিকে সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কিম বাতিল করার দাবিতে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে আন্দোলন করছেন, সেটা ভ্রান্ত ধারণার ওপর ভিত্তি করে চলছে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংবাদ সম্মেলনে এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তাদের (বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের) মধ্যে ভ্রান্ত কিছু ধারণা আছে। সেগুলো আমি নোট করে রেখেছি। তাদের অবশ্য জানানোও হয়েছে। তারপরও তারা আন্দোলন চালাচ্ছেন, চালাতে থাকেন। টায়ার্ড (ক্লান্ত) হোক, তখন কিছু বলবো।’

সরকারপ্রধান বলেন, ‘শিক্ষকদের ভুল ধারণা যে, পেনশন ফান্ড আছে, আসলে ফান্ড নেই। তাদের টাকা থেকেই পেনশন দেওয়া হয়। সর্বজনীন পেনশন স্কিম করে দিয়েছি সবার জন্য। এই যে সাংবাদিকরা, আজকে তাদের চাকরি না থাকলে কিছুই করার নেই। কীভাবে চলবে?’

তিনি বলেন, ‘বেতন নিয়েও তাদের ধারণা এতই বিভ্রান্তিকর যে, বলার মতো না। আরেকটা হলো- কোন বছর থেকে প্রত্যয় স্কিম চালু হবে? ২০২৪ নাকি ২০২৫ সালের জুলাইয়ে। সেটাও আমরা ক্লিয়ার (স্পষ্ট) করে দিয়ছি।’

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে কোনো পরীক্ষা নয়, হাওয়া ভবন থেকে পাঠানো তালিকায় বিসিএসে চাকরি হতো বলে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেখুন, ২৪তম বিসিএস পরীক্ষা হয়েছিল ২০০২ সালে। বিএনপির আমলে সেই সময়ে যত পরীক্ষা হতো, চাকরি হতো, সব হাওয়া ভবন থেকে তালিকা পাঠানো হতো। সেই তালিকা অনুযায়ী চাকরি হতো। ঢাকা কলেজে সেই সময় একটা বিশেষ কামরা রাখা হতো। সেখানে বসে তাদের লোক পরীক্ষা দিতো। তাদেরই চাকরি হতো। কোনো উচ্চবাচ্য সেসব কিন্তু নেই।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘প্রশ্নফাঁস করে নিজেদের লোককে চাকরি দেওয়াটা সেই জিয়ার আমল থেকে শুরু হয়েছিল। খালেদার আমলে সেটা চলেছে। আমরা এটা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছি এবং সফল হয়েছি। কোটা বাতিলের পর অনেকে চাকরিতে ঢুকে গেলো। তারা এখন অনেক জায়গায় বসে এসব প্রশ্নফাঁসসহ বিভিন্ন অপকর্ম করছে।’ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, জাতীয় সংসদের উপনেতা ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মতিয়া চৌধুরী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু, তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত প্রমুখ। সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খান।