ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

শিক্ষকদের আন্দোলন

সেশনজটের শঙ্কায় শিক্ষার্থীরা

সেশনজটের শঙ্কায় শিক্ষার্থীরা

বেশ কিছুদিন ধরে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। কোটাবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকরাও নেই ক্লাসে। সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কিম বাতিলের দাবিতে টানা দুই সপ্তাহ ধরে কর্মবিরতিতে শিক্ষকরা। একই দাবিতে আন্দোলনে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। এতে অচল দেশের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে এমন আন্দোলনে চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছেন চলতি শিক্ষাবর্ষে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির প্রথম বর্ষে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা। মেধা তালিকায় জায়গা পেলেও ভর্তি হতে পারছেন না অনেকে। আবার কেউ কেউ অপেক্ষমাণ তালিকায় ঝুলে আছেন। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাবেন কি না, তা নিশ্চিত না হওয়ায় অনেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হতে পারছেন না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গুচ্ছভুক্ত দেশের ২৪টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। দ্বিতীয় ধাপে ভর্তির প্রক্রিয়া চলাকালীন শিক্ষকদের আন্দোলনে স্থগিত ভর্তি কার্যক্রম। প্রকৌশল গুচ্ছভুক্ত তিনটি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও চতুর্থ ধাপের ভর্তির কার্যক্রম আটকে আছে। চট্টগ্রাম, খুলনা এবং রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছুরা অনিশ্চতায় দিন গুনছেন। অন্যদিকে কৃষি গুচ্ছভুক্ত ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভবই হয়নি।

ভর্তি শেষে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটে ক্লাস শুরুর কথা ছিল। তবে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নবাগতদের ক্লাস শুরু করা সম্ভব হয়নি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরুর আগেই সেশনজটে পড়তে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।

দেশের পুরোনো ও বড় (শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিবেচনায়) চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কার্যক্রম এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কাজ শেষ হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ভর্তি শেষ হলেও স্থগিত রয়েছে আবাসিক হলে ভর্তিসহ বিভিন্ন কার্যক্রম। ভর্তি শেষে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটে ক্লাস শুরুর কথা ছিল। তবে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নবাগতদের ক্লাস শুরু করা সম্ভব হয়নি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরুর আগেই সেশনজটে পড়তে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।

ভর্তি কমিটির প্রধানদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গুচ্ছভুক্ত ২৪ বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট আসন প্রায় ২১ হাজার। এরমধ্যে ভর্তি শেষ হয়েছে সাড়ে ১৬ হাজার আসনে। এখনো সাড়ে চার হাজার শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য ঝুলে আছেন। কৃষি গুচ্ছভুক্ত ৯ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন প্রায় চার হাজার। সেখানে এখনো ভর্তি পরীক্ষা না হওয়ায় আবেদন করা ৭০ হাজার শিক্ষার্থী অনিশ্চয়তায় দিন গুনছেন। এছাড়া প্রকৌশল গুচ্ছভুক্ত তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাড়ে তিন হাজার আসনের মধ্যে এখনো প্রায় ৭০০ আসন ফাঁকা। সেখানে ভর্তির জন্য অনেকে অপেক্ষমাণ তালিকায় ঝুলে আছেন।

ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসএসসি ও এইচএসসিতে যত ভালোই রেজাল্ট হোক, ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারলে ক্যারিয়ার থেমে যায়। মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য মুখিয়ে থাকেন। কারণ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য নেই তাদের। প্রত্যয় স্কিম বাতিলের দাবিতে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যে আন্দোলন চলছে, তাতে পরোক্ষ সমর্থন রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনেরও। ফলে কর্মসূচি শুরুর আগেই নোটিশ দিয়ে ভর্তি কার্যক্রম স্থগিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন।

গুচ্ছভুক্ত ২৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কমিটিতে এবার আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন। তিনি জানান, ‘আন্দোলন চলছে, শিক্ষক হিসেবে তাতে আমাদের সমর্থন আছে এটা ঠিক। তবে প্রশাসনিক দিক দিয়ে আমরা সক্রিয়। কিন্তু এক্ষেত্রে কাদের দিয়ে কাজ করব? লোকবল তো নেই। তারা তো আন্দোলনে। বাধ্য হয়ে ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হয়েছে।’

রাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার জানান, ‘শিক্ষকরা কর্মবিরতি করছেন, কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও কাজ করছেন না। এখানে প্রশাসনের কিছু করার নেই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখানে নিরুপায়।’

তিন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বিত ভর্তি কমিটির সভাপতি চুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সুদীপ কুমার পাল জানান, ‘জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে আমাদের ভর্তি কার্যক্রম শেষ করার কথা ছিল। ৩১ জুলাই ওরিয়েন্টেশন ক্লাস হওয়ার কথা সেগুলো সব স্থগিত করেছি। এখন যে পরিস্থিতি যদি দ্রুত আন্দোলন থেমেও যায়, তবুও ভর্তি শেষ করে ক্লাস শুরু করতে আগস্ট পার হয়ে যাবে।’

দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অচল। ক্লাস-পরীক্ষা ও প্রশাসনিক সব কাজ বন্ধ। পদে পদে ভোগান্তিতে পড়ছেন শিক্ষার্থীরা। বেশি বিপাকে ভর্তিচ্ছুরা। তবে তাদের জন্য কিছুই করার নেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি)।

ইউজিসির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্বে) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেছেন, ‘শিক্ষকরা দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করলে সেটা নিয়ে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা দেওয়ার এখতিয়ার তো আমাদের নেই। আমরা পরামর্শ দিতে পারি। এটা মন্ত্রণালয় তথা সরকার পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নেবে।’

সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা ‘প্রত্যয়’ স্কিমে স্ব-শাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অন্তর্ভুক্তি বাধ্যতামূলক। গত ১ জুলাই থেকে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা এ কর্মসূচির মাধ্যমে এর জোর বিরোধিতা শুরু করেন।

এমন পরিস্থিতিতে ফেডারেশনের নেতারা বলছেন, কোনো সমাধান না হলে কঠোর আন্দোলন-কর্মসূচিতে যাবেন তারা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, যেসব সরকারি কর্মচারী রাজস্ব খাত থেকে বেতন পান, তাদের টাকা জমা হয় জিপিএফে। আর যারা রাজস্ব খাতের বাইরে থেকে বেতন পান, তাদের টাকা জমা হয় সিপিএফে। অবসরে যাওয়ার পর তারা এই টাকা পেয়ে থাকেন।

অর্থ বিভাগের তথ্যমতে, বিদ্যমান সিপিএফ ব্যবস্থায় কর্মচারী দেয় মূল বেতনের ১০ শতাংশ এবং প্রতিষ্ঠান দেয় মূল বেতনের ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ। ‘প্রত্যয়’ স্কিমে প্রতিষ্ঠান দেবে মূল বেতনের সমান অর্থাৎ ১০ শতাংশ। বিদ্যমান সিপিএফ ব্যবস্থা থেকে তা ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি।

প্রসঙ্গত, গত ২০ মার্চ অর্থ বিভাগ ‘প্রত্যয়’ স্কিম চালুর প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী গত ১ জুলাই থেকে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা ‘প্রত্যয়’ স্কিমে স্ব-শাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যেসব শিক্ষকরা ১ জুলাই থেকে নিয়োগ পাবেন তারা এই স্কিমের অন্তর্ভুক্ত হবেন। তবে বিদ্যমান শিক্ষকরা এর আওতার বাইরেই থাকবেন। আন্দোলনকারী শিক্ষকরা বলছেন ‘প্রত্যয়’ স্কিমের ফলে মেধাবীরা আর শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহী হবেন না। আর তাই সর্বজনীন পেনশন স্কিম বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। ‘প্রত্যয়’ স্কিম থেকে শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি প্রত্যাহার, স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন ও প্রতিশ্রুত সুপারগ্রেডে অন্তর্ভুক্তির দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন তারা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত