কোটা পদ্ধতি সংস্কার

উত্তাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস

প্রায় আড়াই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত

প্রকাশ : ১৬ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  লিটন ইসলাম, ঢাবি

সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে টানা কয়েক দিন ধরে আন্দোলন করছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটাবিরোধীদের ওপর ছাত্রলীগের দফায় দফায় হামলা, মারধর ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রায় আড়াই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। আহত শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

আহত শিক্ষার্থীদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। আহতদের মধ্যে আটজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তারা হলেন- কাজী তাসনিম (২৪), ইয়াকুব (২৪), অমি আক্তার (২৬), আমিনুর (২২), শুভ (২৫), গিয়াস উদ্দিন (২২), নাসির (২৩) ও অপি (২২)।

সরেজমিন দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে দেয়া বক্তব্যের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে দুপুর সাড়ে বারোটা থেকে জড়ো হতে শুরু করেন কোটাবিরোধীরা। এতে যোগ দেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজ, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। অবস্থান চলাকালীন কোটাবিরোধীদের একটি দল মিছিল নিয়ে দুপুর ২টার দিকে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের হলপাড়ায়। সেখানে আগে থেকেই লাঠিসোঁটা, হকিস্টিক ও মাথায় হেলমেট পরা অবস্থায় প্রস্তুত ছিলেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। কোটাবিরোধীরা হলপাড়ায় পৌঁছালে তাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায় তারা। আকস্মিক এ হামলায় কিছু বুঝে উঠতে না পেরে কোটা আন্দোলনকারীদের অনেকেই আহত হন। এই খবর টিএসসিতে অবস্থিত আন্দোলনকারীরা জানতে পারলে ৩টার দিকে মিছিল নিয়ে হলপাড়ায় ছুটে যান শিক্ষার্থীরা। সেখানে পৌঁছালে শুরু হয় সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া। এ সময় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মাথায় হেলমেট, হাতে বাঁশ ও কাঠের লাঠি, রড- কারো কারো হাতে ছিল রামদা। এই হামলায় একাত্তর হল ছাত্রলীগের সাথে একে একে যোগ দেয় জিয়া হল, বঙ্গবন্ধু হল, জসীম উদ্দিন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। প্রায় বিশ মিনিট হামলা, সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার পর পিছু হটতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। অবস্থান নেন ভিসি চত্বর এলাকায়। সেখানে একযোগে হামলা শুরু করে ছাত্রলীগ। চতুর্মুখী হামলায় দিশাহারা হয়ে পড়েন কোটাবিরোধীরা। তাদের একটি দল ফুলার রোড হয়ে এবং আরেকটি দল স্যার এএফ রহমান হলের সামনের রাস্তা দিয়ে নীলক্ষেতের দিকে সরে যায়। শিক্ষার্থীরা যখন পিছু হটছিলেন, তখন সামনে যাকে পান, তাকেই পেটান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ১৬ ব্যাচের ছাত্রী তানজিলা তাসনীম বলেন, ‘ভিসি চত্বরে মৈত্রী হলের এক মেয়ের হাতে ইটপাটকেল লাগার কারণে নড়তে পারছিল না। ফলে আমি ওকে ছেড়ে আসতে পারিনি। এ সময় হেলমেট পরা কয়েকজন এসে আমাদের সরে যেতে বলেছে। আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করব। আমি বলেছিলাম, আমি জাস্ট যৌক্তিক আন্দোলনে ছিলাম। তারপর উনি আমার ডান হাত মুচড়ে দিয়েছে। আমরা এখন ওই মেয়েকে নিয়ে মেডিকেলে এসেছি। আমার খারাপ লাগছে, নিজ ক্যাম্পাসে এভাবে হামলার স্বীকার হয়েছি।’

এদিকে ভিসি চত্বরে মাথা ফাটলে এক শিক্ষার্থী চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল রওনা দেন। তিনি রিকশায় ওঠার সাথে সাথেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। তখন কয়েকজন সংবাদকর্মী তাকে ধরে রিকশায় তুলে দেন।

ঢামেকেও হামলা : এদিকে আহত শিক্ষার্থীদের যারা ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান, তাদের ওপরও হামলা করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। বিকাল সোয়া পাঁচটার দিকে ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের সামনে গিয়ে তাদের মারধর করে বের করে দেন। এরপর ঢাকা মেডিকেলের সামনের সড়কে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।

বিকাল সাড়ে পাঁচটায় কার্জন হল এলাকায় বিজ্ঞানের হলগুলোতে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগ, ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ এবং ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় বেশ কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।

জানা যায়, বিজ্ঞানের হলগুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই কোটা সংস্কারের পক্ষে। ফলে শিক্ষার্থীদের মারধরের খবরে হলে ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী নেতার কক্ষ ভাঙচুর করা হয়। খবর পেয়ে রাজু ভাস্কর্য থেকে মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কার্জন হল এলাকায় জড়ো হয়। পরে শিক্ষার্থীরা ওপর থেকে ইটপাটকেল ছুঁড়তে থাকে। এ সময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করতে দেখা যায় এক তরুণকে। প্রায় আড়াই ঘণ্টা সংঘর্ষের পর ঢাকা মেডিকেল এলাকায় অবস্থান নেয় পুলিশের সদস্যরা।

ইডেনে ছাত্রলীগের হামলা : কোটা আন্দোলনের জেরে ইডেন কলেজের ভেতরে শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মারধরের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। তাদের মধ্যে অন্তত চারজনকে গতকাল দুপুরে ঢামেকে চিকিৎসা নেন। তারা হলেন- মার্কেটিং বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্রী ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফন্টের ইডেন কলেজ শাখা সভাপতি শাহিনুর সুমি, ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সায়মা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষের তামান্না ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সানজিদা।

আহতরা ও তাদের সহপাঠীরা জানান, চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে তারা অংশ নিয়ে আসছিলেন। গতকাল যখন তারা টিএসসিতে কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতে অংশ নিতে যাবেন সে সময় ইডেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কলেজের ভেতর তাদের ওপর চড়াও হয়। একপর্যায়ে তাদের মারধর করে। মোবাইল ফোন দিয়ে সুমির মাথায় আঘাত করে। সহপাঠীরা প্রথমে তাদের উদ্ধার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যান। সেখান থেকে পরবর্তীতে তাদের ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা হয়।

এদিকে কোটাবিরোধীদের শিবির ও ছাত্রদল আখ্যা দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন ও সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত। শয়ন বলেন, ওরা সাধারণ শিক্ষার্থী নয়, বিএনপির ইশরাকের কর্মী। আপনারা গণমাধ্যম অন্ধ হয়ে গেছেন। এই আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থী ১০ থেকে ২০ শতাংশ। বাকি ৮০ শতাংশ শিবির-ছাত্রদলের এক্টিভিস্ট।

এ বিষয়ে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফর্ম ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ বলেন, ছাত্রলীগ আমাদের উপর ন্যক্কারজনক হামলা চালিয়েছে। আমাদের নারী শিক্ষার্থীদের তারা বেধড়ক পিটিয়েছে। এই হামলায় অন্তত দুইশত শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের অনেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

যা বলছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন : গতকাল বিকাল ৫টায় হল প্রাধ্যক্ষদের নিয়ে জরুরি সভা ডাকেন বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য। সভায় বেশকিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামাল বলেন, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য আমাদের হলের প্রাধ্যক্ষরা রাতভর হলে অবস্থান করবেন। মিটিংয়ে আমাদের আরো কিছু বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেগুলো সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হবে। সভায় উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক সীতেশ চন্দ্র বাছার, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

গত রোববার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফর শেষে সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে না। চাকরি পাবে যত সব রাজাকারের বাচ্চা, নাতি-পুতিরা?’ বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের হেয় করেছেন বলে দাবি তাদের। এই বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবিতে গতকাল বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। সমাবেশে অবস্থান নিয়ে আন্দোলনকারীরা- ‘কে রাজাকার, কে রাজাকার? তুই রাজাকার, তুই রাজাকার’, ‘লাখো শহীদের রক্তে কেনা, দেশটা কারও বাপের না’, ‘তুমি নও, আমি নই, রাজাকার, রাজাকার’, ‘আমি কে? রাজাকার?’, ‘জবাব চাই, দিতে হবে,’ ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, প্রত্যাহার করতে হবে’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।

কোটা পদ্ধতি সংস্কারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা। কর্মসূচিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর মধ্যরাতে ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) ক্যাম্পাসের কাঁঠালতলায় মিছিল করে জবি শিক্ষার্থীরা।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক আলোকিত বাংলাদেশকে বলেছেন, রাজাকার শব্দটি এদেশের মানুষের ওপর অত্যাচার, নির্যাচন, হত্যাকারী ও ধর্ষণকারী হিসেবে চিহ্নিত। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা নিজেদের ‘রাজাকার রাজাকার’ পরিচয় দিয়ে স্লোগান দিচ্ছে। রাজাকার শব্দটি তারা গর্বের সঙ্গে উচ্চারণ করছে। এখন কোটা পদ্ধতি সংস্কারের আগে তাদের চিহ্নিত করা দরকার। এদের পেছনের ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজে বের করতে হবে। কোটা পদ্ধতি সংস্কারের বিষয়ে তিনি আরেফিন সিদ্দিক বলেন, কোটা রাখার যৌক্তিকতা একটা সময় পর্যন্ত ছিল। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। কেউ কোটার সুবিধা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলো, তারপর তার পরিবার বা গোষ্ঠী থেকে কাউকে আবারো কোটা সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি অমূলক। কোটা সংস্কারের দরকার আছে, তবে এর আগে রাজাকার রাজাকার স্লোগানকারীদের শাস্তি দিতে হবে। এরা স্বাধীনতার সম্মান নষ্ট করেছে। এরা রাষ্ট্রদ্রোহীতার মতো জঘন্য কাজ করেছে। ২০১৮ সালে কোটা বাতিলের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলেন। তারা সেই আন্দোলন যৌক্তিক ছিল বলে অভিমত জানিয়েছিলেন। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বক্তব্য দেওয়ার সময় কোটা পদ্ধতি বাতিলের ঘোষণা দেন। পরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে তা স্পষ্ট করে। দীর্ঘদিন পর উচ্চ আদালত সরকারের সেই প্রজ্ঞাপন অবৈধ ঘোষণা করে কোটা বহালের নির্দেশনা দিয়েছে। বিষয়টি এখনো বিচারাধীন। এর মধ্যেই আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষার্থীরা।