ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

থমকে আছে শিক্ষাব্যবস্থা

* কবে খুলবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান- নেই সুনির্দিষ্ট কোনো বার্তা * সেশনজটের শঙ্কায় শিক্ষার্থীরা
থমকে আছে শিক্ষাব্যবস্থা

করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবারো বড় ধরনের ক্ষতির মুখে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গত ১৬ জুলাই এই বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়। এখনো পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবে খুলবে এর সুনির্দিষ্ট কোনো বার্তা নেই। তীব্র শৈত্যপ্রবাহ, দাবদাহ ও বন্যার পর এবার আন্দোলনের কারণে দেশের পুরো শিক্ষাব্যবস্থা আবারো থমকে গেছে। প্রাথমিক স্কুলগুলো বন্ধ। মাধ্যমিক পর্যায়ে ষাণ¥াসিক পরীক্ষা স্থগিত। ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি কার্যক্রমও স্থগিত। ফলে নতুন সেশনে ক্লাস শুরুতে বিলম্ব হচ্ছে। এছাড়া চলমান এইচএসসি ও সমমানের সব পরীক্ষা আগামী ১ আগস্ট পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের কর্মবিরতিতে সব ধরনের ক্লাস-পরীক্ষাও বন্ধ অনির্দিষ্টকালের জন্য। আন্দোলনের ধাক্কা লেগেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও। সেখানেও বন্ধ ক্লাস-পরীক্ষা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষাও স্থগিত। বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের ভর্তি কার্যক্রমও আটকে আছে। সব মিলে শিক্ষা খাতে এক ধরনের স্থবিরতা চলছে। ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী। সেশনজটে পড়ার শঙ্কায় রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েক লাখ শিক্ষার্থী। সব মিলিয়ে বিপন্নপ্রায় শিক্ষাব্যবস্থা। এতে বড় ধরনের ক্ষতির শঙ্কা মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

চলমান পরিস্থিতি শেষে প্রতিষ্ঠানগুলো আবার কবে খুলবে তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। শিক্ষাবিদরা বলছেন, এই ক্ষতি অপূরণীয়, নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবি তাদের। যদিও শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে না।

সূত্রমতে, বছরের শুরু থেকেই নানা কারণে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া শুরু হয়। জানুয়ারি মাসেই জাতীয় নির্বাচন এবং শীতের ছুটিতেই কেটে যায় পুরো মাস। শৈত্যপ্রবাহের কারণে বন্ধ থাকে দেশের বিভিন্ন জেলার স্কুল-কলেজ। ফেব্রুয়ারি মাসটা ঠিকভাবে চললেও মার্চ মাস থেকে ফের পবিত্র রমজান, ঈদুল ফিতর ও পহেলা বৈশাখের দীর্ঘ ছুটিতে যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। এসব ছুটি শেষে গত ২১ এপ্রিল স্কুল-কলেজ খোলার কথা থাকলেও দেশজুড়ে তাপপ্রবাহের কারণে তা পিছিয়ে যায়। পরে ২৮ এপ্রিল খুললেও প্রচণ্ড গরমে বিভিন্ন স্থানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর পাওয়া যায়। গরমে অসুস্থ হয়ে শিক্ষকসহ কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনায় আবারো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ কিংবা অনলাইন ক্লাসে চলে যায়। পরে ৪ মে থেকে সীমিত পরিসরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হয়। এরপর মে মাস পর্যন্ত শনিবারসহ খোলা রেখে ক্ষতি কিছুটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু মে মাস না যেতেই আবারো শুরু হয়ে যায় ছুটি। পবিত্র ঈদুল আজহা ও গ্রীষ্মকালীন ছুটি শেষে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুললেও শিক্ষকদের পেনশন আন্দোলনে অচলাবস্থা নেমে আসে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। পরে জুলাইয়ের শুরুতেই পেনশন এবং কোটা আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ পেলে পুরোপুরি স্থবিরতা নেমে আসে শিক্ষাব্যবস্থায়। এর মধ্যে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে আসে বন্যা। এ সময় বন্ধ থাকে বিভিন্ন জেলার হাজারো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্থগিত হয়ে যায় এইচএসসি পরীক্ষা। তবে সবকিছু ছাপিয়ে যায় কোটা আন্দোলন। ১ জুলাই থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শুর হওয়া এই আন্দোলন ছড়িয়ে যায় সারা দেশে। একপর্যায়ে ব্যাপক সংঘাতে শিক্ষার্থীসহ ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে, আহত হয় কয়েক হাজার মানুষ। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৬ জুলাই থেকে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার।

সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিখনকালীন মূল্যায়নকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকলে এর ক্ষতি সহজে পূরণ করা সম্ভব নয়। এছাড়া বারবার এইচএসসি পরীক্ষা পেছানোর কারণে উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম, সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ। এই বন্ধের মেয়াদ বাড়লে শিক্ষার্থীদের সেশনজটের পাশাপাশি লেখাপড়ায় দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয়ে যাবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ৩ কোটি ৭০ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। এর বাইরে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে আরো প্রায় ৩০ লাখ শিক্ষার্থী। এভাবে টানা বন্ধের কারণে ক্লাস-পরীক্ষা না হওয়ায় প্রায় সব পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা পড়েছে বিপাকে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনিতেই সেশনজট রয়েছে। এর মধ্যে বারবার পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ায় প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন আরো ক্ষতিগ্রস্ত হলো। এদিকে বন্যা এবং আন্দোলনের কারণে বারবার এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত হওয়ার ফলে দেশের শিক্ষা খাতে শিডিউল বিপর্যয়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাগুলো যথাসময়ে হবে না কিংবা শিক্ষার্থীরা প্রস্তুতির সময় পাবেন না। এছাড়া এইচএসসি শেষে যারা দেশের বাইরে পড়তে যেতে ইচ্ছুক তারাও চলমান সেশন ধরতে পারবেন না। এছাড়া পেনশন আন্দোলনের কারণে জুলাই থেকেই তালা ঝুলছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শ্রেণিকক্ষ ও অফিসে। প্রশাসনিক ভবনেও কোনো কাজ হচ্ছে না।

এছাড়া দেশের ২৪টি (গুচ্ছভুক্ত) সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। দ্বিতীয় ধাপে ভর্তি প্রক্রিয়া চলাকালে শিক্ষকদের আন্দোলনে স্থগিত হয়ে যায় এ সংক্রান্ত কার্যক্রম। প্রকৌশল গুচ্ছভুক্ত (চুয়েট, কুয়েট ও রুয়েটে) তিনটি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও চতুর্থ ধাপের ভর্তির কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। এর আগে চতুর্থ ধাপে ভর্তির তারিখ নির্ধারণ করা হয় ১৪ ও ১৫ জুলাই। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছুরা অনিশ্চয়তায় দিন পার করছেন।

এদিকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে এখনই কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আন্দোলন এখনো পুরোপুরি শেষ না হওয়ায় পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে তারা। আন্দোলন শেষ হলেও শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফেরাতে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়টিতেও গুরুত্ব দিতে হবে। অন্যথায় শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ফেরার পরও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ফের এ নিয়ে আন্দোলন হতে পারে। তা ছাড়া শিক্ষকদের পেনশন আন্দোলনেরও কোনো সুরাহা হয়নি। আন্দোলনের শেষ ঘোষণা করেনি তারাও। ধারণা করা হচ্ছে, সবকিছু মিলে শিক্ষাব্যবস্থায় স্বস্তি মিলতে অন্তত আরো এক মাস সময় লাগতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পরও নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হবে। দুই মাসের বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকা ক্লাস, পরীক্ষাগুলোর ক্ষতি পোষাতে নিতে হবে বিশেষ পরিকল্পনা। নতুন করে পরীক্ষার নতুন সময়সূচি ঘোষণা করতে হবে। এছাড়া ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা কখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরবেন, তারা কখন পরীক্ষা দেয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হবেন এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সময়সূচি নির্ধারণ করতে হবে। বিশেষ করে কোটা আন্দোলনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর যে প্রভাব পড়েছে, তা কাটিতে উঠতে সময় লাগবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া সঠিক সময়ে শিক্ষাবর্ষ শেষ করতে না পারার কারণে বেকারত্বও বাড়তে পারে বলে মনে করেন অনেকেই।

শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পরিবেশ তৈরি হয়নি। এই মুহূর্তে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাই আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে পারছি না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলতে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ নয়, আমাদের তো বিদ্যালয়গুলো নিয়েও কাজ করতে হয়। আমরা পরিস্থিতি এখনো পর্যবেক্ষণ করছি।’

শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এক ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে বাধ্য হয়। তবে এ পরিস্থিতি আশা করা যায় বেশিদিন থাকবে না। পরিস্থিতি সামাল দিয়ে খুব দ্রুতই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার চেষ্টা চলছে। শিক্ষার্থীরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। তারা যেনো ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এজন্য আমাদের সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। ছোট ছোট সমস্যাগুলো আলোচনা করে সমাধান করা উচিত।

শিক্ষার্থীরা সেশনজটে পড়তে পারে কি না জানতে চাইতে সাবেক এই উপাচার্য বলেন, চলমান সমস্যা দীর্ঘায়িত হলে সেশনজটের সম্ভাবনা রয়েছে। একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ বছরের কোর্স সম্পন্ন করতে ৭ বছরও লেগেছে। যা এখন প্রায় নির্দিষ্ট সময়েই হয়। আবার যদি শিক্ষাপতিষ্ঠানের সমস্যাগুলো দীর্ঘায়িত হয় তাহলে সেশনজটের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল হক দুলু জানিয়েছেন, করোনা মহামারির মতো আরেকটা ধাক্কা খেতে যাচ্ছে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা অনিশ্চিত। আমরা চাই দ্রুত শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আসুক। অন্যথায় শিক্ষার্থীদের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত