আজ নিষিদ্ধ হচ্ছে জামায়াত-শিবির

প্রকাশ : ৩১ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আরিফুল ইসলাম

রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারানোর পর এবার বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে। আজ বুধবার জামায়াত-শিবির দুটি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হতে পারে। ফলে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার একটি বড় সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, নির্বাহী আদেশে বুধবারের মধ্যেই জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ হচ্ছে। দুটি সংগঠন নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হচ্ছে।

আনিসুল হক বলেন, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের ব্যাপারে সরকারের বক্তব্য শুনেছি। প্রধানমন্ত্রী আমাকে নির্দেশনা দিয়েছেন বুধবারের মধ্যে একটা ব্যবস্থা নেওয়ার। কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে- সেটা যখন আমরা সিদ্ধান্ত নেব, তখন হবে।

এই মুহূর্তে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হলে সরকার পরবর্তীতে কোনো ঝামেলায় পড়বে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, গত ১৬ জুলাই থেকে দেশে যে নৃশংসতা চালানো হয়েছে, কোটাবিরোধী আন্দোলনের নামে যে সহিংসতা চালানো হয়েছে; যারা কোটা আন্দোলন করেছে, তারা কিন্তু বলেছে এই সহিংসতার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। সেই ক্ষেত্রে আমাদের কাছে তথ্য-উপাত্ত আছে। জামায়াত-শিবির-বিএনপি-ছাত্রদল যারা জঙ্গি, তারাই এটা করেছে। এই দলটাকে যদি নিষিদ্ধ করা হয় তাহলে দেশের আইনশৃঙ্খলা এবং রাজনীতিরও অনেক উন্নতি হবে।

কি পদ্ধতিতে বাতিল করা হবে এমন প্রশ্নে আনিসুল হক বলেন, কোনো দলকে যখন নিষিদ্ধ করা হয়, তখন সেটা নির্বাহী আদেশেই হয়। সেটা কোনো বিচার বিভাগীয় আদেশে হয় না। যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচার করা এক কথা এবং জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা আরেক কথা।

এর আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি-জামায়াত নৈরাজ্যের মাধ্যমে দেশকে অকার্যকর করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। জাতীয় স্বার্থে দেশবিরোধী অপশক্তি নির্মূল করার জন্য ১৪ দলের বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ওবায়দুল কাদের আরো বলেন, জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, পরবর্তীতে গণজাগরণ মঞ্চ থেকেও জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানানো হয়েছিল। এছাড়া ১৪ দলের সভায় জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছে, যা আমরা আগেও গণমাধ্যমকে অবহিত করেছি। এখন এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে সরকার। সেটার প্রক্রিয়া কী হবে, সেটার আইনগত দিক দেখেশুনে সরকার শিগগরিই পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে। কারণ আমরা আইনগত দিকটি ভালোভাবে দেখে নিতে চাই; যাতে কোনো ফাঁকফোকর দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে এ অপশক্তি আর কোনো সুযোগ না পায়।

হাইকোর্টের রায় নিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে হাইকোর্টের রায় দেশের সর্বোচ্চ আদালত বহাল রেখেছে। দেশের গণপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন না থাকলে কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমন নজির আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জার্মানিতে হিটলারের নাৎসি বাহিনী রাজনীতি করতে পারে না।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আদালতে জামায়াতকে দল হিসেবে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে- উল্লেখ আছে। মূলত দলটি ধর্মের মুখোশ পড়া সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। নানান সময়ে তাদের দ্বারা প্রকাশ্য ও গোপনে নানা অপতৎপরতা ও নাশকতা, ষড়যন্ত্র, রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে; দেশের জনগণও সেটা অবহিত।

জানা যায়, ধর্মভিত্তিক দল জামায়াতের রাজনীতি বাংলাদেশে নিষিদ্ধের দাবি দীর্ঘদিনের। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেওয়ার পর এই দাবি আরো জোরালো হয়। তবে গত ১৫ বছরে কার্যকর কোনো উদ্যোগ সরকারের তরফে নেওয়া হয়নি। এবার কোটাবিরোধী আন্দোলনকে সহিংস রূপ দেওয়ার পেছনে বিএনপি ও জামায়াতকে দায়ী করে আসছেন ক্ষমতাসীনরা। তার মধ্যেই গত সোমবার সন্ধ্যায় ১৪ দলের বৈঠকে জামায়াত ও শিবিরকে নিষিদ্ধের সিন্ধান্ত নেওয়া হয়।

সূত্র জানায়, আদালতের রায়ে ২০১৩ সালে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে ইসি। পরে জামায়াতের পক্ষ থেকে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছিল। তবে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর জামায়াতের পক্ষের আপিল খারিজ করে দিয়েছেন। ফলে দলটির নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত বহাল রয়েছে।

এদিকে গতকাল মঙ্গলবার সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সভাপতি ড. সৈয়দ আন্দোয়ার হোসেন, নির্বাহী সভাপতি অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস ও সাধারণ সম্পাদক সালেহ আহমেদ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী সরকার জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে জেনে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি।

গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে আরো বলা হয়, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি আরো আগেই নিষিদ্ধ করার বিষয়ে কথা ওঠে, বিলম্বিত হলেও উদ্যোগটি নেয়া হয়েছে। আমরা মনে করি, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে এই অপশক্তি ছড়িয়ে রয়েছে। আমরা দেশের সবস্তরের মানুষের কাছে আহ্বান রাখব, কোনো অবস্থাই কেউ যেন, এই অপশক্তির সঙ্গে আঁতাতে লিপ্ত না হয়। সেই বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকার আহ্বান জানাই। আমরা আশা করি, মহান মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত স্থিতিশীল বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার কাজে সংশ্লিষ্ট মহল সচেষ্ট হবেন’, বলেন সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের নেতারা।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদ সদস্য আব্দুল মোতালেব বলেন, দেশব্যাপী কোটা সংস্কার আন্দোলনকে পুঁজি করে একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও তাদের দোসররা যে হামলা চালিয়েছে তা নজিরবিহীন। যারা সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করে উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত করেছে তাদের যথাযথ শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা হবে। মাত্র কিছুদিন আগে জাতীয় বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে, যা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সুস্পষ্ট রূপরেখা সম্বলিত। কিন্তু নাশকতাকারীরা এই দেশের অর্থনীতির ৮০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি করেছে। তারা অগ্নিসংযোগ করেছে মেট্রোরেলে ও রাষ্ট্রীয় সম্পদে। এখন সময় এসেছে যারা অগ্নিসংযোগকারী, দেশের শত্রু তাদের চিহ্নিত করে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে হবে।