বাংলাদেশে দ্বিতীয়বার নিষিদ্ধ হচ্ছে জামায়াত

প্রকাশ : ০১ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

জামায়াতে ইসলামী অর্ধশতক পর আবারো নিষিদ্ধ হচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করা এ দলকে ১৯৭২ সালে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহারের’ কারণে। আর এবার দলটিকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে জননিরাপত্তার জন্য হুমকি বিবেচনা করে।

জিয়াউর রহমানের আমলে রাজনীতি করার অধিকার ফিরে পাওয়া জামায়াতকে নিষিদ্ধের দাবি সেই নব্বইয়ের দশকেই সামনে এসেছিল শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলন থেকে। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময় তা আরো জোরালো হয়। গত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন সময়ে একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াত নিষিদ্ধের পক্ষে মত দিয়েছেন। কিন্তু দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি অপূর্ণই থেকে গেছে এতদিন। আদালতের রায়ে নিবন্ধন খুইয়ে নির্বাচন করার পথ বন্ধ হলেও দল হিসেবে জামায়াত ছিল সক্রিয়, গত নির্বাচনের আগেও দলীয়ভাবে তাদের মিছিল সমাবেশ করতে দেখা গেছে। শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ব্যবহার করে ব্যাপক সহিংসতা সৃষ্টির অভিযোগে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে সরকার। গত সোমবার রাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় দলের বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ঐক্যমত হয়। এরপর মঙ্গলবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, জামায়াতকে কীভাবে নিষিদ্ধ করা হবে, সে সিদ্ধান্ত বুধবারের মধ্যেই চূড়ান্ত হবে। তবে তিনি এটা স্পষ্ট করেছেন, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হবে সাম্প্রতিক কোটা আন্দোলনের মধ্যে ‘সহিংসতার জন্য’। আর সেটা করা হবে সরকারের নির্বাহী আদেশে।

যেভাবে নিষিদ্ধ করা যায় : জামায়াতকে কীভাবে নিষিদ্ধ করা যায়, তা নিয়ে সরকারের মন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কথা বলেছেন। তাদের সামনে উপায় ছিল দুটো। এক. আদালতে আবেদন করার মাধ্যমে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা, দুই. সরকারের নির্বাহী আদেশ প্রয়োগ করা। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর তখনকার আমির গোলাম আযমকে ২০১৩ সালে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে জামায়াতে ইসলামীকে ‘ক্রিমিনাল দল’ আখ্যায়িত করেছিল আদালত। ওই বছরই আগস্টে গোলাম আযমের সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। সেখানে একাত্তরের ভূমিকার জন্য দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণারও আবেদন করা হয়। কিন্তু ওই বছর অক্টোবরে বিচারাধীন অবস্থায় কারাগারে মারা যান জামায়াতগুরু গোলাম আযম। ফলে সুপ্রিমকোর্টে ওই আপিল কার্যকারিতা হারায়, জামায়াত নিষিদ্ধের আবেদনটিও আর এগোয়নি। ২০১৬ সালে তখনকার খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছিলেন, আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ‘এ বছরের মধ্যেই’ বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হবে। ওই বছরই বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, জামায়াত নিষিদ্ধ করা এখন ‘সময়ের ব্যাপার’। কিন্তু ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেন, আদালতে মামলা থাকার কারণে জামায়াতে ইসলামীকে সরকার নিষিদ্ধ করতে পারছে না। তরীকত ফেডারেশনের নেতা রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ কয়েকজনের রিট আবেদনে হাইকোর্ট ২০১৩ সালে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ঘোষণা করে। সংবিধানের সঙ্গে জামায়াতের গঠনতন্ত্র ‘সাংঘর্ষিক’ হওয়ায় হাইকোর্ট ওই রায় দেন। তাতে দলীয়ভাবে জামায়াতের নির্বাচনে অংশ নেয়ার পথ বন্ধ হয়। গতবছর সর্বোচ্চ আদালতেও হাইকোর্টের ওই রায় বহাল থাকে। রেজাউল হক চাঁদপুরী জামায়াতে ইসলামীর মিছিল-সমাবেশসহ সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়েও গত বছর আপিল বিভাগে একটি আবেদন করেছিলেন। এর মধ্যে গত নভেম্বরে আপিল বিভাগ জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে চূড়ান্ত রায় দিয়ে দিলে ওই রিট মামলা আর এগোয়নি। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের জন্য দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচারেরও উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। কিন্তু সেজন্য আইন সংশোধনের প্রয়োজন হওয়ায় বিষয়টি আটকে থাকে। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টিও ঝুলে থাকে। গত সোমবার রাতে ১৪ দলের বৈঠকের পর জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি হঠাৎ করেই গতি পায়। ওই বৈঠকের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানান, তারা জোটগতভাবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। কাদের বলেন, ‘১৪ দলের এ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছে জামায়াত-শিবির গোষ্ঠীর অপশক্তির রাজনীতি নিষিদ্ধ করার জন্য। ১৪ দলীয় জোটের নেতৃবৃন্দ মনে করেন, বিএনপি, জামায়াত, ছাত্রদল, শিবির তাদের দোসর উগ্রবাদী জঙ্গি গোষ্ঠী বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তারা সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে দেশকে অকার্যকর করার ষড়যন্ত্র করছে। তিনি আরো বলেন, অতিসম্প্রতি চোরাগোপ্তা হামলা করে এবং গুলি বর্ষণ করে সরকারের ওপর দায় চাপাতে তারা দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। পুলিশ বাহিনীর সদস্যসহ মানুষ হত্যা করে লাশ পর্যন্ত ঝুলিয়ে রেখেছে। এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যে প্রক্রিয়ায় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তা ইতিহাসে নজিরবিহীন। জাতীয় স্বার্থে দেশবিরোধী এ অপশক্তিকে নির্মূল করা প্রয়োজন।’

সেটা কীভাবে হবে সে বিষয়ে গত মঙ্গলবার দুপুরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাকে এ বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন। আগামীকালের মধ্যে একটা ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমি কিছুক্ষণ পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বসব। কোন আইনি প্রক্রিয়ায় হবে, সেটা যখন সিদ্ধান্ত নেব তখন জানাব। কালকের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত হবে ইনশাআল্লাহ।’ এখন কোন প্রক্রিয়ায় কোন কারণে দলটিকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে তা আইনমন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন সাংবাদিকরা। উত্তরে তিনি বলেন, ‘গত ১৬ থেকে ২০ জুলাই কোটাবিরোধী আন্দোলনের নামে যে নৃশংসতা চালানো হয়েছে, সেখানে আন্দোলনকারীরা বলেছেন যে, তারা সহিংসতার মধ্যে নেই। আমাদের কাছে তথ্যউপাত্ত আছে যে, এই জামায়াত, শিবির, বিএনপি, ছাত্রদলের যারা জঙ্গি, তারাই এটা করেছে। এই দলটাকে যদি নিষিদ্ধ করা হয় তাহলে আইনশঙ্খলা ও দেশের পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

আরেক প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেন, কোনো দলকে যখন নিষিদ্ধ করা হয়, সেটা নির্বাহী আদেশেই হয়। যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচার করা এক কথা, আর দল নিষিদ্ধ করা আরেক কথা। বিকালে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সাতজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর উপস্থিতিতে তিন ঘণ্টার ম্যারাথন বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, জামায়াত নিষিদ্ধের বিষয়টি প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এটার বিষয়ে আর কিছু বলার নেই। জামায়াত সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ও জঙ্গি উত্থান চালিয়ে যাচ্ছে। ১৪ দলসহ সবাই রাজনৈতিক একটা সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেই সিদ্ধান্তটা বাস্তবায়নের জন্য যেসব প্রক্রিয়া দরকার সেগুলো চলছে। মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র ধরার দায়ে নিষিদ্ধ জামায়াত রাজনীতিতে ফিরে জিয়াউর রহমানের আমলে। এরপর ২০১৩ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায় আসতে থাকলে তারা বিপাকে পড়তে শুরু করে।

সংবিধানের ৩৮ ধারা : স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। তাতে জামায়াতে ইসলামীর কর্মকাণ্ডও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। সে সময় জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছিল সংবিধানের ৩৮ ধারার ক্ষমতাবলে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সময় ১৯৭৬ সালে সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদ বাতিল করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। তাতে ফের বৈধভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পায় জামায়াতে ইসলামী।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনের মাধ্যমে ৩৮ অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে আনা হয়।

সেখানে বলা হয়েছে: জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে। তবে শর্ত থাকে যে, কোনো ব্যক্তির উক্তরূপ সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার কিংবা উহার সদস্য হইবার অধিকার থাকিবে না, যদি- (ক) উহা নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়; (খ) উহা ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ, জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়; (গ) উহা রাষ্ট্র বা নাগরিকদের বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি কার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়; বা (ঘ) উহার গঠন ও উদ্দেশ্য এই সংবিধানের পরিপন্থি হয়। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল ইনু বলেন, বাহাত্তরের সংবিধান অনুযায়ী জামায়াত নিষিদ্ধই ছিল। জিয়াউর রহমানের আমলে জাসদ ও সিপিবির রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এর বাইরে চরমপন্থি কিছু দলকে সরকারের নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল বিভিন্ন সময়ে। আর আওয়ামী লীগের আমলে এ পর্যন্ত দশটি উগ্রবাদী ও জঙ্গি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সংগঠনগুলো হলো- হিযবুত তাহরীর, জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি), জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি), শাহাদাৎ-ই আল-হিকমা, হিযবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আনসার আল ইসলাম, আল্লাহর দল এবং জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া। গতবছর ২৮ অক্টোবর ঢাকার আরামবাগ এলাকায় সবশেষ সমাবেশ হয় জামায়াতে ইসলামীর। গত ১০ বছরের মধ্যে এটি রাজধানীতে দলের দ্বিতীয় জমায়েত।

গতবছর ২৮ অক্টোবর ঢাকার আরামবাগ এলাকায় সবশেষ সমাবেশ হয় জামায়াতে ইসলামীর। গত ১০ বছরের মধ্যে এটি রাজধানীতে দলের দ্বিতীয় জমায়েত।

যা বলছে জামায়াত : ১৪ দলের বৈঠকে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে সংবাদমাধ্যমে একটি বিবৃতি পাঠিয়েছে দলটি। জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান সেখানে দাবি করেছেন, একটি রাজনৈতিক দল বা জোট অন্য একটি রাজনৈতিক দলের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। বাংলাদেশের আইন ও সংবিধান কাউকে এ এখতিয়ার দেয়নি। কোনো দল বা জোট অন্য কোনো দলকে নিষিদ্ধ করার ধারা চালু হলে এক দল অন্য দলকে নিষিদ্ধ করতে থাকবে। তখন রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা বলে কিছু থাকবে না।

শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে দমনের জন্য ‘নির্বিচারে গণহত্যা চালানো’র অভিযোগ তুলে বিবৃতিতে বলা হয়, এহেন অরাজক পরিস্থিতিতে সরকার দেশ ও বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করার জন্য এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে ১৪ দলের বৈঠকে জামায়াত নিষিদ্ধের এ হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের এ সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক, বেআইনি এবং সংবিধানবিরোধী।

যুদ্ধাপরাধের বিচারে জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতারা ফাঁসিতে ঝুলেছেন, অনেকে আছেন কারাগারে বা আত্মগোপনে। তাতে দলের তৎপরতা গত এক দশক ধরে অনেকটাই সীমিত হয়ে এসেছে। ঢাকার মগবাজারে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয় বহু বছর ধরে তালাবন্ধ। এর মধ্যে দলেও ভাঙন ধরেছে। বহু বছরের বিতর্কের পর বিএনপির জোটেও আর জামায়াত নেই। সবশেষ গত বছর আপিল বিভাগে নিবন্ধন বাতিলের রায় বহাল থাকায় ভোটের রাজনীতিতেও প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে জামায়াত। এ অবস্থায় দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে কী ফল হবে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিবন্ধন বাতিল হওয়ার পরও ঝটিকা মিছিল, বা জমায়েত হয়ে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় থাকার সুযোগ পাচ্ছিল জামায়াত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তাদের প্রচার চালানোর সুযোগ ছিল। নিষিদ্ধ ঘোষণা হলে সেসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেয়া যাবে। এমনকি জামায়াতকে কোনোভাবে সহযোগিতা বা অর্থায়ন করার পথও আইনিভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। আর সেক্ষেত্রে জামায়াত কর্মীরা জঙ্গি দলের মতো গোপন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করতে পারে বলে মনে করেন কেউ কেউ। সে কারণে এত বছর পর জামায়াত-শিবিরকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করার ‘অভিঘাত’ সম্পর্কে সরকারকে ভাবার পরামর্শ দিয়েছেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির। তিনি বলেন, দেরি হওয়ার ফলে জামায়াতের শেকড় কিন্তু এখন অনেক দূর বিস্তৃত হয়েছে। জামায়াত মানে যে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি, ধ্বংসাত্মক রাজনীতি। সেটি এখন বিএনপিসহ অন্যান্য দলের মাঝে ছড়িয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের মাঝেও জামায়াতের অনুপ্রবেশ ঘটেছে, প্রশাসনের মাঝেও জামায়াতের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হলে আন্তর্জাতিক অভিঘাতের কথাও মাথায় রাখতে হবে।’ জামায়াত কেবল বাংলাদেশে নয়, ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী বলয়ের সঙ্গে যুক্ত’ মন্তব্য করে শাহরিয়ার কবির বলেন, জামায়াতের দর্শনে ভিন্নমতের কোনো জায়গা নেই। ভিন্নমত প্রকাশ করলে তাকে হত্যা করতে হবে, এটি তাদের দর্শন। এই দর্শন নিয়ে তো তাদের কোনো দেশেই রাজনীতি করার অধিকার থাকতে পারে না।’

বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, রাজনীতি উন্মুক্ত থাকলে জামায়াত প্রকাশ্যে কর্মকাণ্ড চালায়। নিষিদ্ধ হলে গোপনেও তা করতে পারে। গোপনে তারা যেন কাজগুলো করতে না পারে, সেজন্য এক ধরনের জাগরণ তৈরি করতে হবে। রাজনীতি নিষিদ্ধ করা মানে শুধুমাত্র অফিসিয়ালি নিষিদ্ধ নয়; রাজনীতির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রকৃত রাজনীতি সামনে আনা। কী কী অপকর্ম করেছে, ধর্মকে রাজনীতি অঙ্গনে আনল তা সামনে আনা। ...যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের রাজনীতির বিরুদ্ধে গণজাগরণ সৃষ্টি করা না যাচ্ছে, ততক্ষণ নিষিদ্ধ হলেও তারা নিষিদ্ধ ঘোষিতভাবে তাদের কর্মকাণ্ড চালাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, জামায়াত নিষিদ্ধের দাবিটি এতোদিন উঠেছিল সুশীল সমাজ থেকে। এখন সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু একটা বিষয় হচ্ছে ঘোষণা দেয়া আর আরেকটি হচ্ছে সেটা কার্যকর করা। কার্যকর করতে গেলে সমস্যা হবে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে এবং বহির্বিশ্বে। সেক্ষেত্রে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া হবে। সেটাকে প্রতিরোধ করতে চাইলে আওয়ামী লীগের উচিত হবে সুশীল সমাজ, তরুণ সমাজ, সমমনা দল এবং আওয়ামী লীগের তৃণমূলকে পুনর্গঠিত করা। একটা তো অভিঘাত হবেই। তারা এখনো গোপনেই আছে। তখন হয়তো তারা বিভিন্ন দিল মিশে যাবে। গত ২০ বছরে তারা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী হয়েছে। সরকার নির্বাহী আদেশে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার পর যে আইনি জটিলতা হতে পারে, সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে বলছেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী তাপস কান্তি বল।

তিনি বলেন, কেউ হাইকোর্টে রিট করতে পারে। জামায়াতের অনুসারীরা বিভিন্ন দলে অনুপ্রবেশ করতে পারে। নিষিদ্ধ করার পর তাদের চিন্তা-চেতনা তো বন্ধ হবে না।’

এক নজরে জামায়াত : জামায়াতে ইসলামীর সূচনা হয় উপমহাদেশের বিতর্কিত ধর্মীয় রাজনীতিক আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে ১৯৪১ সালের ২৬ অগাস্ট, তখন এর নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ। সেখানেও নিষিদ্ধ হয়েছিল এ দল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উসকানির অভিযোগে প্রথমবার পাকিস্তানে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয় ১৯৫৯ সালে। এরপর ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান প্রণীত মুসলিম পরিবার আইনের বিরোধিতার কারণে ১৯৬৪ সালের ৪ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর কর্মকাণ্ড আবারো নিষিদ্ধ হয়। তবে পরে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। পাকিস্তানের সামরিক আদালতের রায়ে মওদুদীর মৃত্যুদণ্ডও হয়েছিল। তবে তাকে শেষ পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলতে হয়নি। দণ্ড মওকুফ করে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন ১১ দফাসহ বিভিন্ন দাবির বিরোধিতা করে জামায়াত। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ নামে বিভিন্ন দল গঠন করে জামায়াত ও এর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ। সে সময় তারা সারা দেশে ব্যাপক হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটের মতো যুদ্ধাপরাধ ঘটায়। আদালতে ঘোষিত যুদ্ধাপরাধ মামলার বিভিন্ন রায়ে বিষয়গুলো উঠে আসে। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উসকানি, হত্যাকাণ্ডে সায় ও সহযোগিতার দায়ে জামায়াতে ইসলামীর তখনকার আমির গোলাম আযমকে টানা ৯০ বছর অথবা আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়। এছাড়া যুদ্ধাপরাধের দায়ে দলটির পাঁচ শীর্ষ নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াতে ইসলামীকে ‘ক্রিমিনাল দল’ আখ্যায়িত করে একটি রায়ে বলা হয়, দেশের কোনো সংস্থার শীর্ষ পদে স্বাধীনতাবিরোধীদের থাকা উচিত নয়।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও জিয়াউর রহমানের সরকার আবার জামায়াতকে রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ করে দেয়। সেই সুযোগে গোলাম আযম ১৯৭৮ সালে দেশে ফিরে দলের আমিরের দায়িত্ব নেন। সামরিক শাসক এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে জামায়াত ১৮টি আসন পায় এবং সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন দেয়। এরপর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আসন কমে তিনটি হলেও ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াত পায় ১৭ আসন। চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রিসভাতেও জায়গা পান জামায়াতের শীর্ষ দুই নেতা। একাত্তরে ন্যক্কারজনক ভূমিকার পরও খালেদা জিয়ার চার দলীয় জোট সরকারের সময়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দেয়াকে লাখো শহীদের প্রতি ‘চপেটাঘাত’ হিসেবে বর্ণনা করা হয় যুদ্ধাপরাধের এক মামলার রায়ে। সর্বশেষ ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দুটি আসন পায় জামায়াতে ইসলামী। এরপর তারা আর দলীয়ভাবে ভোট করতে পারেনি। সংবিধানের সঙ্গে গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক হওয়ায় ২০১৩ সালের ১ আগস্ট হাইকোর্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ‘অবৈধ ও বাতিল’ ঘোষণা করে রায় দেন। গতবছর সর্বোচ্চ আদালতেও হাইকোর্টের ওই রায় বহাল থাকে। ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় জোটবদ্ধ হয় বিএনপি ও জামায়াত। এর ১৪ বছর পর ২০১৩ সালে একটি ইফতার পার্টিতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম।

১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় জোটবদ্ধ হয় বিএনপি ও জামায়াত। এর ১৪ বছর পর ২০১৩ সালে একটি ইফতার পার্টিতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম। নিবন্ধন বাতিলের পর জামায়াত দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার যোগ্য বিবেচিত হয়নি। তবে ২০১৯ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে জোটসঙ্গী বিএনপির নির্বাচনি প্রতীক নিয়ে ভোটে অংশ নিয়েছিলেন জামায়াতের কয়েকজন। পাশাপাশি স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচনে দলীয়ভাবে অংশ নিতে না পারলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জামায়াত নেতারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। ব্যক্তির অপরাধের বিচার হলেও দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের দাবি ২০১৩ সালেই গণজাগরণ মঞ্চ থেকে তোলা হয়েছিল। গোলাম আযমের মামলার রায়ে আদালত জামায়াতকে ‘ক্রিমিনাল দল’ আখ্যায়িত করার পর দাবিটি আরো জোরালো হয়ে ওঠে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ২০২২ সালের আগস্টে বলেছিলেন, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের জন্য দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচারে আইন সংশোধনের প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু পরে সে বিষয়টি আর সংসদ পর্যন্ত যায়নি। গত মঙ্গলবার আবারো এ বিষয়ে কথা বলেন আইনমন্ত্রী। তিনি বলেন, আইনে যে পরিবর্তনের কথা বা সংশোধনের কথা আমি লিখেছি, সেই সংশোধন যদি হতো, এবং সেটা হলেও, আর সেটা হবে। এবং সেটা হলে জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করা হবে।