এবার ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ পালন করছে শিক্ষার্থীরা

* দেশব্যাপী হামলা-সংঘর্ষ : আহত অনেকে * ব্যারিকেড ভেঙে সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে শিক্ষার্থীদের অবস্থান

প্রকাশ : ০১ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

এবার দেশের সব আদালত, ক্যাম্পাস ও রাজপথে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। গত মঙ্গলবার সংগঠনটির অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল কাদেরের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা, মামলা, গুম ও খুনের প্রতিবাদে এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে তদন্ত করে বিচারের দাবিতে এ কর্মসূচি পালনের কথা উল্লেখ করা হয়। এছাড়া ছাত্রসমাজের ৯ দফা দাবি আদায়ে নতুন কর্মসূচিতে একাত্মতা ঘোষণা করতে শিক্ষক, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী, পেশাজীবী, শ্রমজীবী ও সব নাগরিকের প্রতি অনুরোধ জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল বুধবার রাজধানী ঢাকাসহ দেশব্যাপী ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করেছে শিক্ষার্থীরা। কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে অনেকে আহত হয়েছেন।

ব্যারিকেড ভেঙে সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে শিক্ষার্থীদের অবস্থান : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে মিছিল করেছেন শিক্ষার্থীরা। সেখানে অবস্থান নিয়ে ছাত্রহত্যার বিচার এবং ৬ সমন্বয়কারী ও আটক অন্য শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবিতে নানা স্লোগান দেন তারা। গতকাল বুধবার দুপুর পৌনে ২টার দিকে মাজার গেটে পুলিশের ব্যারিকেড পেরিয়ে আন্দোলনকারীরা সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে প্রবেশ করেন। এ সময় তারা সমবেত কণ্ঠে গান পরিবেশন করেন। প্রায় আধা ঘণ্টার মতো সুপ্রিমকোর্ট চত্বরের সামনে অবস্থান করেন শিক্ষার্থীরা। এরপর তারা সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণ ত্যাগ করেন।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, বিপুল সংখ্যক পুলিশের উপস্থিতিতে দুপুরে শতাধিক শিক্ষার্থী মাজার গেটের সামনে অবস্থান নেন। এর মধ্যে, ঢাবি, বুয়েট, নর্থ সাউথ, ব্র্যাক, গ্রিন ইউনিভার্সিটি ও ঢাকা কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ছিলেন।

এ সময় সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা মিছিল নিয়ে মাজার গেটের সামনে যান। এর আগেই মাজার গেট বন্ধ করে দেয়া হয়। তখন গেটের বাইরে শিক্ষার্থীরা এবং গেটের ভেতরে আইনজীবীরা স্লোগান দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আটকের খবর শুনে কিছু আইনজীবী গেটের পাশের ব্যারিকেড টপকে শিক্ষার্থীদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। পরে কিছু শিক্ষার্থীকে ভেতরে নিয়ে আসেন তারা। এ সময় আইনজীবী ও শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্লোগান দেন। ‘তোর কোটা তুই নে, আমার ভাইকে ফেরত দে’, ‘ছাত্রদের ওপর গুলি কেন, প্রশাসন জবাব দে’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন তারা।

কিছুক্ষণ পর আইনজীবীদের সঙ্গে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনের সামনে চলে আসেন শিক্ষার্থীরা। সেখানে গিয়ে একটানা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস, উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগান দিতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। প্রায় আধা ঘণ্টা পর তারা শিক্ষা ভবনের দিকে চলে যান।

শিক্ষার্থীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করা আইনজীবীদের মধ্যে ছিলেন ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, তৈমুর আলম খন্দকার, রুহুল কুদ্দুস কাজল, গাজী কামরুল ইসলাম সজল ও মোহাম্মদ আলী প্রমুখ। এদিকে, মাজার গেটের ভেতরে দৃক গ্যালারির প্রতিষ্ঠাতা শহিদুল আলম, শারমিন মুরশিদ, রেহেনুমা আহমেদ আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন।

চট্টগ্রামে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগানে উত্তাল আদালত চত্বর : কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সারা দেশে শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম আদালত এলাকায় বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থীরা। ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগানে উত্তাল আদালত সংলগ্ন পুরো এলাকা। গতকাল বুধবার বেলা ১১টায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের সামনে থেকে শুরু হয় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দেশব্যাপী ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।

সরেজমিন দেখা যায়, বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শিক্ষার্থী ও আইনজীবীদের মিছিলটি আদালতের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে মূল সড়কে আসলে পুলিশের বাধার মুখে পড়েন। এ সময় রাস্তা থেকে সরে গিয়ে বিক্ষোভকারীরা আদালতের আইনজীবী চত্বরে সমবেত হয়ে স্লোগান দিতে থাকে। পুলিশের একটি দল শিক্ষার্থীদের মিছিল লক্ষ্য করে এগোতে চাইলে আইনজীবীদের একটি দল পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে অবস্থান নেন। আইনজীবীরা এ সময় পুলিশকে আদালত এলাকা ছেড়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানান। পরে পুলিশ ও বিজিবির কয়েকটি দল আদালত ভবনের প্রবেশ গেটে অবস্থান নেন।

এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে?’, ‘আমার ভাই মরলো কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘রক্তের বন্যায়, ভেসে যাবে অন্যায়’ সহ নানা স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন। বিক্ষোভ চলাকালে দুপুর ১২টার দিকে তাদের সঙ্গে যোগ দেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি।

রাফি বলেন, খুব সাধারণ একটি দাবি আমরা জানিয়েছিলাম। সেজন্য আড়াই শতাধিক ছাত্র জনতার রক্ত নিয়েছে সরকার। আমরা সেই রক্তের সঙ্গে বেইমানি করতে পারব না। ৯ দফা দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।

চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী নাসরিন মুনতাহা বলেন, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে গুলি চালানো হচ্ছে। দিনে রাস্তা থেকে, রাতে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা এর বিচার চাইতে এসেছি।

দুপুর সোয়া ১২টার দিকে শুরু হয় বৃষ্টি। প্রায় আধা ঘণ্টার বৃষ্টিতেও শিক্ষার্থীরা স্থান না ছেড়ে আদালত চত্বরে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। দুপুর একটা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বেশ কয়েকটি মিছিল বিক্ষোভে যোগ দেয়। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম কলেজ, মহসিন কলেজ ও নগরের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্কুল কলেজের প্রায় ৩ হাজার শিক্ষার্থী বিক্ষোভে অংশ নেয়। সঙ্গে যোগ দেন উৎসুক জনতা ও আইনজীবীরা।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অংশ নেন অনেক অভিভাবক। তাদের একজন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা মুনমুন সরকার। তিনি বলেন, ?আমাদের বাচ্চাদের গুলি করে রাস্তায় মারা হচ্ছে। তাই আমরা তাদের পাশে দাঁড়াতে এসেছি। আর একটা ছাত্রের ওপরও যেন গুলি না হয়, সেটার নিশ্চয়তা চাইতে আমরা এসেছি।

এক চিকিৎসক বাবা আসেন বিক্ষোভে। তিনি বলেন, আমার বাচ্চা এখনো ছোট। সে যখন বড় হবে, তখন যেন তাকে গুলি খেয়ে মরতে না হয়, সেই ভবিষ্যতের দাবিতে আমরা এসেছি।

ছাত্রদের বিক্ষোভে বক্তব্য দেন, চট্টগ্রামের আইনজীবী আশরাফ হোসেন চৌধুরী সাত্তার বলেন, যে কোনো দাবিতে প্রতিবাদ জানানো নাগরিকদের অধিকার। কিছু দাবি করলেই তাকে গুলি করে মারতে হবে, এটা হতে পারে না। আমরা জাতিসংঘের অধীনে শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনতা গণহত্যার বিচার চাই। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমরা একাত্মতা ঘোষণা করছি।

সিলেটে সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেলে ছত্রভঙ্গ শিক্ষার্থীরা : সিলেটে মার্চ ফর জাস্টিসে অংশ নেওয়া আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে পুলিশ। এ সময় উভয় পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। গতকাল বুধবার দুপুর সোয়া ১টার দিকে এই ঘটনা ঘটে।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে নগরীর সুবিদ বাজার পয়েন্টে গেলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এ সময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে সামনে এগিয়ে গেলে পেছন থেকে পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ শুরু করে। এতে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী বেলা ১১টা থেকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে অবস্থান নিতে শুরু করেন আন্দোলনকারীরা। পরে সেখানে আগে থেকেই অবস্থান নেওয়া পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়। এরপর আরও শিক্ষার্থী যোগ দিয়ে স্লোগান দিতে শুরু করেন। তখন পুলিশ ক্যাম্পাসের ভেতরে চলে যায়। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কয়েক শতাধিক শিক্ষার্থী নিয়ে সেখান থেকে নগরীর কোর্ট পয়েন্টের দিকে যান। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে তারা সুবিদ বাজারে গেলে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ বলেন, এখন পর্যন্ত কেউ হতাহত হয়নি বা আটক করা হয়নি।