ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

শহীদ মিনারে জনস্রোত এক দফা ঘোষণা

শহীদ মিনারে জনস্রোত এক দফা ঘোষণা

৯ দফা দাবিতে আন্দোলন করে আসা শিক্ষার্থীরা এবার সরকারের পদত্যাগের এক দফা ঘোষণা দিয়েছেন। গতকাল শনিবার বিকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিক্ষোভ-সমাবেশ থেকে এই ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। ঘোষণাকালে নাহিদ ইসলাম বলেন, যেহেতু বর্তমান সরকারের নির্দেশে নির্বিচারে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। নারী-শিশু-ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিক কেউ এই গণহত্যা থেকে রেহাই পাননি। যেহেতু, সরকার এই হত্যাযজ্ঞের বিচার করার পরিবর্তে নির্বিচারে ছাত্র-জনতাকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করছে। যেহেতু, সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মরণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে হত্যাযজ্ঞ সংঘটন করেছে। যেহেতু, ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিক-মজুরসহ আপামর জনগণ মনে করছে, এই সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ বিচার এবং তদন্ত সম্ভব নয়। সেহেতু, আমরা বর্তমান স্বৈরাচারী সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি ঘোষণা করছি। একই সঙ্গে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি গ্রহণযোগ্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় সরকার গঠনের দাবি জানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। নাহিদ ইসলাম জানান, দাবি আদায়ে রোববার (আজ) থেকে সরকারের বিরুদ্ধে ‘সর্বাত্মক অসহযোগ’ কর্মসূচি পালন করবেন তারা। এদিকে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গতকাল রাজধানীর শহীদ মিনার এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষজন আসে শহীদ মিনারে। কোটা সংস্কারের দাবি ঘিরে শুরু হওয়া আন্দোলন এখন সরকার পতনের স্লোগানে উত্তাল।

গতকাল শনিবার দুপুর থেকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ শহীদ মিনারে জড়ো হতে শুরু করেন। সময় যত গড়াতে থাকে আন্দোলনকারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। লাখো মানুষের ভিড়ে শহীদ মিনার চত্বর ও এর আশপাশের এলাকার পা ফেলার জায়গা ছিল না। লাখো মানুষের মুহুর্মুহু স্লোগানে প্রকম্পিত হয় পুরো এলাকা।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পায়ে হাঁটার পাশাপাশি রিকশা, সিএনজিসহ বিভিন্ন মাধ্যমে শহীদ মিনারে আসেন শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে দেখা গেছে অভিভাবকদেরও। ছিলেন বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী, শিক্ষক এমনকি রিকশাচালকরাও। যেন জনমানুষের ঢল নামে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সমাবেশ যোগ দেয়া জনমানুষের ভিড় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের প্রাঙ্গণ থেকে ছড়িয়ে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জগন্নাথ হলসহ অন্য রাস্তায়ও।

শহীদ মিনার এলাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ‘জাস্টিস জাস্টিস, উই ওয়ান্ট জাস্টিস,’ ‘স্বৈরাচারের গদিতে আগুন জ্বালো একসাথে,’ ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাইরে,’ ‘দিয়েছি তো রক্ত, আরো দেব রক্ত,’ ‘জ্বালো রে জ্বালো, আগুন জ্বালো,’ ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’, ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, অভ্যুত্থান’, ‘পদত্যাগ পদত্যাগ, শেখ হাসিনার পদত্যাগ’ এমন নানা স্লোগান দিচ্ছেন। এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় নিহত, গণগ্রেপ্তার ও হয়রানির প্রতিবাদে ব্যান্ড সংগীতশিল্পীরা গতকাল বিকাল ৩টায় ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবরে জড়ো হন। সেখান থেকে শিক্ষার্থীদের প্রতি সংহতি জানাতে সংগীতশিল্পীরা শহীদ মিনারে রওনা দিয়ে। মিছিল নিয়ে বিকাল পৌনে ৪টার দিকে তারা শহীদ মিনার এলাকায় পৌঁছান। এদিকে, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে রিকশাচালকরাও গতকাল বিভিন স্লোগান দেয়। তাদের স্লোগানে উত্তাল হয়ে উঠে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বর।

শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ‘সর্বাত্মক অসহযোগ’ কর্মসূচি পালনে জরুরি নির্দেশনা : ‘সর্বাত্মক অসহযোগ’ কর্মসূচি সফল করার লক্ষ্যে জনগণকে বেশ কিছু জরুরি নির্দেশনা দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলন। নির্দেশনায় সারা দেশে স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করতে ব্যাপক পদক্ষেপের রূপরেখা দেওয়া হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ এক ফেসবুক পোস্টে এসব নির্দেশনা দেন।

মূল নির্দেশাবলীর মধ্যে রয়েছে : ১. কোনো ট্যাক্স পেমেন্ট নয় : নাগরিকদের সব ধরনের ট্যাক্স বা লেভি পেমেন্ট আটকে রাখার জন্য অনুরোধ করা হয়। ২. বিল পরিশোধ স্থগিত; বাসিন্দাদের বিদ্যুৎ, গ্যাস বা পানির বিল পরিশোধ না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ৩. প্রতিষ্ঠান বন্ধ : অফিস-আদালত ও কলকারখানাসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। তবে কর্মচারীদের কাজে যোগ না দিয়ে মাস শেষে বেতন আদায়ে উৎসাহিত করা হয়েছে। ৪. শিক্ষা কার্যক্রম স্থগিত রাখা : সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম বন্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে।

৫. রেমিট্যান্স সীমাবদ্ধতা : ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স না পাঠাতে প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। ৬. সরকারি অনুষ্ঠান বর্জন : নাগরিকদের সমস্ত সরকারি সভা, সেমিনার ও ইভেন্ট বর্জনের আহ্বান জানানো হয়েছে। ৭. বন্দর শ্রমিকদের ধর্মঘট : বন্দর শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বা কোনো পণ্য খালাস না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ৮. কারখানা বন্ধ: পোশাক কারখানাসহ কোনো কারখানা চালু থাকবে না। শ্রমিকদের ঘরে থাকতে বলা হয়েছে। ৯. গণপরিবহন স্থগিত : গণপরিবহন বন্ধ থাকবে, শ্রমিকরা যেন কর্মস্থলে না যায়। ১০. সীমিত সময় ব্যাংক চালু : জরুরি ব্যক্তিগত লেনদেনের জন্য প্রতি রোববার ব্যাংক খোলা থাকবে। ১১. পুলিশ কর্তব্যের সীমাবদ্ধতা : পুলিশ অফিসারদের প্রোটোকল, দাঙা বা প্রতিবাদের দায়িত্ব থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়, কেবলমাত্র রুটিন স্টেশনের কাজ সম্পাদন করতে বলা হয়েছে। ১২. অফশোর লেনদেন নিষিদ্ধ : মানি লন্ডারিং রোধে অফশোর ট্রানজেকশন বন্ধ থাকবে। ১৩. সামরিক বিধিনিষেধ : বিজিবি ও নৌবাহিনী ব্যতীত সেনাবাহিনী সেনানিবাসের বাইরে দায়িত্ব পালন করবে না। বিজিবি ও নৌবাহিনী ব্যারাক ও উপকূলীয় এলাকায় অবস্থান করবে। ১৪. আমলাতান্ত্রিক অনুপস্থিতি : আমলাদের সচিবালয়ে উপস্থিত না হতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে জেলা প্রশাসক বা উপজেলা কর্মকর্তাদের অফিসের বাইরে থাকতে বলা হয়েছে। ১৫. বিলাসবহুল পণ্যের দোকান বন্ধ : বিলাসবহুল পণ্য, শো-রুম, মল, হোটেল, মোটেল ও রেস্তোরাঁ বন্ধ থাকবে।

হাসপাতাল, ফার্মেসি, জরুরি পরিবহন পরিষেবা, অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবা, ফায়ার সার্ভিস, মিডিয়া, প্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহন, জরুরি ইন্টারনেট পরিষেবা এবং জরুরি ত্রাণ সহায়তাসহ প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলো অব্যাহত থাকবে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দোকানগুলো বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত খোলা থাকবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত