আজ সারা দেশে জমায়েত করবে আওয়ামী লীগ

চাপ মোকাবিলায় তৎপর সরকার

প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  বিশেষ প্রতিনিধি

শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার পর একে ঘিরে তৈরি হওয়া নানামুখী ‘চাপ’ সামাল দিতে হচ্ছে সরকারকে। এমন অবস্থায় ঢাকা সিটির সব ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে এবং বাংলাদেশের সব জেলা ও মহানগরীতে আজ রোববার জমায়েতের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। এছাড়া কাল সোমবার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন থেকে বঙ্গবন্ধু ভবন পর্যন্ত শোক মিছিল করারও ঘোষণা দেয়া হয়েছে। গতকাল শনিবার দুপুরে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে ডাকা এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

ওবায়দুল কাদের বলেন, একদিকে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, অন্যদিকে আমরা কোনো রকম মুখোমুখি অবস্থানে জড়াতে চাই না। সে কারণে সংঘাত হতে পারে এ ধরনের প্রোগ্রাম আমরা এড়িয়ে চলেছি। গতকাল এবং আজকেও আমাদের নির্ধারিত কর্মসূচি ছিল।

তিনি আরো বলেন, আমরা এখন নতুনভাবে ৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামালের জন্মবার্ষিকী। যদিও মৃত্যুর বেদনা, জন্মদিবসকে ছেপে চলে যায় শোকের কাছে। আমরা আগামীকাল নতুন করে প্রোগ্রাম দিয়েছি।

নতুন কর্মসূচির কথা জানিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, আজ রোববার ঢাকা সিটির সব ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে জমায়েত এবং বাংলাদেশের সব জেলা ও মহানগরীতে জমায়েত। আর ৫ তারিখে আমরা আমাদের সেই (স্থগিত শোক মিছিল) কর্মসূচি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন থেকে বঙ্গবন্ধু ভবন পর্যন্ত শোক মিছিল করব।

আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, এই দেশের মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ফিরিয়ে এনেছে।

ওবায়দুল কাদের বলেন, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের অপচেষ্টা চালাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত। তারা বারবার জনগণ দ্বারা প্রত্যাখাত, রাজনৈতিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তাই যে কোনো আন্দোলন দেখলেই সেটাকে সরকার উৎখাতে নিয়ে যেতে উম্মুখ হয়ে থাকে। সরকার সব উসকানি ও নৈরাজ্য ধৈর্য, সংযমের মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক, মির্জা আজম, এস এম কামাল হোসেন, আফজাল হোসেন, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম, বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন প্রমুখ।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সব দাবি মেনে নেয়ার পরও নতুন করে ৯ দফা দাবি দিয়ে ছাত্রদের নাম করে মাঠে রয়ে গেছে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি। এ কারণে অফিস-আদালত, ব্যাংক, বিমা খুলে দিলেও পরিস্থিতি এখনো থমথমে। এ রকম পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রসহ নানা দেশ প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে। তবে পরিস্থিতি মোকাবিলায় বহুমুখী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার দল। দেশে যেমন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি সংহত ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা রয়েছে; তেমনি বিদেশে যাতে ভুল বার্তা না যায় সেজন্য ঢাকায় দুই দুবার কূটনৈতিকদের ডেকে এনে ঘটনার ব্যাখা দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যদিও ঢাকার ব্যাখায় উন্নয়ন সহযোগীদের কেউ কেউ পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেনি।

দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির ব্যাখা করে বিশ্লেষকরা বলেছেন, বহুমুখী তৎপরতা চালিয়েও সরকার পরিস্থিতিকে আয়ত্বে আনতে না পারার কারণ আওয়ামী লীগের ঘরেই রয়েছে। এত বড় ঘটনা ঘটলেও সরকারের বহু মন্ত্রী নীরব। বেশ কয়েকজন মন্ত্রী বিদেশে। বহু নেতাকর্মী নীরব। গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের সরকারের যারা সুবিধা নিয়েছেন- সেইসব সুবিধাপ্রাপ্তদের গত ১৫ দিন ধরে দেখা যাচ্ছে না। যারা সুবিধার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশপাশে ঘুরেন, তাদেরও দেখা পাওয়া যাচ্ছে না।

জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কূটনীতিক বলেন, চলমান পরিস্থিতির কারণে সরকার বেশ চাপে পড়েছে। চাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিশেষ করে বিদেশে যাতে ভুল বার্তা না যায় সেজন্য একবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিব ঢাকায় কর্মরত নানা দেশের কূটনীতিকদের ডেকে এনে ব্রিফ করেছেন। তবু সরকার শান্তিতে নেই।

তিনি বলেন, একটি সরকার কতটুকু চাপে থাকলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিব দুইবার কূটনীতিকদের ব্যাখা দেন- তা বুঝতে হবে। এরপরও চাপ সামাল দেয়া যাচ্ছে না। এরকম পরিস্থিতিতে ঢাকায় দক্ষিণ কোরিয়া দূতাবাস আগামী ৬ আগস্ট অনুষ্ঠেয় বাংলাদেশ-দক্ষিণ কোরিয়া শীর্ষক এক আলোচনা অনুষ্ঠান স্থগিত করে দিয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলেছেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যখন বিশেষ পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ইউরোপ ঘুরে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থাকে বুঝানোর চেষ্টা করছেন। মন্ত্রীর নেদারল্যান্ডস সফরের সময় তার সঙ্গে দেখা করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রসিকিউটর করিম খান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মূল্যবোধ ও নেতৃত্বের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন। অপরদিকে, মন্ত্রী যখন ইউরোপে তখনই কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে চলমান পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির আলোচনা স্থগিত করেছে। এগুলো সুখকর ঘটনা নয় বলে মনে করছেন তারা। এসব বিষয় নিয়ে গত শুক্রবার ঢাকা ও দিল্লির দুইজন সাবেক কর্মকর্তা প্রায় ঘণ্টা দেড়েক আলোচনা করেছেন। এই দুই কর্মকর্তাই দুই সরকারের ঘনিষ্ঠ।

আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকার ওই সাবেক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বারবার বিএনপি-জামায়াতের ঘাড়ে দোষ চাপানোর বিষয়টি মানতে চায়নি দিল্লি। দিল্লির চিন্তনশিবির মনে করছে, বাংলাদেশে চলমান ঘটনা এবং আইনশৃঙ্খলা প্রশ্নে যথাসময়ে যথব্যবস্থা না নেয়ায়ই এত কাণ্ডের কারণ।

ওই কর্মকর্তা প্রশ্ন রেখে বলেন, শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনকে ঘিরে জনমনে এত ক্ষোভ তৈরি হলো; অথচ দলের সাংগঠনিক নেতৃত্ব বোঝেনি? এমনকি গোয়েন্দাদের ভূমিকা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। তার মতে, দেশ যখন অশান্ত তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাওয়াটাও ঠিক হয়নি। তবে এটাও ঠিক, চলমান ঘটনাটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এজন্য দিল্লি বাংলাদেশ বিষয়ে কোনো কথা বলবে না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর কিছু বললেও তা কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনেই বলবে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পরিস্থিতি কোনদিকে গড়াবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও তা বুঝতে পারেননি বা বোঝার চেষ্টা করেননি। তারা যদি প্রতিনিয়ত জনগণের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করতেন তাহলে আজ এই আন্দোলন এভাবে ছড়াত না। কারণ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা নানা কারণে নিজেদের এলাকায়ই বিচ্ছিন্ন। এরফলে সরকারের নানা উদ্যাগও এখন ঠিকভাবে কাজ করছে না। কোটাবিরোধী আন্দোলন নাশকতার দিকে ধাবিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আদর্শিক জোট ১৪ দল নেতাদের ডেকে সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়ায় তাদের যুক্ত করেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলীয় বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করে পরিস্থিতি তুলে ধরে করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা দেন। তিনি বিভেদ ভুলে কঠিন সময়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে সক্রিয় থাকার আহ্বান জানান। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদেরও সক্রিয় করার চেষ্টা চালানো হয়।

সংশ্লিষ্টদের মতে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সুযোগে বিএনপি-জামায়াতের নজিরবিহীন নাশকতা শুরু হলে কারফিউ জারি করা হয়েছিল। সেনা মোতায়েনের মতো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। এর ফলে আপাতত একটি স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। তবে বিরোধীরা নতুন করে আন্দোলন জমিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। শিক্ষার্থীদের প্রবলভাবে ইন্ধন দিচ্ছেন কিছু শিক্ষক, মতলববাজ সুশীল সমাজ, আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী; যাদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে উসকে দেয়ার জন্য প্রত্যেকে আলাদা আলাদা এজেন্ডা নিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াচ্ছে। বিএনপি-জামায়াতের এজেন্ডা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে পুনরুজ্জীবিত করে সরকার হটানো, সুশীল সমাজ নামধারীদের এজেন্ডা যেকোনো মূল্যে আরেকটি অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনা। আর সরকারের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা বিভিন্ন ব্যক্তি এখন আস্তে আস্তে তাদের রঙ বদলাতে শুরু করেছে।

জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু গণমাধ্যমে বলেছেন, দাবা খেলায় রাজা বাঁচাতে অনেক সময় হাতি ঘোড়া বিসর্জন দিতে হয়। দুয়েকজন মন্ত্রীকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়ে মন্ত্রিসভায় স্বচ্ছ ইমেজের ব্যক্তিদের আনলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া সহজ হতো।

এদিকে, সমন্বয়কদের সঙ্গে যখন আইনমন্ত্রীর নেতৃত্বে তিন মন্ত্রী বৈঠক করেছিলেন, তখন আশ্বাস দেয়া হয়েছিল- যেসব শিক্ষার্থীরা আটক হয়েছেন তাদের ছেড়ে দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। গত শুক্রবার পর্যন্ত ৪২ জন এইচএসসি পরীক্ষার্থীর জামিন হয়েছে। এর আগে ৬ সমন্বয়ককে ডিবি অফিস থেকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তারপরও ষড়যন্ত্রীরা সক্রিয়। আওয়ামী লীগ পুরো বিষয়টি কীভাবে সামাল দেয় তা দেখার জন্য সবার দৃষ্টি এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে।