৩২ নম্বরের বাড়িটি যেন বঙ্গবন্ধুরই প্রতিচ্ছবি

প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

শোকের মাসের আজ ৪ তারিখ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ড স্মরণে আগস্ট মাসটি শোকের মাস হিসেবে পালন করে আসছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার। বাঙালির এই অবিসংবাদিত নেতা জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটিয়েছেন স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে। আজীবন জাতির মুক্তির দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তার সংগ্রামী জীবন একটি সমসাময়িক ইতিহাস। সে ক্ষেত্রে তার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটিও ইতিহাসের সাক্ষী। সেই বাড়ি থেকেই তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করেছিলেন। আর এই বাড়িতেই তিনি ঘাতকের গুলিতে মর্মান্তিকভাবে নিহত হন। সরকারপ্রধান হওয়ার পরও তিনি কখনো বঙ্গভবনে বসবাস করেননি। বাসাবাড়ি ও মানুষের কোলাহল। সে কারণে বাসভবন হিসেবে ধানমন্ডির ওই বাড়িটি তার বসবাসের জন্য নিরাপদ ছিল না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা সম্পর্কে বিদেশি গোয়েন্দারা অবহিত ছিল এবং তাকে বঙ্গভবনে বসবাস করার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় আস্থা ছিল যে, এদেশের মানুষ তাকে হত্যা করতে পারে না। অথচ বঙ্গবন্ধুর সেই ধারণা পাল্টে গেল তাকে নির্মমভাবে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ হত্যার মধ্যদিয়ে। বর্তমানে বাড়িটি বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর নাম ধারণ করে জাতীয় সম্পদে পরিণত হয়েছে। বাড়িটি নির্মাণ করার ক্ষেত্রেও একটি ইতিহাস রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করার সময় বঙ্গবন্ধু চা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। সে হিসেবে তিনি সপরিবারে সেগুনবাগিচার ১১৫ নম্বরের সরকারি বাড়িতে বসবাস করতেন। ১৯৫৮ সালের ১২ অক্টোবর ওই বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করার পর তিন দিনের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার নোটিস দেওয়া হয়। নোটিস পেয়ে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মাসিক ২০০ টাকা ভাড়ায় সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় বয়েজ স্কুলের মাঠের পাশে এক পুলিশ কর্মকর্তার বাড়িভাড়া নেন। পরে সরকারি এজেন্সির হুমকির মুখে এ বাড়িটিও ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। তারপর কবি সুফিয়া কামালের প্রচেষ্টায় সেগুনবাগিচার ৭৬ নম্বর বাড়িতে মাসিক ৩০০ টাকা ভাড়ায় ওঠেন।

বঙ্গবন্ধু জাদুঘর সূত্রে জানা যায়, ১৯৫৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রী থাকা অবস্থায় তার একান্ত সচিব নূরুজ্জামান বেগম মুজিবের অনুরোধে ধানমন্ডি এলাকায় একখণ্ড জমির জন্য গণপূর্ত বিভাগে আবেদনপত্র জমা দেন। ১৯৫৭ সালে ৬ হাজার টাকায় ধানমন্ডিতে ১ বিঘা জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। বরাদ্দকৃত জমিতে প্রথমে দুই কক্ষবিশিষ্ট একতলা বাড়ি ও পরে দোতলা করা হয়। ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু পরিবার-পরিজন নিয়ে নির্মাণাধীন এ বাড়িতে ওঠেন। তখন একতলা বাড়িটিতে মাত্র দুটি শয়নকক্ষ ছিল, যার একটি কক্ষে বঙ্গবন্ধু দম্পতি থাকতেন। ১৯৬৬ সালে দ্বিতীয় তলার কাজ শেষ হওয়ার পর সেখানে বসবাস শুরু করলে একতলার কক্ষটি তিনি গ্রন্থাগার হিসেবে ব্যবহার করতেন। উত্তর পাশের কক্ষে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা থাকতেন। এ কক্ষেও এক পাশে থাকতেন শেখ কামাল ও শেখ জামাল। বাড়িতে ঢুকতেই ছিল ছোট একটি কক্ষ। যেটি ড্রয়িংরুম হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি সিদ্ধান্ত এ বাড়ি থেকেই দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চেও ঐতিহাসিক ভাষণের পর এ বাড়ি থেকেই বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে দিকনির্দেশনা দিতেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্বিচারে হত্যা ও গণহত্যা চালায়। বঙ্গবন্ধু এ বাড়ি থেকে রাত সাড়ে ১২টায় স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তখন যার যা কিছু আছে, তা নিয়ে হানাদার বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন তিনি। তার স্বাধীনতা ঘোষণার খবর ওয়্যারলেস ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেওয়া হয়।

এ বাড়ি থেকেই ২৫ মার্চ রাত দেড়টায় তথা ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি জাতির আলোকবর্তিকা শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে। তাকে প্রথমে ঢাকা সেনানিবাস ও পরে পাকিস্তানের পাঞ্জাবের মিওয়ানওয়ালি কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটি দখল করে রাখে। অন্যদিকে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর সড়কের ২৬ নম্বর বাড়িতে শেখ মুজিব পরিবারকে বন্দি করে রাখা হয়। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি তার প্রিয় স্বাধীন মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেন। ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িটির মেরামত কাজ শেষ হলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও পরিবার-পরিজন নিয়ে সরকারি বাসায় না উঠে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ওই বাড়িতে বসবাস করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর বাড়িটি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোররাতে তারই রক্তে রঞ্জিত হয়। ইতিহাসের এ ঘৃণ্যতম হত্যাকাণ্ডের কথা বাংলাদেশের মানুষ কোনো দিন ভুলবে না। তাই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে ৩২ নম্বরের বাড়িটি একটি ইতিহাস। বাড়িটি যেন বঙ্গবন্ধুর একটি প্রতিচ্ছবি।