ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

যেভাবে পতন হাসিনার

যেভাবে পতন হাসিনার

দেশজুড়ে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। গতকাল সোমবার রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের ১৬ বছরের শাসনের অবসান ঘটেছে। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে দেশ চলবে।

গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শেখ হাসিনা পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দিয়ে তার বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে দেশত্যাগ করেন। এতে শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা নিরাপদ স্থানে চলে যান। শেখ হাসিনা যাওয়ার আগে একটি ভাষণ রেকর্ড করে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সে সুযোগ পাননি। কারণ স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে ছাত্র-জনতা রাজপথে নামেন। রাজপথে পুলিশ, র‌্যাব, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ বাধে। ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে টিয়ারশেল ও গুলি চালানো হয়। এতে শতাধিক মানুষ নিহত হন, আহত হন কয়েক হাজার।

রাজনৈতিকবিদরা বলছেন, আওয়ামী লীগ একটানা ১৬ বছর ক্ষমতায় থেকেও জনসাধারণে মনের ভাব বুঝতে পারেনি। নামমাত্র জাতীয় নির্বাচন দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল, এতে মানুষের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে সেই ক্ষোভের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। কারণ শাসকদের বিলাসিতার কমতি ছিল না। যদিও জনগণকে ক্ষুধার্ত রেখে, সব ধরনের নাগরিক অধিকার কেড়ে নিয়ে শাসকের বিলাসিতা বেশি দিন টিকতে পারেনি। জনগণ রাষ্ট্রীয় স্বৈরশাসকের সব অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। স্বতঃস্ফূর্ত মানুষের অংশগ্রহণে রাস্তা, পাড়া মহল্লায় আন্দোলনের ঢেউ ওঠে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে সরকার নিষ্ঠুর বল প্রয়োগ করছিল। এতে শত শত মানুষের মৃত্যু হয়, কয়েক হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বন্দি করে লোকজনের উপর নির্যাতন করা হয়, এমন অনেক অভিযোগ পাওয়া যায়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় দিনে কারফিউ ভেঙে ঢাকামুখী লাখ লাখ মানুষ বিক্ষোভ মিছিলে রাজপথে নেমে আসেন। বেলা ১১টার দিকে শাহবাগ এলাকায় বিক্ষোভকারীরা জড়ো হন। এরইমধ্যে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের নেতৃত্বে বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী নেতা, হেফাজতে ইসলাম নেতা মামুনুল হক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, শিক্ষক আসিফ নজরুল ও জোনায়েদ সাকিও বৈঠকে ছিলেন। সেই বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের ইস্যু নিয়ে সবাই একমত পোষণ করেন। আলোচনা চলার আগেই বাংলাদেশের সদ্য পদত্যাগকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি ভারতের আগরতলায় পৌঁছেছে। একাধিক ভারতীয় সূত্র জানিয়েছে, সেখান থেকে প্রথমে নয়াদিল্লি ও তারপর লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন তিনি। তবে আগরতলা এবং নয়াদিল্লিতে তিনি কতদিন অবস্থান করবেন কিংবা কবে নাগাদ তিনি লন্ডনগামী বিমানে উঠবেন সে ব্যাপারে খবরটি লেখা পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি। টানা ৩৬ দিন ধরে চলা আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। এ দিন দুপুরের দিকে শেখ হাসিনাকে বহনকারী সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টারটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলার উদ্দেশে ছেড়ে যায়।

এর আগে সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে আন্দোলনের মধ্যে গত ১৪ জুলাই সদ্য পদত্যাগ করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা কোটা পাবে না তো কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে? কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে মর্মাহত ও অপমানিত বোধ করায় স্লোগানে স্লোগানে প্রতিক্রিয়া দেখান শিক্ষার্থীরা। এদিন রাত ১০টার পর প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ভেতরে জড়ো হয়ে স্লোগান আর বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন তারা। পরে রাত ১১টার পর থেকে ১টা পর্যন্ত বিভিন্ন হল থেকে মিছিল নিয়ে এসে জড়ো হন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে। কোটার বিরোধিতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের বিরোধিতায় তারা টিএসসি ও এর আশপাশে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। মাঝেমধ্যেই স্লোগানে উচ্চকিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। ছাত্রদের সঙ্গে ছাত্রীরাও বিভিন্ন হল থেকে বেরিয়ে যোগ দেন মধ্যরাতের এ বিক্ষোভে। মিছিলে শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘তুমি নও, আমি নই, রাজাকার, রাজাকার’, ‘লাখো শহীদের রক্তে কেনা, দেশটা কারো বাপের না’ ইত্যাদি স্লোগান দেন। তাদের ক্ষোভ কোটা আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে ঘিরে। পরে গত রোববার শেখ হাসিনা সড়কে নামা আন্দোলনকারীদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এরপরে গতকাল দেশজুড়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে।

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন এ বছরের ১১ জানুয়ারি। এর আগে ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদে নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। এরপর ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচন হয় একতরফা, যেখানে বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। এই নির্বাচন আগের রাতেই ব্যালটে সিল মারার ব্যাপক অভিযোগ ছিল। এ নির্বাচন ‘রাতের ভোট’ নামে পরিচিতি পায়। আর চলতি বছরের জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি আবার প্রধানমন্ত্রী হন। তবে এ নির্বাচনও বিতর্কিত। এতেও প্রধান বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি। নিজদলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী করে ‘ডামি’ প্রতিদ্বন্দ্বিতার আয়োজন করা হয়। এ নির্বাচনটিকে বিরোধীরা ‘ডামি নির্বাচন’ বলে আখ্যা দেন। ছয় মাসের মাথায় ব্যাপক ছাত্র ও গণবিক্ষোভের মুখে তিনি পদত্যাগ করে হেলিকপ্টারযোগে দেশ ছাড়েন।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংস পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি-ব্রাশফায়ার ও সংঘর্ষে দুইশ’র অধিক মানুষ মারা যায়। পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত রোববার প্রায় একশ’ মানুষ গুলি, সহিংসতা ও সংঘর্ষে মারা গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি ও সহিংসতায় নিহতদের মধ্যে অনেকের লাশ হাসপাতালে না নিয়ে দাফন করা হয়েছে। তাৎক্ষণিক পরীক্ষায় মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর এসব লাশ হাসপাতালে গ্রহণ না করে আত্মীয়দের কাছে ফেরত দেয়া হয়েছে, তাদের ময়নাতদন্ত ছাড়া দাফন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। নিহতদের মধ্যে বড় সংখ্যকই শিক্ষার্থী। যারা বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাকিদের একটি অংশ বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় মানুষ, যাদের অনেকে ছাত্রদের সমর্থনে রাস্তায় নেমে আসে। শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগের পরিচয় চিহ্নিত করা গেলেও নিহত সাধারণ অনেকের পরিচয় নিশ্চিত করতে না পেরে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম বা কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। নিহতদের দুই-তৃতীয়াংশ মারা গেছে গুলিবিদ্ধ হয়ে। কিছু মারা গেছে ব্রাশফায়ারে। বুকে বা মাথায় আঘাতে মারা গেছে কয়েকজন। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে পানিতে পড়ে মারা গেছে মানুষ। এক দফা দাবিতে সব বাধা উপেক্ষা করে গণভবনে প্রবেশ করে সাধারণ মানুষ। গতকাল সোমবার বেলা ৩টায় উল্লাস করতে করতে গণভবনে প্রবেশ করেন সাধারণ মানুষ। এর আগে গণভবনের সব নিরাপত্তা তুলে নেয়া হয়। এর আগে লং মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে রাজধানীর রাজপথ দখলে নেন আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা। রাজধানীর শাহবাগ, সায়েন্সল্যাব, যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, বাড্ডা, খিলগাঁও, মোহাম্মদপুর, মহাখালী, গাবতলীসহ ঢাকার সব গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট দখলে নেয় আন্দোলনকারীরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় মেয়ে শেখ হাসিনা। ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় তার জন্ম। শিক্ষাজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। সে সময় শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় বেঁচে যান। ছয় বছর নির্বাসিত জীবন শেষে ১৯৮১ সালে ১৭ মে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবেই দেশে ফেরেন তিনি। দেশে ফিরে নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেলেও গতকাল ছাত্র-জনতার রোষানলে পড়ে দেশত্যাগ করেন শেখ হাসিনা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত