অন্তর্বর্তীকালীন সরকার

প্রধান উপদেষ্টার প্রস্তাবে রাজি ড. ইউনূস

প্রকাশ : ০৭ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

রক্তসমুদ্রে পুরো দেশ ভাসিয়ে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতন ঘটেছে। গত সোমবার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাব করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। এই প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন অধ্যাপক ইউনূস। বিষয়টি নিশ্চিত করেন তার মুখপাত্র।

প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা ইস্তফা দেয়ার পর বাংলাদেশ মুক্ত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, দেশজুড়ে মানুষ আনন্দ উদযাপন করছে। তারা যেন দ্বিতীয় স্বাধীনতা পেয়েছে। তিনি (শেখ হাসিনা) যত দিন ক্ষমতায় ছিলেন, তত দিন আমাদের দেশ দখলকৃত ছিল। তিনি দখলদার শক্তি, একজন স্বৈরশাসক, জেনারেলের মতো আচরণ করছিলেন, সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। আজ বাংলাদেশের সব মানুষ নিজেদের স্বাধীন মনে করছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য প্রিন্টের সঙ্গে গত সোমবার এক আলাপচারিতায় এসব কথা বলেন ড. ইউনূস।

বাংলাদেশের মানুষের জন্য দ্বিতীয় স্বাধীনতার মতো মন্তব্য করে ড. ইউনূস বলেন, আমরা এখন নতুন করে শুরু করতে চাই এবং আমাদের জন্য একটি সুন্দর দেশ গড়ে তুলতে চাই। এই প্রতিশ্রুতিই আমরা দিতে চাই। আমাদের ভবিষ্যতের নেতৃত্ব দেবেন শিক্ষার্থী ও তরুণরা। আলাপচারিতায় সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত থাকার কথা উড়িয়ে দেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার মতো মানুষ আমি না। তিনি আরো বলেন, আমি আরো স্বাধীন পরিবেশে আমার কাজ চালিয়ে যেতে চাই, যা শেখ হাসিনার শাসনের সময় আমি পাইনি। কারণ, তিনি সব সময় আমাকে আক্রমণ করতেন। আগে যেসব কাজ করতে পারিনি, এখন সেই কাজে নিজেকে নিয়োজিত করব।

জানা গেছে, বিএনপি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছাড়ার পর ২০০৭ সালে সেনাবাহিনীর সমর্থনে এবং ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। ওই সময়ে ফখরুদ্দিন আহমদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করার আগে সেনাবাহিনীর তরফ থেকে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তবে এবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলন ও শতাধিক মানুষের মৃত্যুর ওপর দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাব করেছেন। গতকাল মঙ্গলবার ইউনূস সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক লামিয়া মোরশেদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তিনি জানান, ড. ইউনূস বলেছেন, ‘যে ছাত্ররা এত ত্যাগ স্বীকার করেছে, এই কঠিন সময়ে তারা যখন আমাকে এগিয়ে আসার অনুরোধ করেছে, আমি কীভাবে তাদের প্রত্যাখ্যান করতে পারি?’ ইউনূস সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক লামিয়া মোরশেদ জানান, ড. ইউনূস এখন প্যারিসে রয়েছেন। খুব শিগগিরই ঢাকায় ফিরে আসবেন।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, প্যারিসে ‘ছোটখাটো চিকিৎসা’ শেষ হলেই ‘তাৎক্ষণিকভাবে’ দেশে ফিরে আসবেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল ভোর ৪টার পর ফেসবুকে দেয়া ভিডিও বার্তায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ হাসান বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের রূপরেখা দিতে আমরা ২৪ ঘণ্টা সময় নিয়েছিলাম। কিন্তু জরুরি পরিস্থিতি বিবেচনায় এখনই রূপরেখা ঘোষণা করছি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে ছাত্র-নাগরিক অভ্যুত্থানের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে। তার সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে, তিনি দায়িত্ব নিতে সম্মত হয়েছেন।

তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির কাছে অনুরোধ থাকবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হোক। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বাকি সদস্যদের নামও আমরা সকালের মধ্যে ঘোষণা করবো। আমরা সকালের মধ্যে সরকার গঠনের প্রক্রিয়া দেখতে চাই।

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের সরকারের পতন ঘটায় দেশের পরিস্থিতি ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা নিয়ে আলোচনার জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ১৩ সদস্যের একটি দল বঙ্গভবনে যান। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও তিন বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে তারা সাক্ষাৎ করেছেন। এর আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিষয়ে সোমবার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন রাষ্ট্রপতি ও তিন বাহিনীর প্রধান। এরইমধ্যে সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

২০০৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক ইউনূস দেশের মানুষের উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি দেন। সে চিঠিতে তিনি নিজের রাজনীতি সম্পর্কে পরামর্শ ও সহযোগিতা কামনা করেন। ওই চিঠিতে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, নতুন রাজনীতি সৃষ্টির জন্য প্রচণ্ড উদ্যোগ নিতে হবে। এটি করতে না পারলে পুরোনো রাজনীতি থেকে পরিষ্কারভাবে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে না। আল্লাহর অসীম রহমতে আমি এক অতিশয় ভাগ্যবান মানুষ। আমার পাওয়ার আর কিছু অবশিষ্ট নেই। আমি জানি, রাজনীতিতে জড়িত হওয়া মানে বিতর্কিত হওয়া। আপনারা যদি মনে করেন, আমার রাজনীতিতে আসাটা দেশে নতুন রাজনৈতিক পরিমণ্ডল রচনায় সহায়ক হবে তবে আমি তার জন্য এ ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত আছি। একটি নতুন রাজনৈতিক দল কীভাবে গঠন করা যায়, কীভাবে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচনে মনোনীত করা যায়, কীভাবে তৃণমূল থেকে সরাসরি মতামত পাওয়া যায়- এসব বিষয় নিয়ে তিনি মানুষের মতামত এবং পরামর্শ জানতে চান। পরে অবশ্য রাজনীতিতে আসার জন্য তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে যে খোলা চিঠি দিয়েছিলেন তার তিন মাসের মধ্যেই সে প্রক্রিয়া থেকে সরে আসেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ২০০৭ সালের ৩ মে অধ্যাপক ইউনূস রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন। এজন্য তিনি জাতির উদ্দেশ্যে একটি চিঠি প্রকাশ করেন। সে চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, যাদের সঙ্গে পেলে দল গঠন করে জনগণের সামনে সবল ও উজ্জ্বল বিকল্প রাখা সম্ভব হতো তাদের আমি পাচ্ছি না। আর যারা রাজনৈতিক দলে আছেন তারা দল ছেড়ে আসবেন না। বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে এ পথে অগ্রসর না হওয়াই সঠিক হবে মনে করে এ প্রচেষ্টা থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অধ্যাপক ইউনূস। তবে এবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।