আশ্রয়ের খোঁজে হাসিনা

প্রকাশ : ০৭ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান ঘিরে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করার পর শেখ হাসিনার ভারতে পালানোর নাটকীয়তায় ঘেরা প্রথম ২৪ ঘণ্টা পার হয়েছে। হাসিনার লন্ডনে আশ্রয় চাওয়াসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় খুঁজছে হাসিনা।

জানা যায়, ঘটনাবহুল ৫ আগস্টের দুপুরে ঢাকা থেকে দিল্লির কাছে প্রায় একইসঙ্গে দুটো অনুরোধ আসে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের সঙ্গে গণভবনে যে বৈঠকের পর শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন, এটা ঠিক তার পরের ঘটনা।

প্রথম অনুরোধটা আসে সরাসরি শেখ হাসিনার কাছ থেকে। তিনি ‘তখনকার মতো’ ভারতে আসতে চান, দিল্লির কাছে সেই ‘অ্যাপ্রুভাল’ (অনুমোদন) চেয়ে অনুরোধ জানান।

দ্বিতীয় অনুরোধটাও প্রায় একইসঙ্গেই আসে। আর এটা বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের (সশস্ত্র বাহিনীর) কাছ থেকে। তাতে শেখ হাসিনাকে বহনকারী একটি সামরিক বিমানের জন্য ভারতে যাওয়ার ‘ফ্লাইট ক্লিয়ারেন্স’ চাওয়া হয়। সেই অনুমতি মেলার পর অবশেষে গত সোমবার সন্ধ্যায় শেখ হাসিনাকে নিয়ে ওই বিমান দিল্লির কাছে অবতরণ করে।

কোনো ‘অজানা’ সূত্র নয়- ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর নিজেই গতকাল মঙ্গলবার বিকালে ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় তার বিবৃতিতে এ তথ্যগুলো জানিয়েছেন। সেইসঙ্গেই বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে ভারত সরকার অবশেষে তার নীরবতা ভেঙেছে।

কিন্তু দিল্লির কাছে হিন্ডন এয়ারবেসে নামার পর ঠিক কীভাবে পুরো একটা দিন কাটল শেখ হাসিনার?

দিল্লিতে নামার পর প্রথমেই তাকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানান ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালসহ আরো কয়েকজন কর্মকর্তা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দূত হিসেবেই অজিত ডোভাল সেখানে গিয়েছিলেন।

তারপর বিমানঘাঁটির টার্মিনাল ভবনের লাউঞ্জে চা-পান করতে করতে তাদের মধ্যে বেশ খানিকক্ষণ কথাবার্তাও হয়। দিল্লির কাছে গাজিয়াবাদে হিন্ডন বিমানবন্দর, যেখানে শেখ হাসিনা সোমবার এসে নামেন।

শেখ হাসিনার কন্যা সাইমা ওয়াজেদ পুতুল, যিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক মহাপরিচালক হিসেবে গত বছর থেকে অনেকটা সময় দিল্লিতেই থাকেন, ঘটনাচক্রে গতকাল শহরে ছিলেন না। তিনি তখন থাইল্যান্ডে অবস্থান করছিলেন। দিল্লিতে নামার পর থাইল্যান্ড থেকেই মায়ের সঙ্গে তার সরাসরি কথা হয়, পরে তিনি দিল্লির উদ্দেশেও রওনা হয়ে যান।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ও এর মধ্যে একাধিকবার মার সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। এখানে অবশ্য একটা জিনিস স্পষ্ট করে নেয়া দরকার, শুরুতে ভারত ভেবেছিল শেখ হাসিনার ভারতে নামাটা একটা সাময়িক যাত্রাবিরতি মাত্র। তিনি নিজেও যখন ভারতের কাছে অ্যাপ্রুভাল চান, সেটাও ছিল ‘তখনকার মতো’ নামার অনুমতি। কাজেই দিল্লিতে কর্মকর্তারা ধরেই নিয়েছিলেন, তিনি হয়তো এখানে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়েই তৃতীয় কোনো দেশের উদ্দেশে রওনা হয়ে যাবেন, যেটা হবে তার চূড়ান্ত গন্তব্য।

সেই তৃতীয় গন্তব্যটা যে ব্রিটেন হতে যাচ্ছে, সে ব্যাপারেও মোটামুটি ভারতীয় কর্মকর্তারা নিশ্চিত ছিলেন। এই কমপ্লেক্সের ভেতরেই আপাতত রাখা হয়েছে শেখ হাসিনাকে। তার একটা প্রধান কারণ ছিল, শেখ হাসিনার সঙ্গেই ছিলেন তার বোন শেখ রেহানাও যিনি নিজে একজন ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী। শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটেনের শাসকদল লেবার পার্টির একজন সিনিয়র এমপিও বটে। শেখ হাসিনা নিজেও বহুদিন লন্ডনে কাটিয়েছেন।

তারপর ব্রিটেনের যেহেতু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ক্ষমতাচ্যুত নেতানেত্রীদের রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার পুরোনো ইতিহাস আছে, তাই এখানেও কোনো সমস্যা হবে না বলেই ধরে নেয়া হয়েছিল।

বস্তুত সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ (শেখ হাসিনার বিমান হিন্ডনে অবতরণের ঘণ্টাখানেক পরেই) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, উনি দিল্লিতে নেমেছেন একটা ‘স্টপওভার’ হিসেবে। আমরা ধারণা করছি রাত ৯টার দিকেই তিনি আবার লন্ডনের পথে রওনা হয়ে যাবেন।

বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যে সিজে-১৩০ ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্র্যাফটটি শেখ হাসিনাকে দিল্লি নিয়ে এসেছিল, সেটিই তাকে লন্ডনে নিয়ে যাবে না কি ভারতের কোনো বিমানে বা নিয়মিত কমার্শিয়াল ফ্লাইটে তারা যাবেন সেটা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু সন্ধ্যার পর ক্রমশ এটা স্পষ্ট হতে থাকে যে, ব্রিটেন যত সহজে আশ্রয়ের আবেদন মঞ্জুর করবে বলে ভাবা হয়েছিল, বিষয়টা তত সহজ হবে না। রাতের দিকে দিল্লিতে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাই কমিশনার লিন্ডি ক্যামেরন ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে অনানুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেন যে, ওই আবেদন এখন বিবেচনাধীন আছে, সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগতে পারে।

তারপরই জরুরি ভিত্তিতে ফিনল্যান্ডসহ একাধিক স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়- যাতে অন্তত সাময়িকভাবে হলেও সেখানে শেখ হাসিনা আশ্রয় নিতে পারেন। কিন্তু রাতের মধ্যে এ ব্যাপারে বিশেষ আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।

ওদিকে ততক্ষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাসভবনে ভারতের মন্ত্রিসভার নিরাপত্তাবিষয়ক কমিটির (ক্যাবিনেট কমিটি অন সিকিওরিটি বা সিসিএস) জরুরি বৈঠক বসে, যেখানে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে বিশদ আলোচনা হচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনসহ সিনিয়র কর্মকর্তারা সেই বৈঠকে অংশ নেন।

ওদিকে রাতেই আর শেখ হাসিনার রওনা হওয়া হচ্ছে না, এটা বুঝেই তাকে ও শেখ রেহানাকে হিন্ডন এয়ারবেসের টার্মিনাল লাউঞ্জ থেকে সরিয়ে নিয়ে আসা হয়। কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে তাকে রাখা হয় হিন্ডন থেকে কিছুটা দূরে গাজিয়াবাদের ইন্দিরাপুরমে আধাসামরিক বাহিনীর একটি অতিথিনিবাস বা ‘সেফ হাউসে’।

মঙ্গলবার বিকালে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তারা দুজনে সেখানেই আছেন। পরে অবশ্য তাদের অন্য কোনো জায়গাতেও (যা আরো বেশি সুরক্ষিত ও গোপন রাখা সহজ) সরিয়ে নেয়া হতে পারে।

এরইমধ্যে ভারত সরকার এটা উপলব্ধি করেছে, খুব চট করে হয়তো শেখ হাসিনার ভারত ছেড়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি, বাংলাদেশ নিয়ে মঙ্গলবার সকালে ভারত সরকার পার্লামেন্ট অ্যানেক্সি ভবনে যে সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছিল, সেখানেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ইঙ্গিত দেন যে, শেখ হাসিনা ‘আপাতত’ ভারতেই থাকছেন।

তিনি সেখানে আরো বলেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারত সরকারের ‘প্রাথমিক আলোচনা’ হয়েছে। ‘নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জন্য ভারত তাকে আরো সময় দিতে চায়’, এস জয়শঙ্করকে উদ্ধৃত করে এমন কথাও জানিয়েছে কোনো কোনো সূত্র।

এদিকে মঙ্গলবার সকাল ৯টা নাগাদ বাংলাদেশ এয়ারফোর্সের সিজে-১৩০ এয়ারক্র্যাফটটি টেক অফ করলে ভারতের সংবাদসংস্থা এএনআই খবর দেয় যে, ‘শেখ হাসিনাকে নিয়ে উড়ে গেল বিমান’। কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য তারা ভুল সংশোধন করে জানায় যে, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা ওই বিমানে চেপে ঢাকায় ফিরে গেছেন, শেখ হাসিনা ওই বিমানে ছিলেন না। ফলে আপাতত রীতিমতো একটা অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যেই দিল্লিতে ২৪ ঘণ্টা অতিবাহিত করলেন শেখ হাসিনা।

একজন কর্মকর্তা বলছিলেন, মানসিকভাবে তিনি যতই বিপর্যস্ত হন, বাইরে থেকে তিনি তা একেবারেই বুঝতে দিচ্ছেন না। স্বাভাবিকভাবেই কথাবার্তা বলছেন, আলোচনা করছেন। শারীরিকভাবেও সুস্থই আছেন।

এদিকে গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত বৈঠকে সভাপতিত্ব করেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। সরকার পতনের পর বাংলাদেশের সহিংস-কবলিত পরিস্থিতি বিশেষ করে নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া মোকাবিলায় ভারত সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে সমস্ত দলের নেতাদের অবহিত করেছেন তিনি। ভারতের সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি এ খবর জানিয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, ভারত সরকার বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে। বাংলাদেশি ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে তারা যোগাযোগ রাখছে।

বাংলাদেশে বহু ভারতীয় নাগরিক ও সংখ্যালঘুর বসবাস। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভারত সব পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলবে বলে জানিয়েছেন জয়শঙ্কর।

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে জয়শঙ্কর বলেছেন, এটি একটি সাময়িক পরিস্থিতি। নতুন সরকার সঠিক সময়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ নিয়ে ভারতে সর্বদলীয় বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে শেখ হাসিনাকে উৎখাতে পাকিস্তানের হাত আছে কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি ও দেশটির বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধী।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাপক বিক্ষোভের মধ্যে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত সর্বদলীয় বৈঠকের সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের কাছে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধী দলের নেতা রাহুল গান্ধী।

বেশ কয়েকটি সূত্রের বরাত দিয়ে এনডিটিভি জানিয়েছে, ঢাকায় ক্ষমতার পালাবদলের কূটনৈতিক প্রভাব মোকাবিলায় মোদি সরকারের স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি কৌশল কী তা জানতে চেয়েছেন রাহুল গান্ধী।

জবাবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর জানিয়েছেন, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ঘনিষ্ঠভাবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করছে যাতে বাংলাদেশ বিষয়ে নয়াদিল্লি তার পরবর্তী পদক্ষেপটি ঠিক করতে পারে।

পরে এই কংগ্রেস নেতা আরো জিজ্ঞেসা করেন, ব্যাপক বিক্ষোভের জেরে হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির চূড়ান্ত পরিণতিতে বিদেশি শক্তিগুলো, বিশেষ করে পাকিস্তান জড়িত থাকতে পারে কি না। এর জবাবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার জানায়, তারা এই বিষয়টি তদন্ত করছে।

সর্বদলীয় এই বৈঠকের বিষয়ে একটি সূত্র আরো উল্লেখ করেছে, পাকিস্তানি একজন কূটনীতিক হিংসাত্মক বিক্ষোভের মধ্যে বাংলাদেশের পরিস্থিতি প্রতিফলিত করতে ক্রমাগত তার সামাজিক মিডিয়া প্রদর্শনের ছবি পরিবর্তন করছেন বলে সরকার বলেছে। মোদি সরকার বলেছে, এই ধরনের কাজ আরো বড় কিছু নির্দেশ করে কি না সেটিও তারা তদন্ত করছে।

রাহুল গান্ধী আরো জিজ্ঞেসা করেন, নয়াদিল্লি বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহের এই নাটকীয় মোড়ের কোনো পূর্বাভাস পেয়েছিল কি না। এর উত্তরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর বলেন, ভারত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।

এনডিটিভি বলছে, মঙ্গলবারের এই সর্বদলীয় বৈঠকে কংগ্রেস এবং অন্যান্য বিরোধীদলগুলো প্রতিবেশী বাংলাদেশে সংকট মোকাবিলায় নরেন্দ্র মোদি সরকারকে তাদের পূর্ণ সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

বৈঠকের পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর বিরোধীদের সর্বসম্মত সমর্থনের প্রশংসা করে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে একটি পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের চলমান ঘটনাবলী সম্পর্কে আজ সংসদে একটি সর্বদলীয় বৈঠকের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হয়েছে। এখানে সবার সর্বসম্মত সমর্থন এবং বোঝাপড়ার প্রশংসা করছি।

এর আগে সোমবার রাতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সিসিএস বা ক্যাবিনেট কমিটি অন সিকিউরিটির বৈঠক বসেছিল। সিসিএসের বৈঠকে আলোচনার প্রধান বিষয় ছিল বাংলাদেশের পরিস্থিতি। সিসিএস হলো নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শীর্ষ কমিটি।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর সবাই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

তবে শুধু এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক নয়, সোমবার সকাল থেকে একের পর এক বৈঠক হয়েছে। নানা স্তরে হয়েছে। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মধ্যে হয়েছে। কূটনীতিকদের মধ্যে হয়েছে। নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে হয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞকে ডাকা হয়েছে। তাদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে।

এক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, ভারতের এক্ষেত্রে একটা বড় চিন্তা রয়েছে। তা হলো, চীন ও পাকিস্তানকে নিয়ে। ভারতের প্রতিবেশী এই দুই দেশ এই পরিস্থিতিতে কী ভূমিকা নেবে, সেটা ভারতের একটা প্রধান বিচার্য বিষয়।

বাংলাদেশের ঘটনাবলি নিয়ে গত সোমবার রাতেই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বৈঠক করেছিলেন লোকসভার বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধীর সঙ্গে। আর মঙ্গলবার সকালে সংসদের অধিবেশন শুরু হওয়ার আগে সর্বদলীয় বৈঠক করেন তিনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নিরাপত্তা সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ভারত চায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেখ হাসিনা অন্য দেশে চলে যাক।

এদিকে ভারতের জিন্দল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত জানিয়েছেন, মূলত দুইটি কারণে ভারত শেখ হাসিনাকে রাখতে চায় না। প্রথম বিষয়টি অবশ্যই তার নিরাপত্তা সংক্রান্ত। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, বাংলাদেশে যে সরকারই আসুক, ভারত তার সঙ্গে সুসম্পর্ক চায়। আর বাংলাদেশে হাসিনাবিরোধী মনোভাব তুঙ্গে। ভারত চায় না, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেয়ার ঘটনায় ছায়াপাত করুক।

শ্রীরাধার বক্তব্য, এর আগে সেনা সরকার যখন ছিল, তখন ভারতের অসুবিধা ছিল। কিন্তু এবার সেনা সম্ভবত পেছনে থাকবে, বাংলাদেশে নতুন কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হবে বলে মনে হচ্ছে। ফলে তাদের সঙ্গে ভারতের আলোচনা করতে কোনো অসুবিধা হবে না।

প্রবীণ সাংবাদিক এবং কূটনীতি বিশেষজ্ঞ প্রণয় শর্মা বলেন, বাংলাদেশের ঘটনা ভারতকে একটা বড় চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। ভারত চায় না, বাংলাদেশের ঘটনার অভিঘাত দেশের মধ্যে পড়ুক।

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করার পর শেখ হাসিনার ভিসা বাতিল করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মঙ্গলবার দেশটির পররাষ্ট্র দফতরের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র ভিসা বাতিলের এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।

এর আগে দেশ ছেড়ে শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন প্রক্রিয়াকে গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার আহ্বান জানায়।

এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেয়া এক পোস্টে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বাতিলের তথ্য জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, মার্কিন সরকার বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিসা প্রত্যাহার করেছে। পররাষ্ট্র দফতরের ঘনিষ্ঠ সূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করেছে বলে এক্সে জানিয়েছেন বার্গম্যান।

বার্গম্যান সামাজিক মাধ্যমে আরো লিখেছেন, হাসিনা যুক্তরাজ্যে আশ্রয় চাওয়ার কথা বিবেচনা করছেন, সেখানে তার বোন (শেখ রেহানা) এবং ভাগ্নি (এমপি টিউলিপ সিদ্দিক) থাকেন। হাসিনা যে পদ্ধতিতে ব্রিটেনের কাছে আশ্রয় চেয়েছেন, অভিবাসন আইন অনুযায়ী তা সম্ভব নয়।