সেনা-নৌ-বিজিবির সহায়তায়

সারাদেশে থানার কার্যক্রম শুরু

প্রকাশ : ১০ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ভয়ে পুলিশ সদস্যরা থানায় কাজে যোগ দিচ্ছেন না। তাদের সেই ভয় কাটিয়ে তুলতে এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পুলিশের সঙ্গে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিজিবির সদস্যরা একযোগে কাজ করছেন।

জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট ও এরআগে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও পুলিশের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ হয়। এতে পুলিশের গুলিতে বহু মানুষ নিহত হয়েছেন। আবার ছাত্র-জনতার হামলায় বহু পুলিশ সদস্যও মারা গেছেন। দেশের প্রায় সব থানায় পুলিশের ওপর হামলা হয়, লুটপাট-অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে আতঙ্কে গা-ঢাকা দেন পুলিশ সদস্যরা। অবশেষে প্রায় চার দিন পর সাময়িক বাহিনীর সদস্যদের সহায়তায় থানা পুলিশ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর প্রায় ২৯টি থানার কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। প্রতিটি থানায় পুলিশ সদস্যদের সহায়তায় থাকছেন সেনাসদস্যরা।

অন্যদিকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) রংপুর ও যশোর রিজিয়নের সার্বিক তত্ত্বাবধানে রংপুর রেঞ্জের সীমান্তবর্তী ১১টি থানা এবং খুলনা রেঞ্জের সীমান্তবর্তী ১০টি থানার স্বাভাবিক কার্যক্রম চলছে। রংপুর রেঞ্জের সীমান্তবর্তী দিনাজপুরের হাকিমপুর থানা, লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা ও পাটগ্রাম থানা, ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর থানা, পঞ্চগড়ের আটোয়ারী ও তেঁতুলিয়া থানা, কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি, রৌমারী, চর-রাজিবপুর, কচাকাটা ও ঢুষমারা থানাসহ ১১টি থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

অপরদিকে, খুলনা রেঞ্জের সীমান্তবর্তী যশোরের বেনাপোল পোর্ট থানা, সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ, দেবহাটা ও কলারোয়া থানা, চুয়াডাঙ্গার দর্শনা ও জীবননগর থানা, মেহেরপুর সদর, মুজিবনগর ও গাংনী থানা এবং কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানাসহ মোট ১০টি থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

এ বিষয়ে বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে চলমান পরিস্থিতির আলোকে সীমান্তবর্তী জনপদে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে জনমনে আস্থা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিজিবি সীমান্ত ও সীমান্তের আশপাশের জনপদসহ সীমান্তবর্তী থানাসমূহে নিরাপত্তা জোরদার করেছে। থানাসমূহে নিরাপত্তা জোরদারে মোবাইল ও স্ট্যাটিক টহল পরিচালনাসহ গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া সীমান্তে ও সীমান্তবর্তী এলাকায় জননিরাপত্তা হানিকর কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে বিজিবির সহায়তার জন্য নিকটস্থ বিওপি ও ব্যাটালিয়নের সমন্বয়ে জরুরি মোবাইল সেবা চালু করেছে। বিজিবির এমন কার্যক্রমের ফলে এরইমধ্যে সীমান্ত ও সীমান্তবর্তী জনপদে শৃঙ্খলা এবং জনমনে স্বস্তি ফিরে আসতে শুরু করেছে। সীমান্তবর্তী থানাগুলো বিজিবির নিরাপত্তায় জোরদারের ফলে এরইমধ্যে থানার স্বাভাবিক কার্যক্রমেও গতি ফিরেছে।

উপকূলীয় ২৯ থানায় নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে নৌবাহিনী। থানাগুলো হলো- ভোলা সদর, দৌলতখান, বোরহানউদ্দিন, লালমোহন, তজুমদ্দিন, মনপুরা, চরফ্যাশন, দক্ষিণ আইচা, দুলারহাট, শশীভূষণ, বরগুনা সদর, বামনা, বেতাগী, আমতলী, তালতলী, পাথরঘাটা, মংলা, রাঙ্গাবালী, খুলনা সদর, খালিশপুর, হরিণটানা, লবণচরা, কয়রা, দিঘলিয়া, দাকোপ, সন্দ্বীপ, হাতিয়া, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া। এছাড়া সেনাবাহিনীর সহায়তা ও নিরাপত্তায় রাজধানীর বেশ কয়েকটি থানার স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

এ বিষয়ে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ নৌবাহিনী উপকূলীয় অঞ্চলের থানাগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা ও নিরাপত্তা প্রদানে নিয়োজিত রয়েছে।

গতকাল শুক্রবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও থানার কার্যক্রম শুরু হয়। থানার নিরাপত্তায় পুলিশের পাশাপাশি সেনা সদস্যরা কাজ করছে, সঙ্গে দেখা গেছে আনসার সদস্যদের। থানার কার্যক্রম শুরুর আগে তেজগাঁও থানা পুলিশের সহায়তায় স্থানীয়দের সঙ্গে বৈঠক করেছে সেনাবাহিনী। সাধারণ মানুষ থানার কার্যক্রম শুরুর বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে বলে জানিয়েছেন সেনাবাহিনীর ২৫ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কোম্পানি অধিনায়ক শাখাওয়াত খন্দকার।

রাজধানীর তেজগাঁও থানায় এক সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনীর ২৫ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানি কমান্ডার শাখাওয়াত খন্দকার বলেন, সেদিন (৫ আগস্ট) জনমানুষের প্রচণ্ড স্রোত ছিল। তাদের কন্ট্রোল করা তখন ডিফিকাল্ট হয়ে যাচ্ছিল। সাধারণ মানুষের সঙ্গে দুর্বৃত্তরা যেভাবে পুলিশসহ মানুষ হত্যা করছে, তখন আমরা ডিসিশন নিয়েছি থানা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, পুলিশ সদস্যদের বাঁচাতে হবে।

তারা জনগণের সেবক, তাদের আবার রিফর্ম করার সুযোগ করতে হবে। এছাড়াও তেজগাঁও থানায় কয়েকশ’ পরিবার আছে, পুলিশ সদস্যরা আছে। থানায় অনেক অস্ত্র আছে। যেগুলো দুর্বৃত্তদের কাছে গেলে দেশ চরমঝুঁকির মধ্যে পড়বে। তখন আমরা থানার নিরাপত্তা জোরদারের ব্যবস্থা করেছি। তিনি আরও বলেন, এছাড়াও আমরা এ এলাকায় ছাত্র-শিক্ষক, ব্যবসায়ী, স্কাউট, বিএনসিসি ও আনসার বাহিনীরসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আমরা সমন্বয় সভা করেছি। পুলিশ বাহিনীকে রিফর্ম করতে তারা আমাদের আশস্ত করেছেন। তেজগাঁও থানার উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) আজিমুল হক বলেন, সামরিক বাহিনীর সদস্য যেভাবে আমাদের পুলিশ সদস্যদের বাঁচাতে এগিয়ে এসেছেন, মানুষের জানমাল রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তাদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা সামরিক বাহিনীর সহায়তায় পুলিশের সব কার্যক্রম শুরু করেছি। সব নাগরিকের কাছে অনুরোধ, আপনারা থানায় আসুন। আপনাদের সেবা দিতে আমরা প্রস্তুত। তিনি বলেন, তেজগাঁও বিভাগে ৬টি থানার মধ্যে ৩টি থানার কার্যক্রম পুরোপুরি চালু হয়েছে। তেজগাঁও থানার পুলিশ সদস্যরাও কাজে যোগ দিয়েছেন। গতকাল বেলা ১টা পর্যন্ত ওই থানায় তিনটি জিডি করা হয়েছে। যেসব থানায় হামলা হয়নি বা কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেসব থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আর যেসব থানায় হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, সেসব থানায় পুলিশ সদস্যরা এলেও সেখানে পুলিশের বসার মতো অবস্থা ছিল না। তাই ডিএমপির ২১ থানায় এখনো কার্যক্রম শুরু হয়নি।

রাজধানীর অনেক থানায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পুড়িয়ে দেওয়া হয় থানা-পুলিশের কাজে ব্যবহৃত গাড়ি। অনেক জায়গায় অস্ত্রসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম ও নথি লুট হয়। এরপর পুলিশি ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ে। গুলশান থানার এসআই মামুন মিয়া বলেন, গতকাল পারিবারিক ঘটনায় থানায় একটি জিডি হয়েছে। দেখা গেল, আরও কয়েকজন ব্যক্তি জিডি ও মামলার জন্য অপেক্ষা করছেন। গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলাম বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে গুলশান থানায় হামলা হয়নি। গতকাল থেকে তাদের থানায় স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

৫ আগস্ট রাজধানীর বাড্ডা থানায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। থানাটিতে বসে কাজ করার মতো অবস্থা নেই। জানা যায়, সেনাসদস্যদের পাহারায় কয়েকজন পুলিশ সদস্য থানায় এসেছেন। থানার সামনে বসে একজন সেনাসদস্য থানায় আসা পুলিশ সদস্যদের নামের তালিকা করছেন। একজন পরিদর্শকসহ তিন পুলিশ সদস্য জানান, তারা থানার ওসির নির্দেশনায় কাজ শুরু করবেন। ভাটারা থানাটিও পুড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। সেখানেও পোড়া থানা ভবনের সামনে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। কিন্তু পুলিশ সদস্য আসেননি। শাহবাগ থানায় কার্যক্রম শুরুর কথা জানিয়েছেন এসআই মাইনুল ইসলাম। তিনি জানান, গত বৃহস্পতিবার তারা কাজে যোগ দিয়েছেন। তারা দুটি লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। নিউমার্কেট থানায় গত শনিবার সকাল ৮টার দিকে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সেখানে অনেকে সাদাপোশাকে দায়িত্ব পালন করছেন।