অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের স্বচ্ছতার জন্য প্রশাসনে বিতর্কিতদের রদবদল করা হবে। এরইমধ্যে জনপ্রশাসনে ব্যাপক পরিসরে কর্মকর্তাদের রদবদল করা হয়েছে। এবার প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে কর্মকর্তাদের রদবদল করা হবে। একইসঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া হবে। বর্তমানে প্রশাসনে সিনিয়র সচিব ও সচিব বা সমমর্যাদার কর্মকর্তা রয়েছেন ৮৫ জন। এর মধ্যে চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত রয়েছেন ১৯ জন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের দেশ পরিচালনায় সুবিধার জন্য দেশের সব জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপার (এসপি) পদে পরিবর্তনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বর্তমান ডিসি-এসপিদের প্রত্যাহার করে সেখানে নতুন নিয়োগ দেওয়া হবে। এজন্য যোগ্য কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক শর্তে আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, প্রশাসনে ৩০ বছর সার্ভিস দিয়েছি। চাকরি জীবনে সৎ, দক্ষ ও অভিজ্ঞ সবই আছে, এরপরও রাজনৈতিক ট্যাগ লাগিয়ে পদোন্নতি দেয়নি সদ্য বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকার। ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তা হওয়ার পরেও সিনিয়র সহকারী সচিব পদে রয়েছেন। অথচ তার ব্যাচের অনেকেই পদোন্নতি পেয়ে সচিব হয়েছেন। এছাড়াও ক্যাডার সার্ভিসের ২০তম ব্যাচ পদোন্নতি পেয়ে যুগ্মসচিব হয়েছেন। সার্ভিসে পরে এসে আগে পদোন্নতি পেয়েছেন, জুনিয়রদের স্যার বলে সম্মাধন করতে হচ্ছে সিনিয়রদের। প্রশাসনে এরচেয়ে লজ্জার কিছু নেই।
সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) স্বাক্ষর শেখ হাসিনাকে করতে হয়েছে। জনপ্রশাসনে যত অপকর্ম সবই শেখ হাসিনা করেছেন। কারণ তিনি নিয়ম শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন, যোগ্য মানুষকে বঞ্চিত করেছেন এমন মন্তব্য করে ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, আমাদের অন্যায়ভাবে পদোন্নতি বঞ্চিত করা হয়েছে। বর্তমানে রাষ্ট্রপতি সবকিছুর অভিভাবক। প্রশাসনে পদোন্নতিতে লেখা থাকে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে। সুতরাং প্রশাসনে প্রথম একক ব্যক্তি হিসেবে সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান’কে তিন মাসের মধ্যে সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে পদোন্নতি দিয়ে সচিব বানানো হয়েছে। সর্বশেষ প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে ইকোনমিক ক্যাডার একীভূত করার সময়েও তিন দিনের মধ্যেই বহু কর্মকর্তার পদোন্নতি দেওয়া হয়। বর্তমানে ১৫তম ব্যাচের সিনিয়র সহকারী সচিব যারা আছেন, তারা কিছুদিনের মধ্যেই অবসরে যাবেন, তাদের অন্যায়ভাবে পদোন্নতি বঞ্চিত করা হয়েছে, দ্রুত পদোন্নতি দেয়ার দাবি জানাবেন তারা।
গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। ওই সময়কার আওয়ামী লীগের আশীর্বাদপুষ্ট কর্মকর্তা ও দুর্নীতিবাজদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। চুক্তিভিত্তিক সব নিয়োগ বাতিল করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন শীর্ষ পদে দলীয় হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের পদত্যাগের হিড়িক পড়েছে। গত বুধবার পদত্যাগ করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রোভিসি ও প্রক্টর। পদত্যাগ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিও। কর্মকর্তাদের বিক্ষোভের মুখে বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর-১ কাজী ছাইদুর রহমান পদত্যাগ করেছেন।
সচিবালয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ১০ থেকে ১৫ জন সিনিয়র সচিব ও সচিব এবং বিভিন্ন সংস্থার প্রধান পদে বদলি হতে পারেন বলে কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনা চলছে। সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত অনেক সচিব ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা ঠিকভাবে অফিস করছেন না। অনেকে গা ঢাকা দিয়েছেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবরা রয়েছেন বদলি ও ওএসডি আতঙ্কে। বিশেষ করে সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিবরা তাদের বিদায়ের আশঙ্কা করছেন।
সচিবদের এই অস্থিরতার প্রভাব পড়ছে তাদের অধস্তন কর্মকর্তাদের ওপরও। সামগ্রিকভাবে সরকারি কাজের গতি কমেছে। কাজেকর্মে মন নেই কারও। সচিবরা সাধারণত সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। তাই আতঙ্কে রয়েছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব ও সিনিয়র সচিবরা। এমন অবস্থায় আবারও একাট্টা হচ্ছেন আওয়ামী লীগ আমলে নানাভাবে বঞ্চিত ও নিগৃহীত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তারা সচিবালয়ে সভা ও শোডাউন করছেন।
‘বেআইনিভাবে পদোন্নতি বঞ্চিত প্রশাসন ক্যাডার ব্যতীত বিশেষজ্ঞ ২৫ ক্যাডারের ১৩ থেকে ২২তম ব্যাচের উপসচিব’র দাবি করে বলা হয়েছে, অতি দ্রুত ক্যাডার নির্বিশেষে বৈষম্যহীন মেধাভিত্তিক জনপ্রশাসন গড়ার লক্ষ্যে প্রশাসন ক্যাডার ব্যতীত বিশেষজ্ঞ ২৫ ক্যাডারের বেআইনিভাবে পদোন্নতি বঞ্চিত উপসচিবদের পিএসসির মেধাতালিকা অনুযায়ী স্ব-স্ব ব্যাচের সঙ্গে জ্যেষ্ঠতা নিশ্চিতপূর্বক যুগ্মসচিব পদে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া হোক।
উপসচিবদের পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু হলো সচিবালয়। সচিবালয় অনেকগুলো মন্ত্রণালয়-বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত। এর মধ্যে একটি মন্ত্রণালয় হলো জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ মন্ত্রণালয়ের প্রধান কাজ হলো সরকারের সব মন্ত্রণালয়-বিভাগের জন্য মেধাভিত্তিক দক্ষ জনসম্পদ তৈরি ও ব্যবস্থাপনা। কিন্তু মন্ত্রণালয়টি কার্যত ‘প্রশাসন’ নামক একটি ক্যাডারের স্বার্থরক্ষার মন্ত্রণালয়ে পরিণত হয়েছে। ফলে সরকারের স্বার্থ মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে এর আগে জনপ্রশাসন সিনিয়র সচিব বরাবরে আবেদন করে এসএসবির সব সদস্য এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুলিপি দেওয়া সত্ত্বেও কোনো প্রতিকার মেলেনি দাবি তাদের। এতে বলা হয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এসএসবির সুপারিশের ভিত্তিতে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-বিভাগে সুপিরিয়র জনবল নিয়োগ ও পদায়ন করে থাকে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবের সাচিবিক দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
অন্য সদস্যরা হলেন- প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব, অর্থসচিব, জননিরাপত্তা সচিব, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক সচিব এবং কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল। তাদের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে সরকারের উপ-সচিব ও তদূর্ধ্ব পদের জনবল। সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি-বিধান অনুসরণ করে কর্মকর্তাদের মেধা, জ্যেষ্ঠতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতির সুপারিশ করা তাদের একমাত্র কাজ।
পদোন্নতির জন্য তাদের সামনে থাকতে হবে কর্মকর্তাদের জ্যেষ্ঠতার তালিকা, তাদের সার্ভিস রেকর্ড এবং সংশ্লিষ্ট আইন-কানুন। প্রত্যেক ক্যাডারের আলাদা আলাদা জ্যেষ্ঠতার তালিকা থাকলেও যখন উপসচিব হিসেবে পুল সৃষ্টি হয়, তখন তাদের জন্য অনুসরণীয় একমাত্র জ্যেষ্ঠতার তালিকা হলো পিএসসি থেকে নির্ধারিত মেধাতালিকা। কিছু এসএসবি সেই তালিকা অনুসরণ করে না বরং প্রশাসন ক্যাডারকে ভিত্তি ধরে পদোন্নতি দিয়ে থাকে। এর ফলে শুধু প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই যথাসময়ে পদোন্নতি পেয়ে থাকেন। অর্থাৎ এই এসএসবি শুধু একটি ক্যাডারকে প্রমোট করার বোর্ড হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। বিষয়টি ন্যক্কারজনক।
মন্ত্রণালয়ের পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মচারীদের সভাপতি এবিএম আলামিন বলেন, আমরা চাই আজকালের মধ্যেই আমাদের পদোন্নতি দিতে হবে। আওয়ামী সরকারের আমলে অনেকে আমাদের পরে যোগদান করেও তারা আমাদের আগে পদোন্নতি পেয়েছেন। অনেকেই পরে যোগদান করে জ্যেষ্ঠতার তালিকার আগে স্থান পেয়েছেন। এতদিন আমাদের সঙ্গে বৈষম্য করা হয়েছে।
প্রশাসন ক্যাডারে ২২তম ব্যাচের বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের উপ-পরিচালক মু. বিল্লাল হোসেন আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, মেধার কোটা থাকা সত্ত্বেও সদ্য বিদায়ী অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকার আমাদের পদোন্নতি দেয়নি।
বিসিএস ক্যাডার হিসেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বারান্দায় এলেও সম্মান দেওয়া হয়নি। বিভিন্নভাবে অসম্মান করা হয়েছিল। সেজন্য অবৈধ সরকারের আমলে জনকল্যাণ স্বার্থ ছাড়া যেসব আদেশ দেয়া হয়েছে, সেগুলো বাতিলের দাবি জানানো হবে। তিনি আরো বলেন, আমরা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা দেখিনি; কিন্তু ২০২৪ সালের স্বাধীনতা দেখেছি। অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকারের বিচার দাবি করছি। যারা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন, তারা যেন সঠিক বিচার পান সেই লক্ষ্যে কাজ করব।