ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জিয়াউল আহসানের রিমান্ড

ইন্টারনেট বন্ধের নেপথ্যের কারিগর
জিয়াউল আহসানের রিমান্ড

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ধাপে ধাপে তাদের সব ধরনের অপকর্ম প্রকাশ্যে আসছে। যেসব কর্মকর্তাদের ক্ষমতার দাপটে মানুষ তটস্থ ছিলেন, আজ তারাই অনিয়ম ও হত্যার দায়ে আদালতের বারান্দায়। ন্যায়-অন্যায়ের বিচারের চেয়ে আওয়ামী লীগের আশীর্বাদপুষ্ট কর্মকর্তারা স্বৈরাচারী মনোভাবে বেড়ে উঠেন। তবে সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় দোকান কর্মচারী শাহজাহান আলীকে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানের আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত গতকাল শুক্রবার এ আদেশ দেন।

ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান কল রেকর্ড ফাঁস করে তা ভাইরাল করে দেওয়া ও ছাত্র আন্দোলনের সময় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধের নেপথ্যে ছিলেন। গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

জিয়াউল আহসানের আইনজীবী নাজমুন নাহার আদালতকে বলেন, তার মক্কেল কখনো ডিজিএফআইয়ে কর্মরত ছিলেন না। তিনি ‘আয়নাঘর’ (গোপন বন্দিশালা) বানাননি। ফেসবুকে তাকে নিয়ে মিডিয়া ট্রায়াল করা হচ্ছে। গত ৭ আগস্ট বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়।

অপরদিকে বাদীপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ উল্লাহ খান আদালতকে বলেন, এই জিয়াউল আহসান গুম-খুনের নায়ক। তিনি ‘জেনোসাইড’-এর সঙ্গে যুক্ত। আয়নাঘরের জনকও তিনি। দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার ক্রীড়নক হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত। সদ্য সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা ২০১২ সালের পর থেকে এক যুগ ধরে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাবলম্বীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে অপহরণ ও গুমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

জিয়াউল আহসান আদালতকে বলেছেন, ‘গত ৭ আগস্ট রাতে ডিজিএফআইয়ের একটি দল আমাকে বাসা থেকে নিয়ে আসে। এরপর আট দিন ধরে গতকাল রাত পর্যন্ত আমাকে আয়নাঘরে রাখা হয়েছিল। আমি কোনো গুম-খুনের সঙ্গে জড়িত না। আমি নির্দোষ, ন্যায়বিচার চাই।’ গতকাল শুক্রবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আরফাতুল রাকিবের আদালতে রিমান্ড শুনানিতে জিয়াউল আহসান এসব কথা বলেন।

রিমান্ড শুনানি চলাকালীন আদালতের অনুমতি নিয়ে তিনি বলেন, ‘যেসব ব্যক্তি আয়নাঘর থেকে বের হয়ে আসছে, তাদের কেউ বলুক আমি তাদের সেখানে রেখেছি। যেভাবে আমাকে নিয়ে দোষারোপ করা হচ্ছে, সেটা সঠিক নয়। আমি অসুস্থ। আমার হার্টে ৭৫ শতাংশ ব্লক ধরা পড়েছে। এ ছাড়া শারীরিক অন্যান্য সমস্যাও রয়েছে।’

প্যাগাসাস সফটওয়্যারের বিষয়ে আদালত জানতে চাইলে জিয়াউল আহসান বলেন, ‘প্যাগাসাস বলে কিছু নেই। আমি মোবাইল ট্র্যাকিং করিনি। আমি নির্দোষ।’

এর আগে জিয়াউল আহসানকে আদালতে হাজির করে ১০ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার আবেদন করে পুলিশ। অন্যদিকে জিয়াউল আহসানের আইনজীবী রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রে জানা গেছে, চাকরি থেকে অব্যাহতি পাওয়া জিয়াউল আহসান ২০২২ সাল থেকে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এনটিএমসির দায়িত্বে থাকাকালীন একের পর এক কল রেকর্ড ফাঁস করেন তিনি। রাজনৈতিক ব্যক্তি থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য হুমকি এমন সব ব্যক্তির স্পর্শকাতর কল রেকর্ড জিয়াউল আহসানের নির্দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন প্লাটফর্মে ছড়িয়ে দেওয়া হতো।

সূত্রে জানা গেছে, জিয়াউল আহসান এনটিএমসির দায়িত্বে থাকাকালীন সংস্থাটির আড়িপাতার সক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা হয়। এই সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে জিয়াউলের নির্দেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মোবাইল ফোনের আড়িপাতা হতো। এরপর ওইসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কল রেকর্ড সংগ্রহ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হতো। এসব কল রেকর্ডের উপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে অনেক সুশীল সমাজের লোকজনকে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করা হতো।

আরো জানা যায়, এনটিএমসি মোবাইল ফোনের ভয়েস ও এসএমএস, ল্যান্ডফোন ভয়েস এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আড়িপাততে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মধ্যে ফেসবুক, টুইটার (বর্তমানে এক্স), টেলিগ্রাম, ভাইবার, ইমো, স্কাইপি অ্যাপেও আড়িপাততে পারে এনটিএমসি। অনলাইন যোগাযোগমাধ্যমের মধ্যে ওয়েবসাইট ব্লগ, ই-মেইলেও শতভাগ আড়িপাতার সক্ষমতা রয়েছে সংস্থাটির। এসব সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে দিনের পর দিন অন্যায়ভাবে মানুষের কল রেকর্ড ফাঁস করা হয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় যতবার ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করা হয়েছিল তা জিয়াউল আহসানের নির্দেশে বন্ধ করা হয়।

ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলার সময় গত ১৭ জুলাই রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট ও ১৮ জুলাই রাত ৯টার দিকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায় জিয়াউল আহসানের নির্দেশে। টানা পাঁচদিন সব ধরনের ইন্টারনেট বন্ধ ছিল। মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ ছিল ১০ দিন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপের মতো সেবা বন্ধ ছিল ১৩ দিন।

সূত্র জানায়, ১৭ জুলাই থেকে ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশনাগুলো মূলত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা সংস্থা এনটিএমসি থেকেই আসতে থাকে। এছাড়া জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে অসংখ্য ব্যক্তিকে গুম করার অভিযোগও রয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর দিন ৬ আগস্ট জিয়াউল আহসানকে সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তিনি র‍্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালকও ছিলেন।

নিউমার্কেট থানার একটি হত্যা মামলায় বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকা থেকে জিয়াউল আহসানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মহা. আশরাফুজ্জামান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। নিউমার্কেট থানায় দায়ের করা দোকান কর্মচারী হত্যা মামলায় (৮ নম্বর মামলা) তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

উল্লেখ্য, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরপর গত মঙ্গলবার মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা জানায় আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত