ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সাজিদের আত্মত্যাগ দেশের মানুষ ভুলবে না

বললেন তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা
সাজিদের আত্মত্যাগ দেশের মানুষ ভুলবে না

টাঙ্গাইল থেকে ৬০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ধনবাড়ী উপজেলার বিলকুকরী গ্রাম। সবুজে ঘেরা অনুপম সৌন্দর্য ঘিরে রেখেছে গ্রামটিকে। এ গ্রামেই জন্ম রাজধানীর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী ইকরামুল হক সাজিদের। তার বাবা বিমানবাহিনীর মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার (অব.) জিয়াউল হক। ইকরামুল হক সাজিদ কোটাবিরোধী আন্দোলনের প্রথম সারির যোদ্ধাদের একজন। কোটাবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে ৪ আগস্ট ঢাকার মিরপুরের ১০ নম্বর এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন তিনি। সাজিদের মাথার পেছনে গুলি লেগে ডান চোখ দিয়ে বের হয়ে যায়। ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ১০ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জালড়ে পরাজিত হন তিনি। গত বুধবার মৃত্যুর কাছে হেরে যান সাজিদ।

গত বৃহস্পতিবার সকালে গ্রামের বাড়ি বিলকুকরীতে সাজিদের লাশ দাফন করা হয়েছে। এর আগে বাঐজান স্কুল মাঠে তার তৃতীয় জানাজা হয়। এতে ডাক, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মো. কায়ছারুল ইসলাম, পুলিশ সুপার গোলাম সবুর, ধনবাড়ী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আ. ওয়াদুদ তালুকদার (সবুজ), উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান, ঢাকা থেকে আসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, টাঙ্গাইলের মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাসহ ধনবাড়ী উপজেলার বিভিন্ন স্তরের মানুষ এবং সাজিদের আত্মীয়-স্বজনরা জানাজা নামাজে অংশ নেন। পরে ওই গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

ডাক, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম নিহতের বাড়িতে গিয়ে স্বজনদের সমবেদনা জানান। এ সময় তিনি বলেন, আজকে সাজিদদের এই আত্মত্যাগের কারণে আমরা নতুন স্বাধীনতা পেয়েছি। তাঁর আত্মত্যাগ দেশের মানুষ, ছাত্রসমাজ কোনো দিন ভুলবে না। খুনিদের বিচার এই বাংলার মাটিতে অবশ্যই করা হবে। অবশ্যই তাদের কঠোরতম শাস্তির আওতায় আনবই।’

নিহত সাজিদের বাবা জিয়াউল হক বিমানবাহিনীর চাকরি থেকে অবসরের পর ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তিনি বলেন, ‘সাজিদ বলেছিল, কয়েক মাস পর স্নাতকোত্তর ডিগ্রিটা হয়ে যাবে। তারপর চাকরি হলেই আমাকে আর কিছু করতে দেবে না। বাবাকে বিশ্রাম দিয়ে পুরো সংসারের দায়িত্ব নেবে। সেই সাজিদ চিরবিশ্রামে চলে গেল।’

জিয়াউল হক আরও বলেন, ‘পড়াশোনার পাশাপাশি সাজিদ ঢাকায় টিউশনি করত। গ্রামের সব আত্মীয়স্বজনকে একদিন নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতে চেয়েছিল। ওর কথামতো স্বজনদের তালিকাও করেছিলাম; কিন্তু আর খাওয়ানো হলো না।’

সাজিদের মামা আব্দুর রাজ্জাক জানান, সাজিদ ঢাকায় বেড়ে উঠলেও গ্রামের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। বাড়িতে এলেই সবার সঙ্গে সময় কাটাত। সর্বশেষ মাসখানেক আগে সাজিদ বাড়িতে এসেছিল।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে সাজিদদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সামনে তার কবর জাতীয় পতাকায় ঢাকা রয়েছে। বাড়ির একটি কক্ষে বিলাপ করছেন তার মা লিপি বেগম। স্বজনরা তাকে সান্ত¡না দিচ্ছেন। কিন্তু কোনো সান্তনাই তাকে শান্ত করতে পারছিল না। তিনি চিৎকার করে বলছিলেন, ‘আমার সাজিদের নাম মিশা গেল গো..., আমি দুনিয়ায় কেমনে বাঁচমু গো...। আমারে আর কেউ মা বইলা ডাকব না গো...। মাথায় হাত বুলাইয়া আদর করব না গো...।’

সাজিদের ভগ্নিপতি অর্ক ফুয়াদ জানান, সাজিদের জন্ম ১৯৯৯ সালের ১ মার্চ। তিনি ঢাকার বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে ২০১৬ সালে এসএসসি, ২০১৮ সালে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে ভর্তি হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে।

সাজিদের বড় বোন ফারজানা হক (৩০) জানান, শুরু থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সাজিদ ছিলেন সক্রিয়। এ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর প্রতিটি কর্মসূচিতে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। ৪ আগস্ট ঢাকার অবস্থা ছিল উত্তাল। তাই বাসা থেকে বের হতে বাধা দিতে চেয়েছিলেন তাঁর মা। কিন্তু সাজিদ বাধা মানবেন না জানতেন তাঁরা। তাই বাধা না দিয়ে মা গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, সাবধানে থাকতে। ৪ আগস্ট বেলা আড়াইটার দিকে সাজিদ কাফরুলের বাসা থেকে বের হয়ে যান। যাওয়ার পর মা ও বোনের সঙ্গে কয়েকবার কথা হয়। এদিন সন্ধ্যা সাতটার দিকে তার বন্ধুরা জানান, সাজিদ গুলিবিদ্ধ হয়ে সিএমএইচে আছেন। পরিবারের লোকজন সেখানে গিয়ে দেখতে পান, সাজিদ অজ্ঞান অবস্থায় রয়েছেন। মাথার পেছন দিয়ে গুলি লেগে ডান চোখ ভেদ করে বের হয়ে গেছে। ওই রাতেই তার অস্ত্রোপচার হয়। তারপর ১০ দিনেও জ্ঞান ফেরেনি। বুধবার (১৪ আগস্ট) দুপুরে মারা যান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রথম সারির যোদ্ধা ইকরামুল হক সাজিদ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত