ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা

দেশ-বিদেশের সমর্থন পেতে ষড়যন্ত্র করেছিলেন শেখ হাসিনা?

দেশ-বিদেশের সমর্থন পেতে ষড়যন্ত্র করেছিলেন শেখ হাসিনা?

২০০৪ সালের একুশে আগস্টে ঢাকায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার এক সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় ২৪ জনের মৃত্যু হয়। আর এমন হামলার নীলনকশা করেছিলেন শেখ হাসিনা। দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা করে নিজেই নিজের সমাবেশে হামলা চালানোর মতো কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন। ওই সমাবেশে শেখ হাসিনা গ্রেনেড হামলার নীলনকশা এমনভাবে সাজিয়েছিলেন যেখানে তিনি নিজেকে সুরক্ষা রেখে দলীয় (আওয়ামী লীগ) নেতাকর্মীদের মৃত্যুর ফাঁদে রাখেন। আর সেই মৃত্যুর ফাঁদের অপবাদ তৎকালীন সরকার বিএনপির উপরে চাপানোর কৌশলী হিসেবে ব্যবহার করেন শেখ হাসিনা। দেশ-বিদেশের সমর্থন পেতে এমন ষড়যন্ত্র করেন আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনা। এমনটি মনে করছেন বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা।

এ বিষয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, শেখ হাসিনা সেই নেত্রী যিনি চট্টগ্রামে সমাবেশে প্রকাশ্যে বলেছিলেন- আওয়ামী লীগের নেতারা কী শাড়ি চুড়ি পরে বসে থাকে, একটা লাশ পড়লে দশটা লাশ পড়বে। এছাড়াও শেখ হাসিনার অডিও কল ভাইরাল হয়েছিল- তিনি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বলেছিলেন মানুষ মেরে ফেলার জন্য। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পদ্মায় চুবানি দিয়ে মারতে চেয়েছিলেন। হত্যার রাজনীতি শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পক্ষে মানানসই।

তিনি আরো বলেন, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা বিএনপির আমলে ঘটায় দায়টা আমাদের দিকেই আসে। আওয়ামী লীগ গ্রেনেড হামলার দায় বিএনপিকে দিতেই পারে। তবে বিএনপি সরকার গ্রেনেড হামলার ঘটনা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করার চেষ্টা করেছে। ওই সময়ে আমি এমপি হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য ছিলাম। আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) মাধ্যমেও ঘটনার তদন্ত করেছি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেছেন এ ব্যাপারে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব বলেন, দেশে লাখ লাখ কর্মীকে বিপদে ফেলে ডুব সাঁতার দেয়ার মতো করে পালিয়ে গেছেন শেখ হাসিনা। তারপক্ষেই গ্রেনেড হামলার মতো ঘটনা ঘটনানো অস্বাভাবিক কিছু নয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার জন্য শেখ হাসিনা গ্রেডেন হামলার নীলনকশা তৈরি করেছিলেন।

২০২৪ সালে এসেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলন ঘিরে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে নিজে ও নিজের পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষায় দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে অবস্থান নিয়েছেন। ভোট কারচুপির মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচন নামমাত্র দিয়ে প্রায় ১৫ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলেন শেখ হাসিনা। স্বৈরশাসকের ভূমিকায় অবতীর্ন হন। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ৫ আগস্ট ভারতে চলে যান। এবারো তিনি মাঠপর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অবস্থার কথা বিন্দুমাত্র চিন্তা করেননি। এভাবেই শেখ হাসিনা বারবার নিজ দলের নেতাকর্মীদের বিপদে ফেলেছেন।

গ্রেনেড হামলার জন্য আওয়ামী লীগ বিএনপি এবং তাদের মিত্রদের দায়ী করে আসলেও বিএনপির পক্ষ থেকে বরাবরই ওই হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ নাকচ করে দেয়া হয়েছে। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, একুশ বছর হলেও একুশে আগস্টের ঘটনা এখনো রাজনৈতিকভাবে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে একটি বড় ইস্যু হয়ে রয়েছে। এটা নিয়ে রাজনীতিটা হচ্ছে। বিএনপি এ ঘটনায় বেশ ব্যাক-ফুটে চলে যায়। একসময় তারা বলতো, দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য আওয়ামী লীগ নিজেরাই এটা সাজিয়েছে। আমি যতটা বুঝি, দল হিসাবে বিএনপি এ ঘটনায় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাকে ‘জঘন্য ও নিন্দনীয়’ বলে মনে করে বিএনপি। তবে এর তদন্ত ও বিচার নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার রাজনীতি করেছে। সম্পূরক চার্জশিট দিয়ে তারেক রহমানকে আসামি করা হয়েছে। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আসামি করেছে। ফলে সত্যিকারের ঘটনা জাতি আজও জানতে পারেনি।

২০০৪ সালে ২১ আগস্ট ঢাকায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সমাবেশ হচ্ছিলো আওয়ামী লীগের উদ্যোগে। সমাবেশের প্রায় শেষ পর্যায়ে তাতে বক্তব্য রাখছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। একটি ট্রাকের ওপর তৈরি অস্থায়ী মঞ্চে তিনি বক্তব্য দেবার সময় তাকে ঘিরে ছিলেন দলীয় নেতারা। আর সামনের দিক থেকে তার ছবি তুলছিলো অনেক ফটো সাংবাদিক। বক্তব্যের প্রায় শেষ পর্যায়ে প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ হয়। ঘটনাস্থলে ছবি তুলছিলেন ফটো সাংবাদিক জিয়াউল ইসলাম। তিনি বলেছিলেন, এমন নৃশংসতা কখনো হতে পারে আমার কল্পনাতেও ছিলো না। আমি মঞ্চেই ছিলাম। চেয়ারে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলাম। হঠাৎ প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। প্রচণ্ড হুড়োহুড়ি আর ধাক্কায় চেয়ার থেকে নীচে পড়ে যাই। আমার উপর পড়ে অনেকে। হঠাৎ ট্রাকের পাটাতনের ফাঁকে চোখে পড়লো আস্ত গ্রেনেড। সেটি বিস্ফোরিত হলে কি হতো ভাবতেও শিউরে উঠি এখনো। শেখ হাসিনা কয়েক হাত দূরে। তাকে ঘিরে মানববর্ম তৈরি করেন তার দলের নেতারা। গ্রেনেডের শব্দ শেষে শুরু হলো গুলির শব্দ। এক পর্যায়ে উঠে দাঁড়াই এবং গুলি থামলে ট্রাক থেকে নেমে আসি। নামার পর যা দেখি সেটি আরেক বিভীষিকা। চারিদিকে আর্তনাদ, গোঙ্গানি। রক্তাক্ত পড়ে আছে বহু নারী পুরুষ। কে জীবিত কে মৃত বোঝা মুশকিল। নিজে বেঁচে আছি বুঝতে পেরে আবার ক্যামেরার শাটারে ক্লিক করতে আরম্ভ করি।

সেদিনের সেই গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং কয়েকশ’ আহত হন। গ্রেনেড হামলার ঘটনার পরদিন মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মামলা করেন। এ মামলাটির প্রথমে তদন্ত শুরু করে থানা পুলিশ। পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ হয়ে তদন্তের দায়িত্ব পরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাতে। অবশ্য এর মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল জলিল ও সাবের হোসেন চৌধুরী আরো দুটি মামলা করেছিলেন। পরে এসব মামলা বিশেষ ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়।

২০০৪ সালের ২২ আগস্ট বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনকে চেয়ারম্যান করে এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে সরকার। মাত্র এক মাস ১০ দিনের মাথায় ওই বছরের ২ অক্টোবর কমিশন সরকারের কাছে ১৬২ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, কমিশনের সংগৃহীত তথ্য-প্রমাণ সন্দেহাতীতভাবে ইঙ্গিত করে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পেছনে একটি শক্তিশালী বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত ছিল। অভিযানটি পরিচালনা করা হয়েছিল ভাড়া করা দুর্বৃত্তদের মাধ্যমে। এসব লোক প্রধানত একটি সংগঠনের সশস্ত্র ক্যাডারদের মধ্য থেকে নেয়া হয়, যাদের সমাবেশে ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়ার মতো ভালো জ্ঞান ছিল। যদিও ওই প্রতিবেদনে বিদেশি শক্তি বলতে কোনো দেশের নাম বলা হয়নি। গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। সেদিন বিশেষ নিরাপত্তার মধ্যে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা-সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আকন্দ স্বাক্ষরিত চার্জশিটটি দাখিল করেন এসআই গোলাম মাওলা। দুটি পৃথক ট্রাঙ্কে ভর্তি করে আনা চার্জশিটে নতুন করে ৩০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এর আগের চার্জশিটে ২২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। ষড়যন্ত্র করে বিএনপি নেতা তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে অভিযুক্ত করা হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত