ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বন্যাক্রান্ত লাখো মানুষ

ভারত থেকে হু হু করে আসছে পানি
বন্যাক্রান্ত লাখো মানুষ

ভারতের উজানের পানির প্রবল স্রোতের সঙ্গে সাগরে সৃষ্ট লঘুচাপে টানা ভারী বৃষ্টিতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় লাখো মানুষ। সীমান্তবর্তী নদীবেষ্টিত মৌলভীবাজার জেলার পাঁচটি নদ-নদীতে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুশিয়ারা নদী, মনু, ধলাই ও জুড়ী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। এতে নদ-নদী ভাঙনে প্লাবিত হয়েছে অর্ধশত গ্রাম। মৌলভীবাজার সদর, রাজনগর, কমলগঞ্জ ও কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা, ফেনীর পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যার পানি বাড়তে থাকায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। নৌকার অভাব এবং পানির তীব্র স্রোতের কারণে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করা যাচ্ছে না। এতে মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে মানুষ।

চলমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সচিবালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কেএম আলী রেজা বলেছেন, দেশের মধ্যে ভারী বৃষ্টি এবং উজান থেকে নেমে আসা ঢলে দেশের আট জেলা বন্যাকবলিত হয়েছে। বন্যা আরো নতুন নতুন অঞ্চলে বিস্তৃত হতে পারে।

তিনি আরো বলেন, দেশের সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ফেনী, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও খাগড়াছড়ি জেলা বন্যাকবলিত হয়েছে।

গতকাল বুধবার নিয়মিত বুলেটিনে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড মৌলভীবাজার জানায়, সাগরের লঘুচাপের প্রভাব ও ভারতের অতিবৃষ্টির ঢলে পানি বেড়েছে।

জেলার জুড়ী নদে বিপৎসীমার প্রায় ১৭৪ সেন্টিমিটার উপর, ধলাই নদে বিপৎসীমার ৮ সেমি. ও মনু নদীর চাঁদনীঘাটে ৭০ সেমি. ও রেলওয়ে ব্রিজে ১০৫ সেমি. এবং মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার ৮৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এছাড়াও মৌলভীবাজার শেরপুর পয়েন্টে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমা স্পর্শ করেছে। এদিকে তিন দিনের টানা ভারী বৃষ্টিতে হাওর ও নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে বাড়িঘর প্লাবিত হচ্ছে।

মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাবেদ ইকবাল বলেন, ভয়ানকভাবে পানি বাড়ছে। নদ-নদীর বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। আমরা জিও ব্যাগ ফেলেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। নদ-নদী বেশ কয়েকটি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। কুলাউড়া উপজেলা টিলাগাঁও এলাকায় মনু নদে ভাঙন দেখা দিয়েছে তারপর রাজনগর এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। নদ-নদীর বাঁধ উপচে পানি প্রবাহিত হওয়ার কারণে কতটি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে তা নির্ধারণ করা যাচ্ছে না।

পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দেড় মাসের ব্যবধানে তৃতীয় দফায় ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে ফেনীর পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলার লাখ লাখ মানুষ। গত কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টি ও ভারতের উজানের পানিতে গত মঙ্গলবার থেকে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভাঙনের স্থান দিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করতে শুরু করে। এতে তিন উপজেলার রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও মাছের ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে। লোকালয়ে পানি ঢুকে শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়ক ও উপজেলার অভ্যন্তরীণ সড়কে বন্ধ রয়েছে যান চলাচল। লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বিদ্যুৎ সংযোগ।

পরশুরামের সলিয়া এলাকার বাসিন্দা মোশাররফ হোসেন বলেন, আমাদের ত্রাণের চেয়েও এখন নৌকা বা স্পিডবোট বেশি প্রয়োজন। বন্যা পরিস্থিতি এমন হবে কেউ বুঝতে পারেনি। অনেকে রাত থেকে উদ্ধার করতে আসতেছে বললেও তেমন কাউকে দেখা যায়নি। সোমবার রাত থেকে বিদ্যুৎ নেই। বন্যার সঙ্গে বিদ্যুৎ, মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় অনেক বেশি ভোগান্তি দেখা দিয়েছে। ফুলগাজীর উত্তর দৌলতপুর এলাকার বাসিন্দা শাহেদ হোসেন বলেন, গতকাল রাত ৩টার দিকে আকস্মিক বন্যায় বুক সমান পানি দিয়ে ছোট সন্তানকে মাথায় নিয়ে পরিবারসহ অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। চারিদিকে পানি থইথই। ঘরবাড়ি সব ডুবে গেছে। জিনিসপত্র কোনো কিছুই বের করতে পারিনি।

এ বিষয়ে ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আবুল কাশেম বলেন, নদীর পানি বিপৎসীমার ৮৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

এদিকে ভয়াবহ এই বন্যায় বানভাসি মানুষদের উদ্ধারে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। জানা গেছে, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যাকবলিত এলাকায় আটকেপড়া মানুষদের উদ্ধার করতে সেনাবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের সহযোগিতা চাওয়া হয়। এরপর স্পিডবোট নিয়ে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করে তারা। একইসঙ্গে বিজিবি সদস্য ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক পরিবারের শত শত স্বেচ্ছাসেবক উদ্ধার ও খাদ্য সহায়তা প্রদান করছেন। আইএসপিআরের পক্ষ থেকে বার্তা দিয়ে জানানো হয়, ফেনী জেলার পরশুরাম ও ফুলগাজীতে বন্যার্তদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। উদ্ধার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে স্পিড বোট ও হেলিকপ্টার।

বন্যাকবলিত পরশুরাম উপজেলার সাতকুচিয়া এলাকার বয়োবৃদ্ধ আবদুর রহমান বলেন, বিগত জীবনে এমন ভয়াবহ বন্যা কখনো দেখিনি। সময় বাড়ার সঙ্গে বন্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। টানা বৃষ্টি পড়তে থাকায় পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে।

রাসেল নামে এক স্বেচ্ছাসেবক বলেন, দেশের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে সহায়তা নিয়ে আসছে। কিন্তু পানির তীব্র স্রোতের কারণে পরশুরামে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও আমাদের সদস্যরা বিভিন্ন পয়েন্টে কাজ করার চেষ্টা করছে। টানা বৃষ্টিতে চারিদিকে পানি থইথই।

ফেনী আবহাওয়া অধিদপ্তরের উচ্চ পর্যবেক্ষক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, ফেনীতে টানা তিন দিন মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। জেলায় গতকাল বুধবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আগামী ৭২ ঘণ্টা বৃষ্টি অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

এ ব্যাপারে ফেনী জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার বলেন, বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী স্পিডবোট নিয়ে কাজ শুরু করেছে।

ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে রাঙামাটির সাজেক সড়কের বাঘাইহাট বাজার, মাচালং ও কবাখালি অংশ ডুবে গেছে। এতে যান চলাচল বন্ধ থাকায় সাজেক ভ্রমণে আসা পর্যটকরা আটকে পড়েছেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত