ঢাকা ১০ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন

আয়নাঘর সম্পর্কে পরিপূর্ণ তথ্য প্রকাশের দাবি

আয়নাঘর সম্পর্কে পরিপূর্ণ তথ্য প্রকাশের দাবি

গত ২১ আগস্ট The Daily Star পত্রিকায় প্রকাশিত ‘Inside the Aynaghar’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদ এবং একই বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নজরে এসেছে। এ বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গভীর শঙ্কা প্রকাশপূর্বক স্বতঃপ্রণোদিত অভিযোগ (সুয়োমটো) গ্রহণ করেছে এবং আয়নাঘর সম্পর্কে পরিপূর্ণ তথ্য প্রকাশের দাবি জানিয়েছে। উক্ত সুয়োমটোতে আয়নাঘরের বাস্তব অবস্থা, এর পরিচালনাকারী, অন্তরীণ ব্যক্তিবর্গের পরিচয়, সংখ্যা, কোন আইনবলে তাদের অন্তরীণ করা হয় ও সেল তৈরির নেপথ্যে কারা ছিল সে বিষয়ে পরিপূর্ণ বিবরণ কমিশনে প্রেরণের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে কমিশনের মাননীয় চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ স্বাক্ষরিত সুয়োমটোর বিষয়বস্তু নিচে উল্লেখ করা হলো। প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদনের বরাতে গৃহীত সুয়োমটোতে উল্লেখ করা হয় যে, গত দেড় দশক ধরে গুম করা ব্যক্তিদের ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত বন্দিশালায় অমানবিক অবস্থায় রাখা হতো। তাদের মধ্যে ফিরে আসা ব্যক্তিরা এখন নির্মমতার বর্ণনা দিচ্ছেন। ডেইলি স্টারের প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, ভুক্তভোগীদের বর্ণনা একত্রিত করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এর মধ্যে অনেকগুলো প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তর (ডিজিএফআই) পরিচালিত ছিল। এই জায়গাগুলো বাইরের পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এখানে বন্দিরা বাইরের কোনো আলো দেখতে পান না। বিগত সরকারের শাসনামলে আয়নাঘরে দিন, মাস, এমনকি বছরের পর বছর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন সহ্য করেছেন এমন বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভিত্তিক ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) নেতা মাইকেল চাকমা তাদের একজন। ‘২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে পাঁচ বছর বন্দি ছিলেন তিনি। গণঅভ্যুত্থানের মুখে হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার মাত্র দুদিন পর মাইকেল মুক্তি পান। ভিয়েতনামে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান ২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর নিখোঁজ হন। প্রায় ১৬ মাস (৪৬৭ দিন) পর ২০১৯ সালের মার্চে বাড়ি ফেরেন’। দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, অপহরণকারীরা কীভাবে তাকে সরকার বিরোধী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছিল। তার বিবরণে স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, অপহরণকারীরা সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি কিছু শব্দ লেখা দেখেছিলেন- যেমন: পানির বোতলগুলোতে ‘সেনা (সেনাবাহিনী); ওষুধের পাতায় ডিফেন্স মেডিসিন, বিক্রয় নিষিদ্ধ; এবং বন্দি অবস্থায় তাকে যে কুরআন দেয়া হয়েছিল, সেটি ছিল স্টেশন হেডকোয়ার্টার লাইব্রেরি এবং সেনাবাহিনী লাইব্রেরির।

আয়নাঘরে গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি কামরুজ্জামান ও সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মাহমুদ হাসানকেও নেয়া হয়েছিল। ২০২২ সালে আয়নাঘরে তাদের বন্দিদশা ছিল অল্প সময়ের-মাত্র সাত দিন। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরোধের কারণেই তাদের গোপন কারাবরণ বলে তারা উল্লেখ করেন। তারা দুজনই বলেছেন, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে তাদের বাধ্য করা হয়েছে। তাদের আরো বাধ্য করা হয়, তারা যেন দাবি করেন, টাকার বিনিময়ে গ্রামীণ টেলিকম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গোপনে একমত হওয়ার পরে নোবেল বিজয়ী তার বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারে শ্রমিকদের বাধ্য করেছেন। সরকার ২০২২ সালের ১২ মে জাতিসংঘকে লিখেছিল, ‘কথিত গুমের মামলাগুলো তদন্ত করার পরে অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে মানুষ প্রায়শই তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা থেকে বাঁচতে স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে চলে যায়। কখনো কখনো তারা পারিবারিক কলহের কারণে বা ব্যবসায়িক দায় এড়াতে আত্মগোপনের পথ বেছে নেয় এবং কেউ কেউ সরকারকে বিব্রত করার উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করে।’ তবে শেখ হাসিনার পতনের পরদিন ৬ আগস্ট সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী ও মীর আহমাদ বিন কাসেমকে মুক্তি দেয়ার পর থেকে এই মিথ্যা প্রকাশ্যে চলে আসে। আব্দুল্লাহিল আমান আযমী জামায়াতের সাবেক আমির প্রয়াত গোলাম আযমের ছেলে। মীর আহমাদ বিন কাসেম ফাঁসি কার্যকর হওয়া জামায়াত নেতা মীর কাসেমের ছেলে। আয়নাঘরে তাদের আট বছর আটকে রাখা হয়।

২০২১ সালের প্রতিবেদনে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, ‘২০০৯ সালে হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে নিরাপত্তা বাহিনী ৬০০ জনেরও বেশি মানুষকে গুম করেছে’। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুম করা ব্যক্তিদের মধ্যে কিছু মানুষকে পরে মুক্তি দেয়া হয়েছে, আদালতে হাজির করা হয়েছে কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও অন্তত ১০০ জন এখনো নিখোঁজ।

বিগত সরকার পতনের পরের দিন থেকে নিখোঁজ ব্যক্তিদের অনেকেই পরিবারের কাছে ফিরে আসা শুরু করলে বিগত দেড় দশক ধরে সরকার কর্তৃক গুমের সত্যতা প্রকাশ পায় এবং প্রকৃত চিত্র জন সমক্ষে আসে। র্দীঘদিন ধরে আয়নাঘরে অবস্থানরত নিখোঁজ ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার থেকে যে ভয়ঙ্কর চিত্র ফুটে উঠেছে তা অত্যন্ত নির্মম ও অমানবিক। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আয়নাঘর নামক যে গোপন নির্যাতন সেলের তথ্য উঠে এসেছে তা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়। বস্তুতপক্ষে ইউটিউব ও কিছু সংবাদমাধ্যমে এ আয়নাঘর সম্পর্কে অস্পষ্ট কিছু তথ্য মাত্র কয়েক মাস আগে জনসমক্ষে আসে কিন্তু তাও কোনো নির্ভরযোগ্য খবর ছিল না। কোন ব্যক্তি অপরাধ করলে বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রকাশ্য আদালতে দ্রুত বিচার করার বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও আয়নাঘরে আটক বন্দিদের বিচারের সম্মুখীন না করে বছরের পর বছর আয়নাঘর নামক গোপন ঘরে আটকে রেখে বন্দিদের নির্যাতন ও নিপীড়ন করা হতো। উল্লেখ্য যে, ২০১৯ সালে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ হতে ইউপিডিএফ নেতা মাইকেল চাকমার নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি জানার পর নিখোঁজ মাইকেল চাকমাকে উদ্ধারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে গৃহীত কার্যক্রম সম্পর্কে কমিশনকে অবহিত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে পত্র প্রেরণ এবং বেশ কিছু তাগিদ পত্র দেয়ার পর একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, মাইকেল চাকমা নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর এলাকা থেকে নিখোঁজ বা অপহরণ হয়েছে এই ধরনের কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই বিধায় আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।

সুয়োমটোতে উল্লেখ রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক নিখোঁজ/গুমের অভিযোগ কমিশন স্বপ্রণোদিত হয়ে কিংবা কারো অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রহণ করে সরকারের কাছে শুধু প্রতিবেদন তলব করতে পারে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯ এর ১৮ ধারার সীমাবদ্ধতার কারণে কমিশন এক্ষেত্রে নিজে তদন্ত করতে পারে না বিধায় শুধুমাত্র সরকারের দেয়া প্রতিবেদনের উপর নির্ভর করতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের কাছে থেকে এই প্রতিবেদন পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। আইনের এই সীমাবদ্ধতা কমিশনকে অনেকটা অসহায় অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয় যার আশু সংস্কার প্রয়োজন মর্মে কমিশন মনে করে।

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আয়নাঘর নামক নিষিদ্ধ কারাগারে বছরের পর বছর আটক রেখে যে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে তা একাধারে সংবিধান ও আইনের শাসনের পরিপন্থী ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন মর্মে কমিশন মনে করে। বিনা বিচারে আটক থাকার ফলে এ সকল বন্দিদের যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়। এক্ষেত্রে প্রত্যেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার হকদার।

বর্ণিত প্রেক্ষাপটে, আয়নাঘর নামক এই গোপন নির্যাতন সেলের অবস্থান কোথায়? কারা এই সেল পরিচালনা করতো, তৈরি হওয়ার পর সর্বমোট কতজন এ আয়নাঘরে অন্তরীণ ছিল, তাদের পরিচয়, কোন আইন বলে ভাবে তাদের অন্তরীণ করা হয় এবং কারা এই গোপন সেল তৈরির নেপথ্যে ছিল একটি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে তা জনসমক্ষে আসা উচিত। সেই সঙ্গে আরো কোন ব্যক্তি এই নির্যাতন সেলে আটক থাকলে দ্রুত মুক্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণসহ আয়নাঘর তৈরির নেপথ্যের কারিগরদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে কমিশনে দ্রুত প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য সিনিয়র সচিব, জননিরাপত্তা বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে। আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখ প্রতিবেদনের জন্য ধার্য করা হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত