ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ত্রাণ বিতরণে বিশৃঙ্খলা দুর্গম এলাকায় হাহাকার

ত্রাণ বিতরণে বিশৃঙ্খলা দুর্গম এলাকায় হাহাকার

উজানের ঢল ও কয়েকদিন টানা বৃষ্টিতে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ১২ জেলায় বন্যার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। তবে দুদিন ধরে ভারি বৃষ্টির প্রবণতা কমায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতির দিকে। বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটলেও বন্যাকবলিত মানুষের জীবনযাপনে কোনো ধরনের উন্নতি ঘটেনি। বরংচো ত্রাণ ও বিভিন্ন ধরনের পণ্য সামগ্রী বিতরণের ক্ষেত্রে পরিকল্পনার অভাব থাকায় দুর্গম এলাকায় পর্যাপ্ত সহযোগিতা পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।

বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি বাড়িতে ৩ থেকে ৫ ফুট পানি। নিচু এলাকাগুলো যার পরিমাণ ৬ থেকে ৭ ফুট। বসতঘরে পানি প্রবেশ করায় আশ্রয়কেন্দ্র, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে অবস্থান নিয়েছেন মানুষ। বসত ও রান্নাঘরে পানি ঢুকে পড়ায় খাবার-সংকটে রয়েছেন বেশির ভাগ মানুষ। জেলার প্রধান সড়কসহ প্রায় ৮০ ভাগ সড়ক কয়েক ফুট পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় বেশিরভাগ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। সড়কগুলোতে যান চলাচল অনেকটাই কম।

কুমিল্লা জেলার অধিকাংশ এলাকা পানিতে নিমজ্জিত থাকলেও ত্রাণ ও উদ্ধার কর্মীরা দাউদকান্দি, বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া এলাকায় বেশি প্রবেশ করছেন। ত্রাণ পাচ্ছেন না পানিবন্দি নাঙ্গলকোট, লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায়। গতকাল রোববার এসব এলাকার বাসিন্দারা অভিযোগ করেন যে, প্রচার-প্রচারণা কম থাকায় ব্যক্তি ও সংগঠন কেন্দ্রীক ত্রাণ ও উদ্ধার কাজ করা বাইরের স্বেচ্ছাসেবকরা কম আসছেন না।

উপজেলা তিনটির মধ্যে নাঙ্গলকোট ও মনোহরগঞ্জ উপজেলা একেবারেই নোয়াখালীর পাশে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যারাই ত্রাণ সহায়তা নিয়ে কুমিল্লায় আসছেন, তাদের সবাই কাছাকাছি অঞ্চল বুড়িচং বা আশপাশের উপজেলাগুলোতে প্রবেশ করছেন। মহাসড়ক থেকে দূরের উপজেলা হওয়ায় সেখানের বানভাসিদের কাছে যাচ্ছেন না কেউ।

স্থানীয়দের অভিযোগ, গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে প্রবেশ করার খবরে বুড়িচং উপজেলার প্লাবনের খবর বেশি প্রচার হওয়ায় সারাদেশ থেকে দলে দলে নৌকা ও ত্রাণসামগ্রী নিয়ে প্রবেশ করছেন সেখানেই। কিন্তু ডাকাতিয়া নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্লাবিত হয়েছে জেলার দক্ষিণের ৩ উপজেলা। এসব এলাকায় অন্তত আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দি আছেন। সরকারি ত্রাণ সেসব মানুষদের জন্য খুবই অপ্রতুল।

জাহাঙ্গীর আলম নামের নাঙ্গলকোট উপজেলার এক বানভাসি বলেন, আমাদের নাঙ্গলকোট দুর্গম এলাকা হওয়ায় এখানে কোনো সাংবাদিকও আসেন না। আমরা যে পানিতে তলিয়ে আছি, আমাদের খবরগুলো প্রচার করেন না। আমাদের এদিকে শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানির খুব প্রয়োজন। সরকারি সহায়তা আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়। তারেক আহমেদ নামের আরো এক বানভাসি বলেন, নাঙ্গলকোটে শুধু পানি আর পানি। অনেক অসুস্থ মানুষ, বৃদ্ধ মানুষ, গর্ভবতী নারীও আটকে আছেন তাদের উদ্ধার করা খুব দরকার। পাশাপাশি ত্রাণ সহায়তাও।

নাঙ্গলকোট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুরাইয়া আক্তার লাকী বলেন, নাঙ্গলকোটে ত্রাণ সরবরাহে কিছুটা সংকট আছে আমরা সেটা স্বীকার করছি। এ উপজেলার কিছু জায়গায় একেবারেই পৌঁছানো যাচ্ছে না। তবে আমরা চেষ্টা করছি স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে তাদের কাছে ত্রাণ সহায়তা দেয়ার। বর্তমানে নাঙ্গলকোটে উদ্ধারের মতো পরিস্থিতি শুধু একটি জায়গায় আছে। সেখানে নৌকা ও স্পিডবোট পাঠিয়ে সে এলাকার লোকদের উদ্ধার করা হবে।

মনোহরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উজালা রানী চাকমা বলেন, এখানে বন্যা পরিস্থিতি অবনতির দিকে। আজকে (গতকাল) পানি কিছুটা বেড়েছে। মনোহরগঞ্জ উপজেলার অনেক দুর্গম এলাকা রয়েছে যেগুলোতে নৌকা ছাড়া যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। আমাদের কাছে নৌকার প্রচুর সংকট রয়েছে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে পাঠিয়ে সেসব এলাকায় ত্রাণ সহায়তা পাঠানো হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি যেন একটা মানুষও অভুক্ত না থাকে।

এদিকে নোয়াখালীর বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পানিবন্দি অবস্থায় আছেন প্রায় ২১ লাখ মানুষ। বন্যাদুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্যসংকট। নতুন করে সাপের উপদ্রব বেড়েছে।

২৫০ শয্যাবিশিষ্ট নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) সৈয়দ মহিউদ্দিন আব্দুল আজিম বলেন, গত তিন দিনে নোয়াখালীতে ৬৩ জনকে সাপে কেটেছে। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে সাপে কেটেছে ২৮ জনকে। বন্যার কারণে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১০৮ জন।

সেনবাগ উপজেলার বাসিন্দা মো. আবুল খায়ের জানান, ফেনীর মুহুরী নদীর উজানের পানি প্রবেশ করায় জেলার সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ী উপজেলার আরো নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এসব উপজেলায় গত দুই দিন বৃষ্টি না হলেও উজানের পানি প্রবেশ করেছে। অনেক জায়গায় ঘরবাড়ি ও সড়ক তলিয়ে গেছে। স্কুলে ঢুকে পড়েছে পানি। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার ও পানির সংকট।

নোয়াখালী জেলা আবহাওয়া অধিদপ্তরের উচ্চ পর্যবেক্ষক আরজুল ইসলাম বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় ৩২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। উজানের পানিতে বন্যার পানি বাড়ছে। বন্যার কারণে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। প্রশাসন ঘোষিত আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ২৫ হাজার মানুষ উঠলেও অনেক মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন বিভিন্ন এলাকার বহুতল বাড়িতে।

মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক না থাকায় অনেকের মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মাঝে দিন কাটছে আত্মীয়দের। বুড়িচং উপজেলার ১৫টি গ্রাম এখনও ডুবে আছে। তবে বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় এবং কুমিল্লা ও ত্রিপুরাতে বৃষ্টি না হওয়া পানি ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে। খাগড়াছড়ি জেলায়ও বন্যা হলেও তা খুব বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি এবং বৃষ্টি না থাকায় খাগড়াছড়ি জেলা সদরের বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে। অন্যান্য বছরও এই বন্যা অল্প-বেশি হয়, এবার বেশি হয়েছে। সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার খোয়াই নদীর পানি অল্প অল্প করে কমছে। দুর্গত এলাকায় সেনাবাহিনী, প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংগঠন ত্রাণ সহায়তা দিয়েছে।

গতকাল রোববার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব কামরুল হাসান বলেছেন, উজানে ভারতের ত্রিপুরা থেকে নেমে আসা ঢল ও কয়েক দিনের প্রবল বৃষ্টির কারণে বন্যায় দেশের ১১ জেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ১০ লাখ ৪৭ হাজার ২৯ পরিবার। তবে নতুন করে কোনো এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা নেই।

তিনি বলেন, পানি নেমে যাওয়ার পর অনেক রোগের প্রাদুর্ভাব হতে থাকে। এ ব্যাপারে আমরা সতর্ক করেছি, প্রত্যেককে নিরাপদ পানি ব্যবহারের জন্য অনুরোধ করেছি। আমাদের কন্ট্রোল রুম খোলা আছে। এছাড়া প্রধান উপদেষ্টার একটি হিসাব খোলা আছে সেখানে যদি কেউ কিছু দিতে চান সেটি অব্যাহত আছে।

তিনি আরো বলেন, ফেনীতে একটি ফিল্ড হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে। সেখানে যে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক অথবা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বন্যা আক্রান্ত এলাকা থেকে যারা স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসবে তাদের প্রত্যেকের যেন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত