বিডিআর বিদ্রোহ

শেখ হাসিনাসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা

প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় হয়ে আছে তৎকালীন বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) বিদ্রোহে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। ৫৭ জন সেনা

অফিসারসহ ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। ওই বিদ্রোহে নিষ্ঠুর আচরণ ও পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন বিডিআরের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালনরত অনেক কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। দীর্ঘ ১৫ বছর পর বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাদীর আইনজীবী মো. দেলোয়ার হোসেন।

২০০৯ সালে বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) সদর দপ্তর পিলখানায় বিদ্রোহের ঘটনায় দায়ের করা মামলার আসামি বিডিআরের উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুর রহিমের কারাগারে মৃত্যুর ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। গতকাল রোববার ঢাকার মহানগর হাকিম মো. আখতারুজ্জামানের আদালতে মৃত আব্দুর রহিমের ছেলে অ্যাডভোকেট আব্দুল আজিজ এই মামলা করেন।

মামলার বাদী আব্দুল আজিজ বলেন, ২০১০ সালে বিডিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় যে অপমৃত্যুর মামলাটি হয়েছে তা রিকল করেছেন। অপমৃত্যুর মামলার সর্বশেষ অবস্থা দেখে আদালত এ মামলার আদেশ দেবেন। বর্তমান সরকারের সময় পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিয়ে এটিই প্রথম মামলা হচ্ছে। এ মামলায় জেনারেল আজিজ আহমেদকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। আর দ্বিতীয় আসামি হলেন বিডিআর বিদ্রোহের মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি) মোশাররফ হোসেন কাজল, আসামির তালিকায় শেখ হাসিনা রয়েছেন চতুর্থ স্থানে। বাকি আসামিরা হলেন- সাবেক কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশরাফুল ইসলাম খাঁন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক এমপি নূরে আলম চৌধুরী লিটন, শেখ সেলিম ও শেখ হেলাল, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবীর নানক, সাবেক এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতা মির্জা আজম, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, কেন্দ্রীয় কারাগারের তৎকালীন জেল সুপার, ডাক্তার রফিকুল ইসলামসহ অন্য ডাক্তার রয়েছেন। এছাড়াও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত মন্ত্রী এমপিসহ অজ্ঞাত আরো ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

মামলায় অভিযোগে বলা হয়, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকার ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তর পিলখানায় সুপরিকল্পিতভাবে বিদেশি এজেন্ট নিয়োগ করে ৫৭ জন সেনা অফিসারসহ ৭৪ জনকে হত্যা করে। পরে বিডিআর বিদ্রোহের অভিযোগে চকবাজার থানায় হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। বাদী অভিযোগ করেন, তার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিম ডিএডি হিসেবে পিলখানায় কর্মরত ছিলেন। তাকেও বিডিআর বিদ্রোহের মামলায় আসামি করে আটক করা হয়।

তিনি উল্লেখ করেন, তার বাবা আব্দুর রহিমকে ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানার মধ্যে হত্যার চেষ্টা করে কয়েকজন। কিন্তু সাধারণ সৈনিকরা তার বাবাকে ভালোবাসতেন বিধায় তারা রক্ষা করেন। ২০০৯ সালের জুলাই মাসে কোনো একদিন ডিএডি আব্দুর রহিমকে পিলখানার ঢাকা সেক্টরের দ্বিতীয় তলায় নিয়ে জেনারেল আজিজ ও আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজলসহ আরো কয়েকজন পিলখানার ঘটনার রাজসাক্ষী হতে বলেন। তাকে বিভিন্ন ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে রাজসাক্ষী হয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বলেন। বাবা রাজি না হওয়ায় তাকে বিডিআর বিদ্রোহের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নেয়া হয়। রিমান্ড শেষে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। পরে ২০১০ সালের ২৯ জুলাই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বাদীর বাবার শরীরে ইনজেকশন পুশ করার মাধ্যমে তাকে হত্যা করা হয়। পরিকল্পিতভাবে আসামিরা তার বাবাকে হত্যা করেছেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এরপর গত ১৭ আগস্ট শনিবার রাজধানীর মহাখালীর রাওয়া ভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিডিআর বিদ্রোহে নিহত মেজর শাকিলের ছেলে রাকিন আহমেদ বলেছিলেন, বিডিআর বিদ্রোহে রাজধানীর পিলখানায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ সেলিম, শেখ ফজলে নূর তাপসসহ অনেকে সরাসরি জড়িত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে নিহত মেজর শাকিলের ছেলে রাকিন আহমেদ দাবি করেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ফজলে নুর তাপস ও শেখ সেলিম সরাসরি জড়িত। এছাড়াও নেপথ্যে আরো রয়েছে। স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন হলে তাদের নামও আসবে।

এ সময় নিহত সেনা কর্মকর্তা কর্নেল শফিকের ছেলে অ্যাডভোকেট সাকিবুর বলেন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম সেই সময় কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল হিসেবে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের তদন্ত কমিটিতে ছিলেন। রিপোর্টটি প্রকাশ করেছেন সেটি তিন দফা সংশোধন করার পর মিডিয়ায় দেয়া হয়েছিল। তিনি সেই রিপোর্টের ‘র’ কপি প্রকাশের দাবি জানান। নিহত পরিবারের সদস্যরা বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ভারতের হাত রয়েছে। এছাড়া হত্যকাণ্ডের ঘটনায় ডাল-ভাত নিয়ে দ্বন্দ্বের যে কথা প্রচার করা হয় তা সত্য নয়। এ হত্যাকাণ্ডটিকে ভিন্ন খাতে নিতেই এমন কথা প্রচার করা হয়েছিল।

২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়; আরো ২৫ জন বিদ্রোহে জড়িত থাকার কারণে তিন থেকে দশ বছর কারাদণ্ড পেয়েছিল। আদালত অভিযুক্ত ২৭৭ জনকে খালাস দিয়েছিল।

প্রত্যেক বছরের মতোই ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বনানীর সামরিক কবরস্থানে শহীদদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শাহাদতবরণকারী সেনা কর্মকর্তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে সেনা কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সেনাবাহিনীর তদন্তের প্রকৃত চেহারা দেখতে পাননি জনগণ। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের ধরতে যেভাবে তদন্ত করা উচিত ছিল, সেটা হয়নি। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে একটি তদন্ত করা হয়েছিল। কিন্তু তার প্রকৃত চেহারা জনগণ দেখতে পাননি।

পরের বছর ২০২২ সালে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ড শুধু বিদ্রোহ ছিল না, এর পেছনে একটা সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র ছিল। এর মূল কারণ ছিল সেনাবাহিনীর মনোবলটাকে ভেঙে দেয়া। এত দিন পরও তদন্ত করে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি। এর পেছনে কারা ছিল? কারা এ ঘটনাগুলো ঘটিয়েছিল?

মির্জা ফখরুল আরো বলেন, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধেও কিন্তু আমাদের এত কর্মকর্তা নিহত হননি। যেখানে আমাদের ৫৭ সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। তারপর সীমান্ত রক্ষার ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান ছিল, সেটাকে ভেঙে দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়েছে। হাজারো বিডিআর সৈনিকদের বিচার করা হয়েছে। কিন্তু এর পেছনে আসলে কারা, এর সুষ্ঠু তদন্ত রিপোর্ট আমরা পাইনি। সেনাবাহিনী দিয়ে তদন্ত করা হয়েছিল, তারাও রিপোর্ট প্রকাশ করেনি।